বাংলায় মুসলিম শাসনে ফারসির ক্ষমতায়ন

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪

মুহম্মদ আল মুখতাফি

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলায় প্রবেশ করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি। বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরণ মূলত সেখান থেকেই। তার আগে কয়েক শতাব্দী ধরে সমুদ্রপথে আরব বণিকদের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ থাকলেও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। ভারতের অন্যপ্রান্তে সিন্ধু ও মুলতানে ইসলামের রাজনৈতিক বিস্তার অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগেই। সেদিক থেকে দেখলে সিন্ধুবিজেতা মুহম্মদ বিন কাসিম থেকে বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খলজি পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান প্রায় পাঁচ শতক। বাংলায় ইসলামের সম্প্রসারণে এত দেরি হলো কেন, সে প্রশ্নের জবাব হয়তো ভিন্ন। তবে এটা লক্ষণীয় যে মুহম্মদ বিন কাসিম ছিলেন আরব আর বখতিয়ার খলজি তুর্কি বংশোদ্ভূত। অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিমদের জয়যাত্রায় আরবদের ভূমিকা যত তীব্র ছিল, কয়েক শতাব্দী পরে সে ভূমিকা নেয় অনারবরা। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার পারসিক, তুর্ক, আফগান ও মোঙ্গলদের হাত ধরে। বাংলায় রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ও বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে দ্বিতীয় স্রোত। ফলে এখানকার ক্ষমতার ভাষা নির্মাণেও রয়েছে পারসিক, আফগান ও তুর্কি ঐতিহ্যের শেকড়। আরবির চেয়ে মধ্য এশিয়ার ভাষাই তাদের তাড়িত করেছে বেশি।

বখতিয়ার খলজির পরও দীর্ঘদিন অস্থিরতা ছিল বাংলাজুড়ে। মুসলিম শাসকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছে আরো প্রায় এক শতাব্দী। তারপর সোনারগাঁও থেকেই হোক আর লক্ষ্ণৌতে থেকে; বাংলার মসনদে যারাই বসেছেন, তাদের প্রায় সবাই ছিল ইরান কিংবা আফগানিস্তান থেকে আসা। দিল্লির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলার সুলতানরা নিজেদের মতো করে ক্ষমতা কাঠামো গঠন করেছেন। একদিকে তৈরি হয়েছে অভিজাত শ্রেণী, অন্যদিকে ভূমিকা রেখেছে সুফিরা। বাংলায় নুর কুতুবুল আলম, আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি ও কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী নিজেদের মতো অবস্থান নিয়েছেন ক্ষমতাকাঠামোর বাঁক নিয়ন্ত্রণে।

দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্থান ও ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্ক প্রশ্ন অনেক সময়ই ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলায় বিষয়টি ছিল আরো তীব্র। খলিফা, সুলতান কিংবা ইমরাতের প্রচলিত ধারণা বাংলায় জুতসই হয় না। যদিও এখানকার শাসকরা সুলতান উপাধি নিয়েছেন, তার পরও এখানে গড়ে উঠেছিল স্বতন্ত্র ধারার শাসন ব্যবস্থা। তারা ধর্মীয় দিক থেকেও ছিলেন যথেষ্ট সহিষ্ণু। এ সময়ে কেবল প্রশাসনিক পরিভাষাই তৈরি হয়নি; তৈরি হয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য থেকে প্রভাবিত সাহিত্য ও সংস্কৃতিও। কররানি শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলা মোগল শাসনের অধীনে চলে যায়। মোগলরা ছিলেন অনেক দিক থেকেই সর্বভারতীয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলায় ফারসির প্রভাব চলে আসছিল। এবার থেকে অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলায়ও তীব্র হয় ফারসির প্রভাব। মোগল আমলে রাজভাষা ছিল ফারসি, যা দীর্ঘ ৬০০ বছর একই অবস্থানে থেকে আধিপত্য করেছে।

বাংলা ভূখণ্ডে দুভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফারসি। প্রথমত, দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার এবং দ্বিতীয়ত, সাহিত্য কর্মে ফারসি শব্দের উপস্থিতি। এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের পর বছরের পর বছর ধরে মুসলিম শাসনের বড় বলয় তৈরি হয়েছে। সে প্রভাব রয়ে গেছে ভাষার মধ্যে। শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার দরুন চলেছে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, সেখানে ফারসি পেয়েছে বিশেষ করে। এভাবে ফারসি পৃথক এক মর্যাদা অর্জন করতে পারে। পৃথিবীর অনেক ভাষাই অন্য ভাষার প্রভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যতিক্রমটি। ঔপনিবেশিক বা ব্রিটিশ শাসনামলে এবং তার আগের ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনের পরও বাংলা ভাষা বিভিন্ন শব্দ নিজের মতো করে গ্রহণ করেছে।

বাংলায় ফারসির প্রবেশ ঘটেছে মুসলিম শাসনেরও আগে। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা মানুষের মাধ্যমেই বাংলার মানুষের প্রথম ফারসির সঙ্গে পরিচয় হয়। সুলতানি শাসন ও তারপর মোগল শাসনের আওতাভুক্ত সুবেদার এবং যে নবাবরা বাংলায় কাজ করেছেন তারা ধর্মীয় বিবেচনায় মুসলমান হলেও তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো কেবল ধর্ম সম্পর্কিত ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালত, দাপ্তরিক প্রয়োজনে, মোটকথা শাসন কাঠামোর অংশ হিসেবে এ ফারসি শব্দগুলো এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দৈনন্দিন জীবনের অনেক শব্দ ফারসি থেকে এসেছে। মোগল শাসনের পতনের পরও ফারসি প্রভাব বাংলা থেকে সরে যায়নি, তার পেছনেও রয়েছে ক্ষমতার সমীকরণ। ফারসি মিশ্রিত বাংলা তৎকালে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশের কথ্যভাষা ছিল। সুলতানি ও মোগল শাসনামলে বাংলা যখন দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো, তখন অনুশাসন পাঠানো হতো ফারসিতে। স্বাভাবিকভাবেই তখন সরকারি কাজে ফারসির প্রচলন শুরু হয়। সুলতানি ও মোগল আমলে সেখানে যারা চাকরি করত, তাদের অনিবার্যভাবে ফারসি শিখতে হতো। এভাবে একদিকে রাজভাষা হওয়া, অন্যদিকে শিক্ষিত ব্যক্তিদের সাহিত্য আগ্রহের কারণে ফারসির চর্চা করতে হয়েছে। ফারসি সমৃদ্ধ করেছে বাংলার শব্দভাণ্ডার। দরবারি ভাষা হওয়ায় ফারসি ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলো বাংলার ক্ষমতাকাঠামোর অভিধানেও প্রবেশ করেছে। ইনসাফ, খারাজ, জিজিয়া, আদালত, খেলাফত, নিজামত, সুলতান প্রভৃতি শব্দের ছিল নিজস্ব দ্যোতনা।

মোগল শাসনের ভার সংকুচিত হয়ে আসার পরও ফারসি যে বিপুলভাবে ব্যবহার হয়েছে; তার কারণ অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। পলাশীর যুদ্ধ ও সিপাহি বিদ্রোহে হেরে যাওয়ার পর রাজনীতিতে ক্ষমতা হারায় মুসলমানরা। মুসলমানপ্রধান এ অঞ্চলের মানুষ চেয়েছে তাদের ভাষা দিয়ে স্বকীয়তা, জাতিবোধ ও স্বাজত্যবোধ প্রকাশ করতে। ফারসি ভাষা সে আত্মপরিচয়ের একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে তাদের সামনে। ফলে তারা ভাষার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আরবি ফারসি প্রয়োগ করেছে। জন্ম নিয়েছে সমৃদ্ধ পুথি সাহিত্যের দীর্ঘ ধারা। তবে সে সময়ের সাহিত্যে ফারসি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক প্রবণতার চেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার সবটা স্থায়ী হয়নি। এর মধ্যে যেটুকু ভাষার সঙ্গে মিলে যায় সেটাই রয়ে গেছে।

মধ্যযুগের শেষ অংশে প্রচুর পরিমাণে পুথি সাহিত্য রচিত হয়েছে। এতে মুসলিমদের গৌরবগাথা বর্ণনা করা হয়েছে, সে বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রচুর ফারসি, আরবি, উর্দুর মতো শব্দ। মূলত মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর পর ভাষা দিয়ে যে নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করতে চেয়েছে সাহিত্যকর্মের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুথি যেহেতু বৈঠকি ঢঙে সবার সামনে পঠিত হতো, তাই ফারসি মিশেলে বাংলা যে অনেকটা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। এর আগে চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো মধ্যযুগের সাহিত্যে ফরাসি শব্দের প্রয়োগ ছিল অনেক কম। রাজভাষা হিসেবে ফারসির গ্রহণযোগ্যতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা পেয়েছে মধ্যযুগের শেষের ২০০ বছর ছাড়া। অন্যদিকে মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে এ দৃশ্য অনেকটাই বদলে যায়। লাইলী-মজনু, এমনকি আরবি প্রভাবিত চতুর্দশ শতাব্দীতে কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের রচিত সাহিত্য ইউসুফ জুলেখাও হয়ে ওঠে ফারসি প্রভাবিত। আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখায় প্রচুর ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। 

ভাষার স্বাভাবিক নিয়মে যখন কোনো একটি ভাষার মধ্যে অন্য ভাষার শব্দ ঢোকে, তখন শব্দটি ওই ভাষারই হয়ে যায়। ফলে বাংলায় বহুল ব্যবহৃত ফারসি শব্দগুলো এখন বাংলার নিজস্ব সম্পদই। হয়তো এগুলোর ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গেলে বিভিন্ন উৎস পাওয়া যাবে। বাংলা ভাষার ভেতরে ফারসি ভাষার এমন বিস্তার এখানকার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার একটা নিবিষ্ট ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দেয়।

মুহম্মদ আল মুখতাফি: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]