বাংলাদেশে গন্ডোয়ানার কয়লা

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২৪

মুহম্মদ আল মুখতাফি

বঙ্গীয় বদ্বীপ। উত্তর ও পশ্চিমে ভারত এবং পূর্বে মিয়ানমার। আশ্চর্য উর্বর এক ভূমি। হিমালয়ের পাদদেশে এবং গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বদ্বীপ। প্রায় দুই লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে অবস্থিত এ ভূমি গড়ে উঠেছে ক্রিটাসিয়াস যুগের প্রথম দিকে। ক্রিটাসিয়াস যুগ বলতে ১৪ কোটি থেকে ৬ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত সময়কে ধরা হয়। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান পলিপ্রবাহ। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে ভূমির পরিধি। ভারত প্রাচীন গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে প্রথমে আফ্রিকা এবং পরে অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মাদাগাস্কারের সঙ্গে পৃথক হয়ে এগিয়ে গেছে। ইউরেশিয়া প্লেটের সঙ্গে সংঘাতের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় হিমালয়। ভারতীয় প্লেটে অবস্থিত দেশগুলো অবস্থান নেয় আজকের জায়গায়। ফলে কেবল জলবায়ুই বদলে যায়নি, বদলে গেছে প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনপ্রবাহ। গন্ডোয়ানার সঙ্গে সম্পর্কের জন্যই এ অঞ্চলকে হাইড্রোকার্বনের সম্ভাব্য সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানকার ভৌগোলিক বিন্যাস সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেছেন গবেষক মো. নেহাল উদ্দিন তার Gondwana Deposits of the Bengal Basin (Bangladesh) and Coal Potential গবেষণাপত্রে। 

সত্যি বলতে বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাস অনেকটাই ভূমিকম্প থেকে পাওয়া প্রমাণাদিনির্ভর। অববাহিকায় পলি জমার ইতিহাস এখনো সেভাবে সামনে আসেনি। টেকটোনিক প্লেটের বিবর্তন ও হিমালয়ের পাদদেশের প্রবাহের কথা অগ্রাধিকার পেলেও সে হিসেবে আলোচনা হয় না অন্যদিক। অথচ বাংলার অববাহিকা গড়ে ওঠার পেছনে বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটের অধোগমনও একটা যৌক্তিক কারণ। এদিকে আলো ফেলে বঙ্গীয় বদ্বীপের উদ্ভব ও বিকাশকে বয়ান-প্রতিবয়ানের মধ্য দিয়ে নেয়ার অধ্যায়টা এখনো বড় পরিসরেই বাকি। তাছাড়া বাংলা অববাহিকায় এত বেশি পলি জমেছে যে তার নিচের কাঠামো সম্পর্কে পাঠ করা যথেষ্ট কঠিন। বার্মার পশ্চিমে এসেই ইন্দো-বার্মা ব্লকের সঙ্গে ভারতীয় প্লেটের সংঘাত হয় ও অধোগমন ঘটে। 

ভারত দক্ষিণ গোলার্ধের অন্য অঞ্চলগুলোর মতোই গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ। কয়লা বহনকারী গন্ডোয়ানা অববাহিকা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগেই। গন্ডোয়ানাল্যান্ড ভেঙে গেলে এ অববাহিকা ভেঙে খাত তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে ভারত ইউরেশিয়ার দিকে যাত্রা করলে অববাহিকা সমেত চলে আসে। বঙ্গীয় বদ্বীপে সমৃদ্ধ কয়লার মজুদ এটাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলজুড়ে এ অববাহিকা গঠিত হয়েছিল সুপ্রাচীনকালে। তবে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছিল তা নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। তার পরও ধারণা করা হয়, গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ভাঙনের পর ভারতীয় প্লেটের উত্তর ভাগের অববাহিকা তৈরি হতে থাকে। পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অববাহিকা আকৃতি পেয়েছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইউরেশিয়া প্লেটে ধাক্কা এবং হিমালয়ের উত্থান একে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু গন্ডোয়ানার সেই পাথর ও কয়লা টিকে আছে আগের সমৃদ্ধি নিয়েই।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যে পরিমাণ খনিজ কয়লা উত্তোলিত হয়, তার অধিকাংশই গন্ডোয়ানা কয়লা। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে যেসব অববাহিকা চিহ্নিত করা গেছে সেগুলোর নয়টির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে পাঁচটির মধ্যেই গন্ডোয়ানা কয়লার নিদর্শন পাওয়া গেছে। বদরগঞ্জ উপজেলার মোস্তফাপুর, পার্বতীপুর উপজেলার বুড়িরডোবায় গন্ডোয়ানার বেলেপাথর পাওয়া গেছে। তবে সেখানে কয়লা পাওয়া যায়নি। গন্ডোয়ানার পাথর পাওয়া গেছে প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের বেজমেন্টে। ওপরের দিকটায় রয়েছে টারশিয়ারি যুগের শিলা এবং ক্রিটাসিয়াস। গন্ডোয়ানা কয়লা অবস্থিত ভূত্বকের ১১০ থেকে ২,৬৩০ মিটার পর্যন্ত। তবে কয়লা বহনকারী পাথর অববাহিকা থেকে অববাহিকায় ভিন্ন হতে পারে। 

১৯৫৯ সালে স্টানভাক কোম্পানি বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ দেশে উন্নতমানের খনিজ সম্পদপ্রাপ্তির অনুমান যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়। স্টানভাক বগুড়া জেলার কুচমাতে Kuchma X- নামক কূপ খনন করতে গিয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৩৮১ মিটার গভীরতায় গন্ডোয়ানা কয়লার সন্ধান লাভ করে। প্রথমদিকে কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও পরবর্তী সময়ে খননকাজ চালাতে গিয়ে কয়লাখনিটি আবিষ্কৃত হয়। কয়লাখনিটির আবিষ্কার বাংলাদেশে আহরণযোগ্য গভীরতায় খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালে পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসপি) বগুড়া ও রাজশাহী জেলায় ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক, ভূ-পদার্থীয় জরিপ ও খননকার্য চালায়। ফলে ১ হাজার ৫০ মিলিয়ন টন মজুদসমৃদ্ধ জামালগঞ্জ-পাহাড়পুর কয়লাখনি এবং প্রচুর পরিমাণে ইয়োসিন চুনাপাথরের মজুদ আবিষ্কৃত হয়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর বা জিএসবি ১৯৮৫ সালে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়ায়, ১৯৮৯ সালে রংপুর জেলার খালাসপীর নামক স্থানে এবং ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের দিঘিপাড়ায় পার্মিয়ান যুগের গন্ডোয়ানা কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কার করে। বড়পুকুরিয়া কয়লা অববাহিকায় ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে জিএসবি সাতটি উত্তোলন কূপ খনন করতে সক্ষম হয়। জিএসবি এ কয়লা ক্ষেত্রের মজুদ, গুরুত্ব ও বিস্তার নির্ণয় করতেও সমর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে খনির বিস্তৃতি, মজুদ, পুরুত্ব, কয়লা স্তরের অবস্থা, অধিচাপ বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং জল-ভূতাত্ত্বিক (hydrogeological) পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়ার লক্ষ্যে চীনা ও ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো আরো ২৫টি কূপ খনন করে। এছাড়া জিএসবি খালাসপীর কয়লা ক্ষেত্রে চারটি এবং দিঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে একটি কূপ খনন করে। খালাসপীর ও দিঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রের কয়লা বড়পুকুরিয়া কয়লার মতো একই জাতীয়, তবে এ দুই কয়লা ক্ষেত্রের বিস্তৃতি, মজুদ, পুরুত্বসহ বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা এখনো সম্পন্ন হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ার ব্রোকেন হিল প্রোপ্রাইটর ১৯৯৭ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীতে ভূপৃষ্ঠের ১৫০ মিটার গভীরে গন্ডোয়ানা কয়লা আবিষ্কার করে। অবশ্য কথা উঠেছে যে বাংলাদেশের মাটির গঠন, পানির গভীরতা, বৃষ্টি ও বন্যার ধরন কোনোভাবেই উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির উপযোগী নয়। এতে কৃষিভূমি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে সেখান থেকে মোট কয়লার মাত্র ১০ ভাগ উত্তোলন করা যাবে, যা অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক। তাছাড়া বিদেশী কোম্পানি যে নিয়মে এ কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দিয়েছে তাও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। 

বড়পুকুরিয়া কোল বেসিনের বিস্তৃতি ৬ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার। বেসিনে কয়লার মোট মজুদ ৩৯০ মিলিয়ন টন। সমগ্র কয়লা ক্ষেত্রের উপরিভাগ বারিন্ড ক্লে স্তর (মধুপুর ক্লে) দ্বারা আবৃত রয়েছে। স্তরের নিচে ডুপি টিলা স্তর বিদ্যমান। ডুপি টিলা স্তরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি পানিবাহী আপার ডুপি টিলা এবং অন্যটি কাদামাটিযুক্ত লোয়ার ডুপি টিলা স্তর। ওই স্তরের নিচে কয়লাবাহী গন্ডোয়ানা স্তর অবস্থিত। এভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত পার্মিয়ান গন্ডোয়ানা কয়লা ক্ষেত্রগুলো যেন সুপ্রাচীন কালের গন্ডোয়ানার সাক্ষর বহন করে চলছে।

মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক ও সাংবাদিক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]