বগুড়ার সংস্কৃতিতে মিশে আছে বেহুলা-লখিন্দর

প্রকাশ: জুলাই ১৬, ২০২৪

এইচ আলিম

বেহুলা-লখিন্দরকে নিয়ে বগুড়ায় শত শত বছর ধরে চলে আসছে নানা কল্পকাহিনী। আর ইতিহাসের পাঠ ধরে চলছে নানা বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। বেহুলার পালাগানে যেমন আছে বিশ্বাস, তেমনি আছে শিখন ব্যবস্থাও। কালে কালে এ অঞ্চলে বেহুলা ও লখিন্দরের কাহিনী প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। নির্মাণ হয়েছে যাত্রাপালা, পালাগানের আসর, লোককাহিনী, লোকশিল্প, কবিতা, নামকরণ, কফি শপ, ব্যবসা, খাবার, একাধিক নাটক।

বগুড়ার প্রবীণ কবি ও পাঠকপণ্য পাঠশালার সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত দেব। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তিনি জন্মের পর থেকেই বেহুলা লখিন্দরের লোককাহিনী শুনে আসছেন। কবিতা লেখা শুরু করলে তরুণ বয়েসে তিনি একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। কাব্যগ্রন্থটির নাম দেন ‘করতোয়ার জল ছুঁয়ে বেড়ে ওঠে বেহুলার ছেলে’। কাব্যগ্রন্থে বেহুলা, লখিন্দরকেন্দ্রিক কিছু কবিতা, করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত মহাস্থানগড়, বেহুলার বাসরঘর এসব নিয়ে নানা কথা এ কবিতায় উঠে এসেছে। ব্যক্তিগত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবও রয়েছে। বাস্তবিক বেহুলার বাসরঘরকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় অসংখ্য পালা হয়েছে। অনেক কবি কবিতা লিখেছেন।

বগুড়ায় নিয়মিত বেহুলা নিয়ে পালা হয়। পালাকার সাইফুল ইসলাম বুলবুলের বাবা মোস্তাফিজার রহমান স্বাধীনতার আগে থেকে বেহুলা পালা করেছেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, বগুড়া সদর, মহাস্থানগড়, কাহালুসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বেহুলার পালা করে বেড়াতেন। এজন্য একটি দল গঠন কনে। সে দলে প্রায় ২০ জন মিলিয়ে এ পালা করতেন। বাবার পর এবার তিনি বেহুলার পালা করছেন। এ পর্যন্ত তিনি ১৮টি মঞ্চায়ন করেছেন। শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় ঢাকায়, বগুড়ায়, কাহালু, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় এ বেহুলার পালা করে চলেছেন। তার দলে এখন ১৬ জন কাজ করছেন। বেহুলার পালা এমনই একটি বিষয় যে সারা রাত এর পালা। কিন্তু এখন মানুষ সারা রাত পালা খুবই কম দেখে। সে কারণে এটি সময়ের দিক থেকে ব্যাপ্তি কম করা হয়েছে। এমন কোনো এলাকা রয়েছে যেখানে বেহুলার পালা করতে গিয়ে অনেক নারী-পুরুষ কেঁদে দিয়েছেন। অনেক সনাতন ধর্মের মানুষ পূজনীয় হিসেবে দেখেন। পালা শেষে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছেন।

বগুড়ায় মঞ্চেও এসেছে বেহুলাকে নিয়ে নাটক। প্রায় ৪৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানান, বেহুলা-লখিন্দরকে নিয়ে বগুড়ায় অসংখ্য ছোট নাটক তৈরি হয়েছে। বগুড়া থিয়েটার থেকেও একসময় করা হয়েছে। প্রথম দিকে বেহুলার পালা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত। খড় নিয়ে মাটিতে বসে বসে বেহুলার নাটক দেখত। তারা মনে করত বেহুলা যেন সত্যিকারে নেমে এসেছে। বগুড়ার ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে যেমন, ঠিক তেমনি বেহুলা-লখিন্দরের নানা কাহিনী নিয়ে নির্মাণ হয়েছে নানা নাটক, কবিতা। ডোম হাউজ নামে একটি কফি শফ খোলা হয়েছে। সেটিও বেহুলার বাসরঘরকে কেন্দ্র করে। এটির মালিক হলেন আনিসুজ্জামান আনিস। তিনি নাট্যকর্মী। বর্তমানে শিক্ষকতা করলেও তিনি বেহুলার স্মৃতিবিজড়িত এলাকায় এ কফি শপ করেছেন। তার ধারণা পর্যটকরা এসে একটু আলাদা পরিবেশে বসে কফি পান করার পাশাপাশি বেহুলার ইতিহাস বিষয়ে জানতে পারবেন।

এছাড়া বগুড়া অনুশীলন’৯৫ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে বেহুলা নামে নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। এ সংগঠন বেহুলা পালা নিয়ে পথনাটক নির্মাণ করে বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করে। বেহুলা নামে লোকশিল্প রয়েছে। শিশুদের বিভিন্ন খেলনার পাশাপাশি রয়েছে কাঁথা সেলাই করে বেহুলা-লখিন্দরের প্রতিকৃতির মাধ্যমে ফুঠে তোলা। মাছ, নদী, বেহুলার নারী চরিত্র সুই সুতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাধিকবার। যদিও এখন এ সেলাইয়ের কাজ বিরল। তবে একসময় লোকশিল্পের আওতায় কাঁথায় এসব বুনন করা হতো। বেহুলার বাসরঘর এলাকায় এখনো এমন কিছু নিদর্শনের দেখা পাওয়া যায়। কবিতা প্রকাশ করেছেন কবি এইচ আলিম, কবি আজিজার রহমান তাজ, লুবনা জাহান, ফাতেমা ইয়াসমিনসহ বগুড়ার বিভিন্ন সময়ের কবিরা।

ইতিহাসে রয়েছে ১৯৩৪-৩৬ সালে এনজি মজুমদার কর্তৃক বেহুলার বাসরঘর বা গোকুল মেধ এলাকায় খননের ফলে এখানে একটি বিশাল স্তূপের ভিত্তি উন্মোচন হয়। এতে ১৭২টি ঘর বা কুঠুরি পাওয়া যায়। মাটি দিয়ে ভরাট করে নিচ থেকে ওপরের দিকে তোলা হয়েছে কুঠুরিগুলো। উঁচু করা বহুতলবিশিষ্ট সমান্তরাল ঠেস দেয়ালযুক্ত ভিতের ওপর প্রকৃত স্থাপত্য নির্মাণরীতি প্রাচীন বাংলাদেশের একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য। এখানে গুপ্তযুগের (ছয়-সাত শতক) কতগুলো পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। সেন যুগে (এগারো-বারো শতক) এখানে বারান্দাযুক্ত একটি বর্গাকৃতির মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এ মন্দিরে বহু গর্তযুক্ত একটি ছোট প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে ষাঁড়ের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ একটি স্বর্ণের পাত পাওয়া গেছে। বেহুলার বাসরঘর একটি অকল্পনীয় মনুমেন্ট। গবেষকদের মতে, এ মনুমেন্ট ৮০৯-৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল নির্মিত একটি বৌদ্ধমঠ। স্তূপটি বাসরঘর নয়। স্তূপটির পশ্চিমার্ধে আছে বাসরঘরের প্রবাদ স্মৃতিচিহ্ন। পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোণবিশিষ্ট চৌবাচ্চাসদৃশ একটি বাথরুম। ওই বাথরুমের মধ্যে ছিল আট ফুট গভীর একটি কূপ।

এইচ আলিম: বণিক বার্তা প্রতিনিধি, বগুড়া


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]