সমতট ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পর্ক তালাশ

প্রকাশ: মে ২৮, ২০২৪

আহমেদ দীন রুমি

দশম-একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বিক্রমপুর থেকে তার তিব্বত যাওয়ার মহাকাব্যিক বর্ণনা বহুল পরিচিত। কিন্তু তারও আগে তিন ব্যবসায়ীদের জাহাজে উঠে গিয়েছিলেন সুমাত্রা। সেখানে চন্দ্রকীর্তি ও ধর্মকীর্তি নামে দুজনকে গ্রহণ করেন গুরু হিসেবে। অন্য পণ্ডিতদের সঙ্গেও মতবিনিময় হয় নিয়মিত। প্রায় ১২ বছর ধরে ধর্মকীর্তির কাছ থেকে সব ধরনের মহাযানী প্রশিক্ষণ লাভ করেন। বদলে যাওয়া অতীশ যখন ফেরেন, তখন সঙ্গে আনেন ধর্মকীর্তির রচিত সাতটি পাণ্ডুলিপি। অতীশের অধ্যবসায়ের পাশাপাশি এ ইতিহাস থেকে আরো একটা বিষয় প্রমাণিত হয়। সেটা হলো বাংলার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় যোগাযোগ।

প্রাচীন আমল থেকেই বঙ্গীয় জনপদ যুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপটির উপকূলে গড়ে উঠেছিল হরিকেল জনপদ। একদিকে হরিকেলের সঙ্গে আরাকানের স্থলপথে যোগাযোগ, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর হয়ে দীর্ঘ জলপথ। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দুই পথে তৈরি হয়েছে সংযোগ সেতু। আর সংযোগের বড় অধ্যায়জুড়েই বৌদ্ধ ধর্ম পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা। দশম শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম অবক্ষয়ের পথে হাঁটলেও বাংলা ও বিহারে টিকে ছিল দীর্ঘদিন। ৬০০ থেকে ১৩০০ সালের মধ্যে বাংলায় গড়ে উঠেছে নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ময়নামতির মতো বিহার। মূলত বৌদ্ধ ধর্মের এসব সুবর্ণভূমির সূত্র ধরেই সমতটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের জনপদগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিল ধর্ম ও বাণিজ্য দুদিক থেকেই। বাংলা, বিশেষ করে হরিকেল ও সমতট এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি। হিন্দু ধর্মে সমুদ্রযাত্রাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হতো, বৌদ্ধ ধর্মে সে বালাই ছিল না। ফলে তারা বাণিজ্য ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সফর হিসেবে জলপথে যাওয়া-আসা করতেন বেশি। সেসব বাণিজ্যপথ ধরেই এগিয়ে গেছে চিন্তাধারা ও শিল্প। দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যেই বৌদ্ধ ধর্মের স্বর্ণভূমিতে পরিণত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বিশেষ করে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড অঞ্চলে অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল বৌদ্ধ ধর্ম। দুই অঞ্চলের সংযুক্তি নিয়ে শিলালিপি পাওয়া যায়। মালয় উপদ্বীপে প্রাপ্ত বিখ্যাত শিলালিপি মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত শিলালিপির তারিখ পঞ্চম শতাব্দী বলে চিহ্নিত হয়েছে। 

পাল আমলে শ্রীলংকা থেরবাদী ও চীন মহাযানবাদী বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। দুই জায়গায়ই মূলত নৌ-বাণিজ্যের পথে অবস্থিত। ফলে সমতট ও হরিকেল অবশ্যই এর সঙ্গে যুক্ত থাকা স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন এ দুই অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধধর্ম আচরিত হয়ে এসেছে। হিউয়েন সাংয়ের দাবি অনুসারে, সমতটের সামনের মুখ বিশাল সমুদ্রের সামনে। সমতট নামের অর্থও উপকূলীয় সমতল অঞ্চল। হিউয়েন সাঙের মতে, সমতটের সঙ্গে যুক্ত ছিল মিয়ানমারের শ্রীক্ষেত্র, কমলঙ্ক ও ইরাবতী, দারাবতী (থাইল্যান্ড), মহাচম্পা (ভিয়েতনাম) ও জাভার সঙ্গে। সমতট ও হরিকেলের সঙ্গে সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন আরেক চীনা পর্যটক ইৎ সিংও। তিনি জাভা ও মালয় উপদ্বীপ থেকে হরিকেল পর্যন্ত জলপথের যোগাযোগ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। এদিকে চৈনিক ধর্মযাজক তান-কং ভারতে এসেছিলেন হরিকেল হয়ে।  আরবি ও ফারসি লেখায়ও এসেছে হরিকেল প্রসঙ্গ। নবম শতাব্দীর পারসিক পর্যটক সুলাইমান তাজিরের লেখা ‘সিলসিলাতুত তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে বাহর-ই হরকন্ডের কথা বলা হয়েছে। হরকন্ড নিশ্চিতভাবেই হরিকেল। দ্বাদশ শতাব্দীর পর্যটক আল ইদরিসির দাবি, সমন্দর একটা বড় শহর, যা বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ। তার আগে আরেক ঐতিহাসিক ইবনে খুরদাদবিহ সমন্দর নগরীর কথা উল্লেখ করেছেন। বর্ণনা থেকে অনুমিত হয় সমন্দর একটা প্রাচীন বন্দর ছিল। ঠিক কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ নবম শতাব্দীতে শ্রীবিজয় থেকে পাল দরবারে দূত প্রেরণ করা হয়। তখন পশ্চিম বাংলায় কোনো বন্দর ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এটা হবে সমন্দর বন্দর, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট ও হরিকেল অঞ্চলকে যুক্ত করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে।

মঠে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের ছবি ও মিনিয়েচার রাখাটা সে সময়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। শালবন বিহার ও ময়নামতিতে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেগুলো ছিল বিভিন্ন কক্ষে। ঐতিহাসিক সুচন্দ্রা ঘোষের দাবি, সেগুলো ছিল তীর্থযাত্রীদের উপঢৌকন। এমন ধরনের মিনিয়েচারের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব হিউয়েন সাংও আলোচনা করেছেন তার লেখায়। ময়নামতি থেকে প্রাপ্ত সে মিনিয়েচার ও ব্রোঞ্জের নিদর্শনের সঙ্গে থাইল্যান্ডে প্রাপ্ত নিদর্শনের অবিশ্বাস্য মিল। কুমিল্লার শালবন বিহারের একটা স্তূপ ও থাইল্যান্ডের খুহাফিমুক গুহার স্তূপের মধ্যে সাদৃশ্য বিস্ময়কর। একইভাবে ময়নামতির সঙ্গে জাভায় পাওয়া নিদর্শনেরও সাদৃশ্য ব্যাপক। গবেষকদের দাবি, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সঙ্গে জলপথে শক্তিশালী যোগাযোগ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। এ কারণেই কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের সঙ্গে জাভায় প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের নিদর্শনে সাদৃশ্য। উভয়েই ধারণ করে পাল আমলের বৈশিষ্ট্য। 

যদিও রামু ও চারপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এখনো সেভাবে হয়নি, তার পরও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসা যায়, চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের জনপদে নবম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবময় অধ্যায় ছিল। সমতটের বৌদ্ধ স্থাপনাগুলো নদীর খুব কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে জলপথই ছিল প্রধান অবলম্বন। সমতট থেকে জলপথে বেরিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে জাভা ও সুমাত্রা সফর করা হয়েছে নিয়মিত। এমনকি পড়াশোনার জন্যও যে যাওয়া-আসা ছিল, তা তো অতীশের জীবন থেকেই দেখা যায়। মিয়ানমারে প্রাপ্ত নবম শতাব্দীর ট্যাবলেটে মহাবোধি মন্দিরের রেপ্লিকা দেখা যায়, যা বাংলা আর বিহারের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রমাণ করে। এভাবে সমতটের সঙ্গে মিয়ানমারের কাওগুন, কিয়ানকু, পুগং ও তাগাউঙয়ের সাংস্কৃতিক লেনদেন ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। 

পুগং রাজা জয়সিঙ্কার রাজত্বকালে (১২১১-৩১ সাল) উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটে। তিনি পুগংয়ে মহাবোধি মন্দিরের রেপ্লিকা তৈরি করেন, যদিও সেগুলো ছোট ছিল। এই প্রতিরূপের জন্য কিন্তু বার্মিজ রাজারা সত্যিকার মহাবোধি মন্দিরকে শ্রদ্ধা করতে থমকে যাননি। এ শ্রদ্ধার পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বার্মিজ রাজাদের ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায় যে বোধগয়া উপহার পাঠানো আসলে তাদের রাজাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, যারা তাদের মর্যাদা ও অবস্থান নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তাই বোধগয়া মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে কোনো রাজার রাজদণ্ড চালনায় বৈধতার বিষয়টিও যুক্ত ছিল বলে মনে করা যায়। 

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পূজিত হতেন তারা। এ নিয়ে মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক রয়েছে, যাকে অষ্টম শতকের বলে চিহ্নিত করা যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, হরিকেল, কর্মরাবগা, কামরূপ ও কলসের এক প্রভাবশালী রাজা তারার উপাসনা করেন। আর হরিকেল বলতে চট্টগ্রাম ও সমতট বলতে কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানকার বৌদ্ধ নিদর্শনগুলোয় অন্যান্য উপাস্যের সঙ্গে তারাকেও দেখা যায়। ময়নামতির তামার পাতকে চিহ্নিত করা হয় ১২২০ সাল হিসেবে, সেখানে বলা হয়েছে হরিকেলরাজের মন্ত্রী ধাদি-এবা একখণ্ড জমি দিয়েছিলেন পত্তিকেরা পরগনায় দেবী তারার মন্দির তৈরির জন্য, জায়গাটি মূলত ময়নামতির কাছে অবস্থিত। তারা ছিল বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও আদৃত উপাস্য। একইভাবে মিয়ানমারের নিম্ন অঞ্চলেও পাওয়া যায় দেবী তারার স্বাক্ষর। যেহেতু আরাকানের সঙ্গে সমতট ও হরিকেলের সম্পর্ক ছিল গভীর, সে দৃষ্টিতে এমন সাংস্কৃতিক বিস্তার থাকা দুর্বোধ্য নয়। আরাকানে প্রাপ্ত আনন্দ প্রশস্তিতে সমতটের সঙ্গে তাদের সংযুক্তি স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছে। দক্ষিণ ত্রিপুরা ছিল প্রাচীন সমতটের অংশ। সম্প্রতি সেখানে খনন করে বৌদ্ধ স্থাপনা পাওয়া গেছে, তাছাড়া হরিকেল রাজ্যে ব্যবহৃত মুদ্রাও পাওয়া গেছে বেলুনিয়ার দিকে। সেদিক থেকেও যুক্ত হয় আরাকানের সঙ্গে। ত্রিপুরার পিলাক প্রাচীন আমল থেকেই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পিলাক দীর্ঘদিন ধরেই সমতটের সঙ্গে যুক্ত, তা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা থেকেই প্রমাণিত। ফলে ময়নামতির মতো পিলাক নিজেও সংযোগ সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। সেখানে প্রাপ্ত মোরালও সমতটের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এভাবে সমতটের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে সংযোগ, তা বাংলার জনপদের প্রাচীন ইতিহাসের ওপর ভিন্ন এক আলো ফেলে।

আহমেদ দীন রুমি: লেখক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]