আন্দালুসিয়ার এসক্লেপিয়াস

প্রকাশ: মার্চ ১৪, ২০২৩

মুহম্মদ আল মুখতাফি

জ্ঞানের কদর বুঝতেন খলিফা হাকাম। দামেস্ক, বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল, কায়রো কুফা থেকে কিনে আনা হতো বই। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতেই সংগ্রহের সংখ্যা ছিল লাখ। নিজে লিখেছেন ইতিহাস। দরবারে তারকার মতো জ্বলজ্বল করত মুয়াল্লাদ মুসলিম মোজারেব ক্যাথলিক পণ্ডিতেরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাগুলোর একটির নাম জাহরাভি। শুধু হাকামের দরবার না। আন্দালুসিয়ার গোটা ইতিহাসে জাহরাভি অনন্য। ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানে যেমন ইবনে খালদুন, দর্শনে যতটা ইবনে রুশদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে ঠিক ততটাই জাহরাভি। অবশ্য জাহরাভি তার নাম নয়, লকব। নাম আবুল কাসিম খালাফ ইবনে আব্বাস। কর্ডোবা থেকে আট কিলোমিটার দূরে জাহরা নগরীতে জন্ম। নগরীর সঙ্গে তার ইতিহাস যেন অভেদ। যে বছর আল জাহরা প্রতিষ্ঠিত হলো ঠিক সে বছরই ৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন জাহরাভি। আর যে বছর জাহরার পতন ঘটেছে, তার দুই বছরের মাথায় দুনিয়া থেকে নেন বিদায়। আরেকটি লকব আনসারি থেকে প্রতীয়মান হয়, তার পূর্বপুরুষের শেকড় মূলত মদিনায়। আরব উপদ্বীপ থেকে আন্দালুসিয়া বিজয়ে গিয়ে সেখানেই থিতু হয়েছেন। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পশ্চিমা দুনিয়া তাকে চিনেছে আলবুকাসিস হিসেবে। আবুল কাসিমের লাতিনকৃত রূপ।

আন্দালুসিয়া তখন বাস্তবিক অর্থেই স্বর্ণযুগ পার করছে। মাত্র কয়েক বছর আগেই ৯২৯ সালে কর্ডোবা আমিরাতকে খেলাফত রূপান্তর করেছেন তৃতীয় আবদুর রহমান। মুসলিম দুনিয়া দেখছে একই সময়ে তিনটি খেলাফত। বাগদাদে আব্বাসীয় খেলাফত, উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীয় খেলাফত স্পেনে উমাইয়া খেলাফত। বাকি দুই খেলাফতের রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছেন তৃতীয় আবদুর রহমান। সমৃদ্ধ করে চলেছেন রাজধানী নগরী জাহরার জৌলুস। খলিফা হিসেবে আবদুর রহমান শাসন করেছেন ৯৬১ সাল পর্যন্ত। তার পরে পুত্র হাকাম আধিপত্য অটুট রাখেন ৯৭৬ সাল পর্যন্ত। পিতা পুত্রউভয়ের আমলেই জ্ঞানচর্চায় প্রভূত পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। ইউরোপের বাতিঘর হিসেবে যে কর্ডোবার উদাহরণ সামনে পেশ করেন ঐতিহাসিকরা, তা মূলত আবদুর রহমান হাকামের আমল। আর পৃষ্ঠপোষকতার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ নিয়েছেন আবুল কাসিম আল জাহরাভি। জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে পার করেছেন কৈশোর তারুণ্য। তার সমসাময়িক পণ্ডিত ছিলেন ইবনে আল ওয়াফিদি আল মাজরিতি। প্রথম জন রসায়নে দ্বিতীয়জন জ্যোতির্বিদ্যার পুরোধাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। তবে জাহরাভির আকর্ষণ ছিল চিকিৎসাবিদ্যায়, বিশেষ করে শল্যচিকিৎসায়। গভীরভাবে পাঠ করেছেন গ্যালেন, হিপোক্রেটিস, পল প্রাচীন সব পথিকৃেদর। শনাক্ত করেছেন সনাতন চিকিৎসাবিদ্যার সীমাবদ্ধতা। পরিণত হয়েছেন খলিফা আবদুর রহমান হাকামের দরবারে প্রধান চিকিৎসকে। খলিফা হাশিমের সময়েও পেয়েছে দরবারি পৃষ্ঠপোষকতা।

জীবনের অধিকাংশ সময় জাহরাভি ব্যয় করেছেন কর্ডোবায়। সেখানেই এগিয়েছে পড়াশোনা চর্চা। জাহরাভি ভাষা, ব্যাকরণ, গণিত দর্শনের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেন। শাস্ত্রে মেধাবীদের উৎসাহিত করেন। আন্দালুসিয়ার স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। দুস্থ রোগীর সেবায় কর্ডোবাজুড়ে স্থাপিত হয় হাসপাতাল। জনগণের পরিচ্ছন্নতা স্বাস্থ্যসচেতনতা মাথায় রেখে নির্মিত হয় হাজারো হাম্মামখানা। রোগ নির্ণয়ে দক্ষতা পূর্বাপর করণীয় নির্ধারণের মুনশিয়ানা তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল আকাশছোঁয়া। রোগীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর বিবরণ টুকে রাখতেন তিনি। রোগের লক্ষণের পাশাপাশি তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও লিখতে শুরু করেন। এভাবে তৈরি হয় রোগীর জন্য প্রামাণিক সেবা দেয়ার ঐতিহ্য। দাঁত থেকে হাড়, তরুণ থেকে প্রসূতিশল্যবিদ্যার বিভিন্ন অঙ্গনে তার যাতায়াত ছিল বিস্ময়কর। ততদিনে চিকিৎসাবিদ্যার প্রাচীন কিতাবগুলোতে নানাভাবে বিকৃতি প্রবেশ করেছে। পুস্তকলেখকদের অদক্ষতায় দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে অনেক বিষয়। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হতে উত্সুক, এমন তরুণদের জন্য ব্যবহারিক নির্দেশনার অভাব দৃশ্যমান। সমাজে অভাব যোগ্য চিকিৎসকের। বিশেষ করে সার্জারিতে যেহেতু সামান্য ভুলেই ভয়াবহ পরিণাম নেমে আসে, সে জন্য ছাত্রদের নানাভাবে সতর্ক করেছেন তিনি। দেখানোর চেষ্টা করেছেন সমাধানের নতুন পথ। চিকিৎসাশাস্ত্রে তার অভিজ্ঞতা পাণ্ডিত্যের সাক্ষী কিতাব আত তাসরিফ লিমান আজিজা আনিত তালিফ। ত্রিশ খণ্ডে লিখিত চিকিৎসাবিদ্যার বিশ্বকোষ সমাপ্ত হয় ১০০০ সালে। রেনেসাঁ যুগের ইউরোপে শল্যচিকিৎসার যে অগ্রযাত্রা, তাতে তাসরিফ পঠিত হয়েছে প্রশ্নাতীত মেনে।

হাকামের মৃত্যুর পরই আন্দালুসিয়ার রাজনীতি ঘোলা হতে থাকে। কাগজে-কলমে মসনদে ছিলেন হিশাম। কিন্তু ক্ষমতার কলকাঠি নাড়িয়েছে হাজিব আল মানসুর তারপর আবদুল মালিক আল মুজাফফর। ১০০৮ সালে আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ নেয়। কর্ডোবা প্রবেশ করে গৃহযুদ্ধের মধ্যে। পতন ঘটে জাহরা নগরীর। তার ঠিক দুই বছর পর ১০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন জাহরাভি। পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপড়েন অগ্রসরমাণ ক্যাথলিক শক্তির সঙ্গে সংঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে স্বর্ণযুগের স্থাপনাগুলো। একই নিয়তি বরণ করেছে লাইব্রেরি। ফলে জাহরাভির ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানার উপায় নেই। প্রথমবারের মতো তার উল্লেখ পাওয়া যায় মুহাম্মদ ইবনে হাজমের (৯৯৩-১০৬৪) লেখায়। ইবনে হাজম তাকে আন্দালুসিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকদের একজন বলে অভিহিত করেছেন। আল হুমায়দি তার জাদওয়াতুল মুকতাবাসি ফি তারিখি উলামায়ি আল আন্দালুস গ্রন্থে তুলে ধরেছেন জাহরাভির সংক্ষিপ্ত জীবনী। কর্ডোবার স্বর্ণযুগে রাজকীয় শীর্ষ অবস্থানে থেকেও তিনি বিনয়ে গুটিয়ে রেখেছেন নিজেকে। সে সম্পর্কে ঈষৎ ধারণা পাওয়া যায় ১২৭১ সালে করা ওয়ালিউদ্দিনের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছেন, আমাকে বলা হয়েছে, জাহরাভি ছিলেন তীব্রভাবে দুনিয়াবিমুখ। প্রতিদিনের অর্ধেক কাজ তিনি করতেন কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়া। কেবল মানবসেবা হিসেবে।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে সরে গেছে আরব আধিপত্য। জাহরাভি হারিয়ে গেছেন এক হাজার বছরের বেশি। কিন্তু তার তাসরিফ পাঞ্জেরির মতো দিকনির্দেশ করেছে আধুনিক শল্যবিদ্যার ঐতিহ্যকে। তাসরিফ তাকে পরিণত করেছে পৌরাণিক পুরুষে। জাহরাভি যেন আন্দালুসিয়ার এসক্লেপিয়াস। যিনি সুস্থতা নিয়ে হাজির হতেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।  

 

মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক



সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]