শিরোনামের কবিতার
লাইনটি নজরুলের।
যে বেদুইন
হিসেবে তিনি
নিজেকে দেখেছেন
সে বন্ধনহীন,
জন্মস্বাধীন। রবীন্দ্রনাথও
হতে চেয়েছেন
আরব বেদুইন—‘চরণতলে
বিশাল মরু
দিগন্তে বিলীন।’
মরুভূমি
যত ঊষরই
হোক না
কেন, প্রাণের
স্পন্দন যুগ
যুগ ধরে
বেদুইন কবিরাই
ধরে রেখেছেন।
বেদুইন সাহিত্য
মূলত মুখে
মুখে রচিত
বংশপরম্পরায় হস্তান্তরিত
পঙিক্তমালার ইতিহাস।
এর একটি
উল্লেখযোগ্য অংশই
নারীর রচনা
কিংবা নারীকে
নিয়ে রচনা।
বেদুইন
জনগোষ্ঠী আরব
মরুভূমি, সুদান,
আলজেরিয়া, ইরাক,
জর্ডান, লিবিয়া,
সিরিয়া, ইসরায়েল,
মৌরিতানিয়া, ফিলিস্তিন
ও ইথিওপিয়ায়
ছড়িয়ে আছে।
তাদের মূল
পেশা উট
ও মেষ
পালন। তারা
রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক
সীমানাকে গুরুত্ব
দেয়নি। মরুর
তাঁবু ভেঙে
এক সুবহে
সাদিকে তারা
বেরিয়ে পড়ে
নতুন বাসস্থানের
সন্ধানে, যেখানে
পানি আছে,
কমবেশি চারণভূমি
আছে। ১৯
শতকেই যাযাবর
বেদুইনের সংখ্যা
কমতে থাকে।
তখন সৌদি
আরবের জনসংখ্যার
৪০ ভাগ
ছিল বেদুইন,
১৯৭০ সালে
তা নেমে
এসেছে ১১
ভাগে। এ
ক্রমহ্রাসমানতার ধারা
অব্যাহত রয়েছে।
প্রায় আট
হাজার বছরের
ইতিহাস ও
ঐতিহ্য বেদুইনরা
ধারণ করছে।
তারা স্থায়ী
ঘর বাঁধতে
চায়নি; অস্থায়ী
তাঁবু গড়েছে,
তাঁবু গুটিয়ে
চলে গেছে
ভিন্ন জনপদে।
গৃহী মানুষ
ও ভ্রাম্যমাণ
মানুষের সংস্কৃতির
মৌলিক ব্যবধান
অনেক। স্থিতিশীল
মানুষ গণতন্ত্রের
উপাসক, যাযাবরের
অর্থনীতি দিন
আনা দিন
খাওয়ার। আফ্রিকার
যাযাবররা মনে
করে, একটি
উট যতটুকু
সম্পদ বহন
করতে পারে,
একটি পরিবারের
জন্য তা-ই
যথেষ্ট। বেদুইন
সাহিত্যও গড়ে
উঠেছে পশু
পালন অর্থনীতি
ও কৃচ্ছ্রতা
ঘিরে।
বেদুইন কবি
ইবনে সুবায়িল
যার ইবনে
মিশারিকে উদ্দেশ
করে লিখেছেন:
যার এক
বছর পূর্ণ
হয়েছে, এ
পর্যন্ত
আমার হূদয়
কেবল অপচয়ই
করে গেলাম
নদীর দুপারে
সৃষ্টি সকল
শুকিয়ে আসে
তিক্ত আপেলও
শুকায়
দীর্ঘকাল খরার
পর যে
জলধারা নেমে
আসে
যখন বেদুইনরা
সমবেত হয়
তখনই
আমার হূদয়ের
বসন্তকাল
তাদের গ্রীষ্মকালীন
তাঁবু পর্যন্ত
কি উত্তেজনা
আমি বাজারের
পথে জনতার
উল্লাস দেখি।
সিরিয়ান
দামেস্ক শহরের
এক রাজপুত্র
মরুভূমিতে বিচরণকালে
অপরূপ সৌন্দর্যের
এক বেদুইন
তরুণীর দেখা
পায়। রাজকুমার
তার প্রেমের
পড়ে যায়।
তরুণীর বেদুইন
পিতার কাছে
রাজকুমার নিজেই
তার কন্যার
পাণিপ্রার্থী—এ
আবেদন জানায়
এবং বিয়ের
অনুমতি প্রার্থনা
করে। বেদুইন
বাবা সম্মতি
দেন। রাজকুমার
এ তরুণীকে
রাজকীয় সাজ
পরিয়ে দামেস্ক
প্রাসাদে নিয়ে
আসে। প্রাচুর্যে
ডুবে থাকা
বেদুইন কন্যাকে
রাজকুমারের সুখীই
মনে হয়।
কিন্তু একদিন
রাজকুমার যখন
প্রাসাদের বাইরে
পায়চারি করছিল
তার কানে
ভেসে আসে
স্ত্রীর গলায়
গান:
যে তাঁবুতে
মরুর বায়ু
প্রবাহিত হয়
সে যে
বিলাসী রাজপ্রাসাদের
চেয়ে ভালো
রাস্তায় ঘেউ
ঘেউ করা
কুকুরের ডাক
বিনীত বিড়ারের
সুরেলা মিউ
মিউর চেয়ে
ভালো
আবায়া-ঢাকা
মুখ আর
শান্তির ঘুম
শিকল পরা
জীবনের চেয়ে
ভালো
আস্ত রুটি
খাওয়ার চেয়ে
রুটির
একটি কেবল
টুকরো খাওয়া
অনেক ভালো।
রাজকুমারের
বোধোদয় হয়,
তাহলে তো
একটি মুক্ত
ও স্বাধীন
বেদুইন তরুণী
তার কারণে
দামেস্ক প্রাসাদে
বন্দি হয়ে
আছে। সে
তো তাকে
ভালোবাসে, সে
তার সুখ
চায়। সুতরাং
রাজকুমার রাজমহল
থেকে বের
করে তাকে
আবার মরুভূমিতে
নিয়ে এল।
রাজকুমার আরো
পোশাক, আরো
অলংকার, আরো
অনেক উট
উপহার দিয়ে
বাবার হেফাজতে
বেদুইন তরুণীকে
তার পূর্ব
জীবনে ফিরিয়ে
দিল আর
নিজেকে গুটিয়ে
নিল দামেস্কের
রাজমহলে। বেদুইন
কন্যার প্রেমে
পড়ার বহু
কাহিনী গল্প-কবিতা-গান-বেদুইন
সাহিত্যে ছড়িয়ে
আছে।
পানির
প্রবাহ ও
সবুজ ঘাস
অনুসরণ করে
বেদুইনরা মরুভূমির
এক প্রান্ত
থেকে অন্য
প্রান্তে চলে
যায়। বেদুইন
পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে
পরস্পরের প্রতি
শ্রদ্ধাশীল। এমনই
এক খ্যাতিমান
আল-মাহাদি
পরিবারে তিনজন
সুদর্শন কন্যা
ছিল। তাদের
মধ্যেও সুন্দরতম
মেয়েটি প্রতিবেশী
তরুণের প্রেমে
পড়ল। তরুণ
তাকে বিয়ে
করার ইচ্ছা
ব্যক্ত করলে
কন্যা মাকে
জানাল। কিন্তু
এটি তাদের
পরিবারের সম্মান
ক্ষুণ্ন করার
শামিল। পরিবারের
কর্তা আল-মাহাদি
তরুণের বাবাকে
খেলাচ্ছলে বলেন,
হয় এখানে
তুমি যাবে,
নয় আমি
থাকব। কিন্তু
দুজনের একসঙ্গে
থাকা চলবে
না। তরুণের
বাবা ছেলের
প্রেমের বিষয়টি
সম্পর্কে অবগত
ছিলেন না।
পরিস্থিতি বুঝতে
পেরে তরুণ
সেই অঞ্চল
ছেড়ে দূরে
কোথাও চলে
গেল। আল-মাহাদি
সম্মানিত বোধ
করলেন।
যে তরুণ তাকে এভাবে সম্মানিত করল, তিনিও তাকে আশীর্বাদ করার তাগিদ বোধ করে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তরুণের পিতার কাছে। তরুণের বাবা আল-মাহাদির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কারণ তিনি তরুণকে দীর্ঘকালীন অপরাধ বোধ থেকে মুক্ত করে নিজের মেয়েকে তার হাতে তুলে দিয়েছেন। বেদুইন পরিবারগুলোর পারস্পরিক সম্মানবোধ তাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি।
বেদুইন নারীর
কবিতা—‘নাবাতি’
প্রাক-ইসলামী
যুগের একটি
কবিতা:
আমার হূদয়
একটি নারী
বাজপাখি
সামনে ভাঙা
কিছু ডিম
ভেতরের হলুদটা
গায়েব হয়ে
গেছে
হে আমার
সাথী
দীর্ঘ চোখের
পাতার হরিণের
নিঠুর শিকারি
প্রতি রাতে
তার আবেগ
ফিরে আসে
হায় ঈশ্বর!
মরুপথ কি
অসমতল ও
অগম্য ছিল
না
বেপরোয়া আমি
ঝাঁপিয়ে পড়ব
টলতে টলতে
চলা সাপের
বিস্ময়
ভয়ংকর ধারালো
বিষদাঁত বসিয়ে
দেয়।
অজ্ঞাত বেদুইন
নারী নন,
তিনি এ
কালের বাকু
আল মারিয়াহ,
তার নাবাতিতে
উটের কথা
আছে, মোটরের
কথাও আছে:
তাঁবুর জন্য
বাসনা
রৌদ্রপক্ব ইস্টকের
বাড়ির পর
আমার বাসনা
ছড়ানো সাদা
উটের পাল
দেখি
আমার বাসনা
সদ্য ছুটে
যাওয়া মোটরের
সাথে
আমার দৃষ্টি
বাসনা পর্বতের
ওপারে সমতলে
যখন বেদুইন
যাযাবর মরুর
তাঁবু ছেড়ে
যায়,
অনুপস্থিত প্রিয়তম
আর স্মরণে
আসে না।
একজন স্বামী
তার স্ত্রীকে
দেয়া প্রতিশ্রুতি
পূরণে ব্যর্থ
হয়েছে। আট
বছর চলে
গেছে, তবু
স্ত্রীর কোলে
সন্তান এনে
দিতে পারেনি।
অন্য জাতির
হলে অশ্রুপাতই
হতো তার
উপশম। কিন্তু
বেদুইন নারী
খোলামেলাই বলছে:
সেই পুরুষের
কথা কী
বলব
যে কফির
পাত্র কিনল
আর হামানদিস্তা
কিন্তু আট
বছরেও কফির
দানা
গুঁড়ো করল
না—
হয় সে
পুরুষের মতো
আচরণ করুক
নতুবা এইসব
পাত্র ও
হামানদিস্তা
অন্য কোনো
পুরুষের ব্যবহারের
জন্য রেখে
যাক।
এ কবিতাটিই
ভিন্নভাবে লিখেছেন
কিংবা বলেছেন
ভিন্ন এক
বেদুইন নারী।
তার কবিতার
নাম ‘হে
আমার ভাই,
বসন্তকাল।’
ভীষণ ক্লান্ত
পর্যটক
ধাবমান ঘোড়াদের
নেতা
ধুলোকে অনুসরণ
করা ঘোড়া—
আমি তোমাদের
একজন পুরুষের
কথা জিজ্ঞেস
করি
তার কাছে
ছিল কফি
বানানোর মতো
হাতিয়ার
তবু আট
বছর পেরিয়ে
গেছে
একটি কফিদানাও
সে গুঁড়ো
করেনি।
অন্য সব
পুরুষের মতো
হয় সে
কফির পাত্রে
কিছু একটি
জ্বাল দিতে
থাকবে
অথবা এসব
হাতিয়ারের ব্যবহার
যে জানে
এমন কোনো
পুরুষের কাছে
তা তুলে
দেবে।
বেদুইন তরুণ
তার প্রেমের
প্রকাশ ঘটাতে
সনাতন বেদুইন
চিত্রকল্পের বাইরে
চলে আসে।
সালাম সাবাহ
জোবাইদাহ তার
অন্তরের সংক্ষুব্ধ
সমুদ্রের কথা
লিখছেন:
সালাম কথাগুলো
তার অন্তর
থেকে বলছে
আমার হূদয়ে বহু কিছুর তোলপাড় চলছে
আমার চুল
ধূসর হয়ে
এসেছে।
চক্ষু দিয়ে
আমাকে যে
সম্মোহিত করেছিল
আমি সেই
তরুণীল কাছে
যাওয়ার পথ
খুঁজছি
যেন সে
আমাকে ছুরিকাঘাতে
হত্যা করেছে
কিংবা বন্দুকের
গুলিতে
ভেঙে খান
খান আমার
হাড়গোড়
আমি আর
দাঁড়াতে পারছি
না।
আমার লালা
শুকিয়ে অম্লস্বাদের
হয়ে গেছে
আমার ঠোঁট
লেগে গেছে
আমি যদি
তোমাকে আমার
গোপন কথা
বলি—
তার চেয়ে
আমার মুখ
দেখেই লিখিত
সবকিছু পড়ে
নেবে
আমি ছোট
স্তনের সেই
মেয়েটিকে ভালোবাসি
চিত্রঘোটকীর মতো
সে ছুটে
বেড়ায়, ঘোড়ার
পালের সামনে
আমার ভালোবাসার
মেয়েটির মতো
আর কেউ
নেই
সবচেয়ে উঁচুতে
সবচেয়ে উজ্জ্বল
নক্ষত্র হয়ে
আছে সে।
হে প্রিয়তম
মুক্তিপণ হিসেবে
তোমাকে আমার
অবগুণ্ঠন তুলে
দিই
যদিও পুঁতির
দানা
কিছু হারিয়ে
গেছে
হারানো পুঁতির
কথা
আমার মনে
পড়ে যখন
আমাদের
তাঁবুর পেছনে
দেখা হয়েছিল
হে প্রিয়তম
রাখাল যেমন
তার উট
চোখে চোখে
রাখে
আমার চোখও
তোমাকে সেভাবে
প্রহরায় রেখেছে।
(কিসের
লজ্জা প্রেমিকের
কাছে—তার
জিম্মায় দিয়ে
দেবে নিজের
হিজাব। ঝুঁকিপূর্ণ
ছিল যদিও,
তবু তাঁবুর
পেছনের নির্জনতায়
তাদের মিলন
হয়েছে। অবগুণ্ঠন
থেকে ঝরে
পড়েছে বেশ
কয়েকটি পুঁতির
দানা। এক
দেখাতে এতই
পেয়েছে, পুঁতির
জন্য কোনো
আফসোস নেই।
কিন্তু আফসোস
তার আর
দেখা মিটছে
না—তার
দৃষ্টি খুঁজে
বেড়ায় আদিগন্ত
মরুভূমি—রাখালের
উদ্বেগ নিয়ে—প্রেমিক
ফিরে আসবে,
আসতেই হবে
তার দৃষ্টিসীমার
ভোতরে)
বেদুইন নারী
কেবল নিয়তিনির্ভর
হয়ে পুরুষকে
মেনে নেয়ার
জন্য জন্মগ্রহণ
করেনি। তার কবিতায়
যৌনতার বিবৃতিও
প্রকাশ পায়:
তুমি কেবল
তোমার তাঁবুর
ভেতর বসে
থাকো
মজে থাকো
সেখানেই
তাঁবু তোমার
মাথার ওপর
ভেঙে পড়ুক
আশা করি
আমি তোমার
কোনো সন্তান
ধারণ করব
না
কোনো শিশু
মরুভূমির তরুণ
ইঁদুরের
পেছন পেছন
ছুটবে না।
আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক