ইউনিভার্সিটির (বিশ্ববিদ্যালয়) জন্ম

প্রকাশ: আগস্ট ৩১, ২০১৮

শানজিদ অর্ণব

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি এসেছে মূলত মধ্যযুগে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, গ্রিক কিংবা রোমানদের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাদের বিভিন্ন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে আইন, তর্কশাস্ত্র, দর্শন নিয়ে উচ্চমানের আলোচনা হতো। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো স্থায়ী ও আনুষ্ঠানিক চেহারা ছিল না। সক্রেটিসের মতো শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নিয়েও বিদ্যার্থীরা কোনো সনদ পেত না। আজকের কোনো বিদ্যার্থী হয়তো সক্রেটিসের কাছে শিক্ষা নিলে সেটা বাইরের দুনিয়াকে দেখাতে চাইবেন আর সেজন্য দরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা সনদ। আমরা আজ যে ধরনের স্বীকৃতিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে অভ্যস্ত, সেগুলোর যাত্রা হয়েছিল দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে। নির্দিষ্ট অনুষদ, পরীক্ষা, সনদ— এসব বিষয়ে আমরা গ্রিস বা এথেন্স নয়, বরং প্যারিস ও বোলোনিয়ার উত্তরাধিকারী। প্যারিস বা বোলোনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজকের দিনের মতো গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, ছাত্র সংসদ, শিক্ষক সমিতি, স্থায়ী ভবন, আর্থিক সংস্থান— এসব কিছুই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা প্যারিস আর বোলোনিয়ার উত্তরসূরি। কারণ তাদের মূলনীতিটি আজকের দিনের মতোই ছিল এবং তাদের কর্মযজ্ঞও আজকের দিন পর্যন্ত কোনো বিরতি ছাড়া অব্যাহত আছে।

প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি এবং কে, কবে, কীভাবে এটি স্থাপন করেছিলেন, সেটা জানা দুরূহ। কারণও আছে। সে আমলে কোনো স্থাপনা ঠিক একটি নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা করল, এমনটা হতো না। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হতো, সময় নিয়ে গড়ে উঠত। আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাকে আপাতত দূরে রেখে উচ্চশিক্ষার যাত্রা ও বিকাশের পথে একবার তাকানো যাক। বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও প্রাচীনকালেই উচ্চশিক্ষা দানের জন্য এক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল প্রাচীন গ্রিসে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে এথেন্স, আলেকজান্দ্রিয়া ও কনস্ট্যানটিনপোলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে বৈরুত, বোর্দো, লিওতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। কিন্তু এরপর খ্রিস্টীয় অধ্যাত্মবাদ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বর্বরদের আক্রমণ এ উচ্চশিক্ষার ধারাকে ধ্বংস করে দেয়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মধ্যে এ ধারা ক্ষয়ে যায়। এরপর মাথা তোলে মুসলিমদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাগদাদ, বসরা, কায়রোসহ আশেপাশের এলাকাগুলোয় উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এ কেন্দ্রগুলো দ্বাদশ শতক নাগাদ শুকিয়ে যায়। এরপর পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমরা জ্ঞানচর্চার নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

১১০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় নতুন দিক উন্মোচিত হয়। একটি অংশ বিকশিত হয় সিসিলিতে, অন্যটি হয় স্পেনে মুসলিম দার্শনিকদের হাত ধরে। স্পেনে আরবদের হাত ধরে গ্রিক দর্শনের পুনর্জাগরণ ঘটে, কর্দোভা ছিল এই চর্চার কেন্দ্র। এছাড়া টলেডো ও সেভিয়ায় মুসলমানরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে কলাবিদ্যা ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হতো। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইউরোপ তাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকে। এবং এই সময়ই ইউরোপে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।

নেপলস থেকে দক্ষিণে একদিনের যাত্রাপথের দূরত্বে ছিল মেডিকেল ইউনিভার্সিটি অব সালের্নো। একাদশ শতকের মধ্যভাগে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী দুই শতকজুড়ে এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের চিকিৎসাশাস্ত্রের লেখাজোখা পুনরায় চর্চা শুরু করা হয় এবং অ্যানাটমি ও সার্জারি বিভাগে নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান উৎপাদন হয়। ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের আগে সালের্নোর গঠন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, চিকিৎসাশাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা বিকাশে সালের্নোর তেমন বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। এক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল বোলোনিয়ার। সালের্নো পরিচিত ছিল শুধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে, অন্যদিকে বোলোনিয়ার ছিল অনেকগুলো বিভাগ। বিশেষত রোমান আইনশাস্ত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে প্রাণ পায়।

বোলোনিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দে। ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বোলোনিয়ায় কয়েকশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে থাকে, এদের সবাই ইতালীয় ছিল না। আল্পস পর্বতমালা ছাড়িয়ে দূরের অঞ্চল থেকেও শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র হয়েছিল। নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরে এসে এ শিক্ষার্থীরা নিজেদের জ্ঞানচর্চা, পারস্পরিক সহযোগিতার চাহিদার ভিত্তিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্র হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ, অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এই একত্রিত হওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয় গঠন প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই ছিল। এ ধরনের আন্তর্জাতিক মিলন তখন ইতালিতে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। উচ্চশিক্ষার আগেই ইতালিতে বিভিন্ন পেশাজীবীদের গিল্ড তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে ইউনিভার্সিটি শব্দটি দিয়ে এ ধরনের সংগঠন, করপোরেশন বা দলকে বোঝাত। নির্দিষ্ট করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শব্দটির কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে একসময় ‘ইউনিভার্সিটি’ শব্দটি ছাত্র-শিক্ষক-উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জুড়ে যায়। ঐতিহাসিকভাবে ইউনিভার্সিটি শব্দটির সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বা শিক্ষার বিশ্বজনীনতার কোনো সম্পর্ক নেই। ইউনিভার্সিটি বলতে বোঝাত মূলত একটি দলকে, তা সে ছুতার মিস্ত্রি, নাপিত বা ছাত্র যাদেরই হোক না কেন।

এবার বোলোনিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রক্রিয়ার বিষয়ে অবগত হওয়া যাক। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের আজকের যে ধারণা, তার সঙ্গে বোলোনিয়ার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার কোনো মিলই নেই। বোলোনিয়ায় বসবাসরত শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটি বা তাদের দল গড়ে তুলেছিল শহরবাসীর লোভ ও আধিপত্য থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য। ঘরভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম শহরবাসী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো রাখার চেষ্টা করত। এ সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে ছাত্ররা জোট বেঁধে তাদের ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্থায়ী ভবন, ছাত্রাবাস ছিল না। তাই ছাত্ররা নিজেরা দল বাঁধার পর শহরবাসীকে হুমকি দিতে পারত যে ঘরভাড়া বাড়ালে তারা সবাই অন্যত্র গিয়ে বসবাস করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে নিয়ে যাবে। এ ধরনের অভিবাসন তখনকার দিনে দেখা যেত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অসন্তুষ্ট ছাত্র অন্যত্র গিয়ে ১২০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর ২০ বছর পর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসা একদল ছাত্রের মাধ্যমে লাভবান হয়েছিল অক্সফোর্ড। যা হোক, বোলোনিয়ার শিক্ষার্থীদের ওপর শহরবাসীর আধিপত্য খর্ব হয়। এবার শিক্ষার্থীদের ইউনিভার্সিটি বা সংঘ নজর দিল তাদের অধ্যাপকদের দিকে। অধ্যাপকদের জন্য নির্দিষ্ট আইন তৈরি করা হলো, যাতে ছাত্ররা পয়সা খরচ করার বিনিময়ে যথাযথভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অস্ত্র ছিল দল বেঁধে শিক্ষকদের বয়কট করা। আর শিক্ষকরা ছাত্রদের দেয়া বেতনের ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন, তাই হুমকিতে কাজ হলো। ১৩১৭ খ্রিস্টাব্দে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান থেকে জানা যায়, নিয়ম ছিল যে, কোন শিক্ষক ছুটি নেয়া ব্যতীত একদিনও অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না। কোনো কারণে তিনি শহরের বাইরে যেতে চাইলে তাকে জামানত জমা রেখে যেত হতো। যদি কোনো শিক্ষকের লেকচারে ন্যূনতম পাঁচজন শিক্ষার্থী উপস্থিত না হতো, তাহলে সেই শিক্ষককে অনুপস্থিত হিসেবে জরিমানা করা হতো। যে শিক্ষকের লেকচার শুনতে পাঁচজন শিক্ষার্থী আগ্রহ বোধ করে না, তাকে তো জরিমানা করাই উচিত! বোলোনিয়া ছিল শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়। বোলোনিয়ায় ছাত্রদের বেশ কয়েকটি ইউনিভার্সিটি বা সংঘ ছিল। এসব সংঘের সমন্বয় করতেন একজন রেক্টর। উল্লেখ্য, রেক্টর পদটি আজকের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচলিত আছে। সেকালের মতো আজকের দিনেও ইতালির শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিষয়ে জোরালো মতামত ও ভূমিকা রাখে। পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানোর দাবিতে পালেরমো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাংচুর করার ঘটনা জানা যায় কয়েক বছর আগেও।

বোলোনিয়ায় ছাত্ররা যেমন নিজেদের ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছিল, সেভাবে শিক্ষকরাও তাদের সংগঠন বা কলেজ গড়ে তুলেছিলেন। এ কলেজ পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র বাছাই করত। তখন শিক্ষা দেয়ার ক্ষমতাকে কোনো বিষয়ে কারো পাণ্ডিত্য পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হতো। শিক্ষার্থীরা অধ্যাপনা করার লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করত। শিক্ষকতার এ লাইসেন্সকেই বলা যায় দুনিয়ার প্রথম অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি। আমাদের আজকের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো ডিগ্রির নামের ক্ষেত্রে এ ঐতিহ্য বহন করে চলেছে— মাস্টার ও ডক্টর। মাস্টার অব আর্টস বলতে বোঝানো হতো, এ ডিগ্রিধারী কলাবিদ্যা শিক্ষাদানের উপযুক্ত। ডক্টর অব ল মানে তিনি আইনবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য উপযুক্ত মানুষ। এভাবে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি, রেক্টরের মতো পদ ও ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব দেখা যায়, যার সবই আজকের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন, ধর্মতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত হতে থাকে। তবে তাদের মূল মনোযোগ ছিল আইনশাস্ত্রে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বোলোনিয়ার আদলে এসব দেশে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বোলোনিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১২৪৪ সালে দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ ইউনিভার্সিটি অব নেপলস প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে বোলোনিয়ার একটি অংশ আলাদা হয়ে প্রতিষ্ঠা করে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বোলোনিয়া ও পাদুয়ার মধ্যে সেই থেকে শুরু করে এক ধরনের রেষারেষি উনিশ শতকেও টিকে ছিল।

উত্তর ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব খুঁজতে যেতে হবে প্যারিসের নটর ডেমের ক্যাথেড্রাল স্কুলে। দ্বাদশ শতকের শুরু থেকেই ফ্রান্স ও সংলগ্ন অঞ্চলে শিক্ষা দান বিষয়টি গির্জার হাত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে এবং সংলগ্ন স্কুলগুলো গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নটর ডেম ক্যাথেড্রাল স্কুল ঠিক কত তারিখে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হয়েছিল, তা জানা যায় না। তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই দ্বাদশ শতকের সমাপ্তির আগেই ঘটেছিল। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য নির্দিষ্ট দিন-তারিখ প্রয়োজন হয়। তাই ১২০০ খ্রিস্টাব্দকেই ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের প্রতিষ্ঠাসাল হিসেবে গণ্য করা হয়। সে বছরই এ বিশ্ববিদ্যালয় রয়াল চার্টার পেয়েছিল। এ চার্টারের মাধ্যমে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের শিক্ষার্থীরা বিশেষ কিছু রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়া শুরু করে। ১২৩১ সাল নাগাদ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টারদের একটি সংগঠিত করপোরেশন হয়ে ওঠে, যা বোলোনিয়ার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়। এ সময় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি অনুষদ ছিল— কলাবিদ্যা, আইন, চিকিৎসা ও ধর্মতত্ত্ব। অন্যদের চেয়ে কলা বিভাগেই মাস্টার ডিগ্রি পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল বেশি। এ ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ছিল মোট চারটি জাতিতে বিভক্ত— ফরাসি, এদের মধ্যে লাতিনভাষীরাও অন্তর্ভুক্ত হতো; নরম্যান, পিকার্ড ও ইংরেজ।&dquote;&dquote;

দ্বাদশ শতকের প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। এগুলোকে বলা হতো কলেজ। এদের কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। এসব কলেজে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে কলেজগুলোতেও শিক্ষা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো এবং তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ভবন ও অর্থিক ফান্ড না থাকলেও কলেজগুলোর সেসব সুবিধা শুরু থেকেই ছিল। ১১৮০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে কলেজ ছিল একটি। ১৫০০ সাল নাগাদ কলেজের সংখ্যা বেড়ে হয় ৬৮। ইউরোপের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও এমন কলেজ ছিল যেমন— বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল কলেজ অব স্পেন।

এ কলেজ সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ বাহক হলো অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোই সত্যিকার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, শিক্ষার ব্যবস্থা করে। বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেয়া ও সনদ দানের কাজ করত।

মধ্যযুগে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত আর সেকালে ধর্মতত্ত্বই ছিল সবচেয়ে দামি বিষয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও প্যারিস বিশেষ মর্যাদা পেত। তখন প্রচলিত ছিল, ‘ইতালির আছে পোপ, জার্মানদের আছে সাম্রাজ্য আর ফরাসিদের আছে শিক্ষা।’ এবার প্যারিস হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল। ১২ শতকের শেষভাগে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালের একটি অংশই প্রতিষ্ঠা করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এর কিছুদিন পর যাত্রা করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই চতুর্দশ শতকের আগে নয়। মধ্যযুগের শেষভাগ নাগাদ ইউরোপজুড়ে ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকগুলো কয়েক শতকেই হারিয়ে গেছে আবার কতগুলো আজো দুনিয়ায় টিকে আছে; টিকে আছে বললে ভুল হবে, বলা উচিত দুনিয়াকে আলোকিত করে চলেছে।

মধ্যযুগের সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছে? অবশ্যই স্থাপত্য নয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাথমিককালে কোনো নিজস্ব ভবনই ছিল না। চতুর্দশ শতকের আগে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহার করা কোনো ভবনেরই আজ চিহ্ন নেই। ক্যামব্রিজের সবচেয়ে প্রাচীন কলেজ হচ্ছে পিটারসন। এই পিটারসন কলেজের প্রাথমিক ভবনের কিছু ধ্বংসাবশেষই আজ কেবল খুঁজে পাওয়া যাবে। নির্দিষ্ট সময়ে মেপে পরীক্ষা নেয়ার পদ্ধতিটি এখনো টিকে আছে, তবে সেকালে পরীক্ষা নেয়া হতো বালিঘড়ি ব্যবহার করে আর এখন তো আধুনিক ঘড়িই আছে। মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় ‘ইউনিভার্সিটি’ শব্দটি। সে সময় ইউনিভার্সিটি বলতে ছিল একদল মাস্টারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষা ব্যবস্থা বা সংগঠন। এরপর আসে নির্দিষ্ট কারিকুলাম, নির্দিষ্ট সময়, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং শেষমেশ একটি সনদের স্বীকৃতি। এরপর আছে নির্দিষ্ট অনুষদ, ডিন, চ্যান্সেলর, রেক্টরের মতো পদের প্রচলন। কলেজগুলো দেখিয়েছে ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি এসব ব্যবস্থা কোনো ছেদ ব্যতীত সেই মধ্যযুগে থেকে এখনো বহন করে চলেছে।

দুনিয়ার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটি আজো টিকে আছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে যে প্রতিষ্ঠানের নাম নিতে হবে, তা হলো আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অনুযায়ী এখনো টিকে থাকা দুনিয়ার প্রাচীনতম শিক্ষাকেন্দ্রের নাম মরক্কোর আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। একে অনেকে আজকের দুনিয়ায় টিকে থাকা প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর ‘স্রষ্টাই আমার আলো’ আদর্শ নিয়ে পশ্চিমের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করে ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে।

৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আল-কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মরক্কোর বিখ্যাত ফেজ নগরে এর অবস্থান। দুনিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বহন করার পাশাপাশি আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় জড়িয়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন নারী। সে যুগে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তের সংস্কৃতির বিচারেই এটি একটি বিরাট ঘটনা। সেই নারী মনীষার নাম ফাতিমা আল ফিহরি। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ আল ফিহরি নামে একজন ধনী বণিকের সন্তান। ফিহরি পরিবার তিউনিসিয়া থেকে মরক্কোর ফেজে চলে আসে। ফেজ তখন আরবের সমৃদ্ধ, গতিশীল এক কেন্দ্র। ফাতিমা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা, স্বামী ও ভাইকে হারান। একদিকে বিপুল শোক, অন্যদিকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ও তার বোন মরিয়ম তখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। দুই বোনই আদর্শ শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং তারা ছিলেন আন্তরিকভাবে ধার্মিক। তাই তারা তাদের পুরো সম্পদ সমাজের কল্যাণে দান করে দিয়েছিলেন। ফেজের স্থানীয় মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না দেখে মরিয়ম ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে গ্র্যান্ড আন্দালুসিয়ান মসজিদ নির্মাণ করান। ফাতিমাও তার ভাগের অর্থের পুরোটা ব্যয় করেন একটি মসজিদ নির্মাণে। মসজিদটি কেবল নামাজ পড়ার জায়গা হয়েই থাকেনি, সঙ্গে সঙ্গে তা ধর্মীয় নির্দেশনা স্থির করা এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ও শিক্ষামূলক আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এটিই হয়ে ওঠে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়। এটিই দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্বাবিদ্যালয়, যা এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ স্থাপনা নির্মাণে ফাতিমা পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্বাবধান করেছিলেন। তাছাড়া প্রাথমিকভাবে তৈরি মসজিদটির সঙ্গে আরো জমি কিনে এর এলাকা বৃদ্ধি করেছিলেন। ফাতিমা তার সমস্ত সম্পদ ও অর্থ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করেছিলেন। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের রমজানে মসজিদের কাজ শুরু হওয়া থেকে তিনি রোজা রাখতেন এবং দুই বছর পর কাজ শেষ না হওয়া অবধি তিনি রোজা রেখে গেছেন। কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি সেই মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করেছিলেন।&dquote;&dquote;

আল-কারাউইন মসজিদ আজ যে রূপে দাঁড়িয়ে আছে, তা ১১০০ বছরের বিবর্তনের ফসল। মূল মসজিদটি ছিল ৩০ মিটার লম্বা। মসজিদটির প্রথম সম্প্রসারণ হয়েছিল ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে, উমাইয়া খলিফা কর্দোবার তৃতীয় আবদ-আর-রহমান। এরপর পরবর্তী শাসকরা আল-কারাউইন মসজিদ সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখেন। একসময় এটি আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদে পরিণত হয়, যার ধারণক্ষমতা ছিল ২২ হাজারজন। সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণের কাজটি হয়েছিল ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে, আলমোরাভিদ শাসক সুলতান আলি ইবন ইউসুফের অধীনে। তখন এ মসজিদে স্তম্ভবেষ্টিত ১৮টি গলি ছিল, ইউসুফ সেটা ২১-এ উন্নীত করেন। পুরো মসজিদের আয়তন তিন হাজার বর্গমিটারের বেশি বিস্তৃত হয়।

মধ্যযুগে আরব ও ইউরোপের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান আদান-প্রদানের একটি কেন্দ্র ছিল আল-কারাউইন। চতুর্দশ শতকে মিসর ও মাগরেবের চার হাজার শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। এখানে শিক্ষক নিয়োগের অধিকার ছিল সুলতানের। মরক্কোর গভর্নর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখাশোনা করতেন। এখানে শিক্ষার্থীরাই তাদের শিক্ষক এবং পাঠ্যক্রম বেছে নিত। ইবনে খালদুন এবং অনেক ইউরোপীয় বিজ্ঞানী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। 

আল-কারাউইনে একটি অভাবনীয় রীতি ছিল। বসন্তের শুরুতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে এক সপ্তাহের জন্য গভর্নর নির্বাচন করত। এ গভর্নর সুলতানের সঙ্গে ১ ঘণ্টার জন্য সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন। এ ছাত্র গভর্নর কোনো প্রকার ভীতি ছাড়াই সম্রাটের সঙ্গে রাজনীতি ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করতেন।

আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা, যুক্তিবিদ্যা, ওষুধশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে কোরআন ও ফিকাহশাস্ত্র শেখানো হতো। চতুর্দশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আল-কারাউইন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে। এখানে ইসলামী দুনিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। মরক্কোয় একটি প্রবাদ আছে, ‘বই ছাড়া একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির অবস্থা যন্ত্রপাতি ছাড়া একজন কারিগরের মতো।’ বহুকাল ধরেই মরক্কোর জ্ঞানী মানুষরা ফেজের এই আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ছুটে এসেছেন। এখানে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান। এখানে সংরক্ষিত আছে নবম শতকের কোরআনের পাণ্ডুলিপি এবং দশম শতকে লেখা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীগ্রন্থ। আরো আছে বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাশাস্ত্র-সংক্রান্ত বই। ইমাম মালিক কর্তৃক হরিণের চামড়ায় উত্কীর্ণ হাদিস সংকলন, ইবনে খালদুনের কিতাবুল ইবারের প্রাথমিককালের একটি প্রতিলিপিও আছে এ লাইব্রেরির সংগ্রহে। গত বছর এ গ্রন্থাগার সংস্কার করা হয়েছে।

১৯১২ সালে ফরাসিরা মরক্কো দখল করে। আল-কারাউইনের পণ্ডিতরা এ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ফরাসি দখলদাররা তাই আল-কারাউইনকে ‘ডার্ক হাউজ’ বলে সম্বোধন করত। ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব আল-কারাউইনের গুরুত্ব কমিয়ে দিল। ১৯২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০তে নেমে আসে। মরক্কোর অভিজাতরা পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে সন্তানদের পাঠাতে লাগল। ১৯৪৭ সালে আল-কারাউইন রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। মরক্কো স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আল-কারাউইন একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। মসজিদভিত্তিক স্কুল বন্ধ করে ফরাসি সেনাদের সাবেক ব্যারাকে নতুন ক্যাম্পাস তৈরি করা হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আধুনিক কারিকুলাম, টেক্সটবুক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব সংস্কারের পর ১৯৬৫ সালে আল-কারাউইন ‘ইউনিভার্সিটি অব আল-কারায়ুইন’ নাম গ্রহণ করে। ইবনে খালদুন, লিও আফ্রিকানাস, মুহাম্মদ আল-ফাসির মতো বিখ্যাত অনেক নাম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ভূগোলবিদ মোহাম্মদ আল-ইদরিসি আল-কারয়ুইনের ছাত্র ছিলেন।

ইউরোপ ও আরব থেকে এবার দেখা যাক ভারতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগেই ভারতবর্ষে রচিত হয়েছিল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এই একটি গ্রন্থ সে আমলের ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চার বিকশিত রূপকে নির্দেশ করে। আলেকজান্দ্রিয়া, এথেন্স কিংবা কনস্ট্যানটিনপোলের আগেই ভারতে ছিল সমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যা তক্ষশীলা নামে দুনিয়ায় বিখ্যাত। এছাড়া নালন্দা ও বিক্রমশীলাও ভারতবর্ষের দুটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। আবার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আজকের দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না।

ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তক্ষশীলা। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দেই শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এর অর্থ সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম নিঃসন্দেহে আরো শ-খানেক বছর আগেই শুরু হয়েছিল। তক্ষশীলা নামটি এসেছিল ভরতের পুত্র তক্ষের নাম থেকে। তক্ষশীলার অবস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পেয়েছেন সিন্ধু নদের ৫৫ মাইল পূর্বদিকে, যা বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত। তক্ষশীলা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। কারণ এখানে বিভিন্ন বিষয়ের সেরা পণ্ডিতরা বাস করতেন। এ শিক্ষকদের পাণ্ডিত্য উপমহাদেশের দূরতম প্রান্ত থেকে বিদ্যার্থীদের আকর্ষণ করত। বিদ্যার্থীরা দারুণ প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে তক্ষশীলায় শিক্ষাগ্রহণ করতে আসত। এখানে কোনো কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন ছিল না— না ছিল রাজার আদেশ, না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এখানে একেকজন পণ্ডিত ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাদান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মে তিনি ছিলেন পূর্ণ স্বাধীন। শিক্ষকই তার কোর্সের পাঠ্য, সময় নির্ধারণ করতেন; ছাত্র বাছাই করার স্বাধীনতা তার। প্রতিদিন তার ছাত্ররা কী শিখবে সেটা শিক্ষকই নির্ধারণ করতেন। শিক্ষক তখনই তার শিক্ষাদান শেষ করতেন যখন তার মনে হতো বিদ্যার্থী সত্য সত্যই বিদ্যা অর্জন করতে পেরেছে। সাধারণত কোনো শিক্ষকের বিদ্যা ছাত্রকে শেখাতে আট বছর সময় লাগত। ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক মান অনুসারে এ সময় কমবেশি হতে পারত। আবার অনেক সময় শিক্ষকরা যদি মনে করতেন যে কোনো ছাত্র বিদ্যা অর্জনে যোগ্য নয়, তাহলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। শিক্ষকরা ক্লাস নিতেন সাধারণত তাদের বাড়িতেই। শিক্ষা সমাপ্তির জন্য কোনো পরীক্ষা হতো না। শিক্ষাগ্রহণ শেষে কোনো আনুষ্ঠানিক সনদ দেয়া হতো না বা কোনো সমাবর্তনও হতো না। পরীক্ষাকে তক্ষশীলায় অনাবশ্যক বিবেচনা করা হতো। কারণ শিক্ষকরা সমালোচনা, বিশ্লেষণী পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতেন। একটি অংশ ছাত্র পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পেরেছে, এটা নিশ্চিত হলেই কেবল পরবর্তী ধাপের শিক্ষা দেয়া হতো। শিক্ষা অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো লিখিত সনদ দেয়া হতো না। কারণ তক্ষশীলায় বিশ্বাস করা হতো অর্জিত জ্ঞানই বিদ্যার্থীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। জ্ঞানকে রুজি-রুটি, আয়ের উপায় বা কোনো স্বার্থ উদ্ধারের কাজে লাগানোকে অপবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

তক্ষশীলা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও এটাই ছিল আজকের যুগের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ ও বিশেষায়িত শিক্ষা কেন্দ্র। সেকালে ভারতবর্ষের শিক্ষা পদ্ধতির দিকে নজর দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতো ঘরেই। এরপর তারা যেত আশ্রমে, যা আজকের দিনের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা। এর পরই আসত উচ্চশিক্ষার প্রশ্ন এবং সেটা অর্জনে যেতে হতো তক্ষশীলার মতো প্রতিষ্ঠানে। সে আমলে ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের বয়স ছিল আট বছর পর্যন্ত। এরপর ১২ বা তার চেয়ে কয়েক বছর বেশি ছিল মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের সময়কাল। সাধারণত শিক্ষার্থীরা যখন তক্ষশীলায় আসত তখন তাদের বয়স হতো ১৬ থেকে ২০ বছর। প্রায় আট বছরের জন্য ঘরের সন্তানকে দূর দেশে পাঠানো সেকালের বিবেচনায় পরিবারগুলোর জন্য ছিল এক বিরাট উৎসর্গ। এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অন্যদিকে তক্ষশীলায় পৌঁছতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো, সেকালে পথে থাকত নানা প্রতিকূলতা এবং বিপদ। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, সেকালে বেনারস, মিথিলা, উজ্জয়িনী, কোসালা, রাজগড়, মধ্য দেশ এবং উত্তর ভারতের কুরু রাজ্য থেকে শিক্ষার্থীরা তক্ষশীলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যেত। তক্ষশীলা তখন সে আমলে ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী।

তক্ষশীলার শিক্ষা ছিল মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত— বেদ ও শিল্প। বেদ ছিল ধর্মীয় শিক্ষা। আর শিল্প বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল যুক্তিবিদ্যা, ঔষধশাস্ত্র, গণিত, সংগীত, কাব্য, ইতিহাস, সামরিক বিজ্ঞান, কৃষি, পশুপালন, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি। তক্ষশীলা ছিল বৈদিক সংস্কৃতির শক্তিশালী কেন্দ্র। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষের পূর্বাংশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটে। ফলে তক্ষশীলায় অনেক বৌদ্ধ শিক্ষার্থীর আগমন শুরু হয়। ফলে বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষাও তক্ষশীলার পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

তক্ষশীলার শিক্ষকদের ব্যয়ভার বহন করত সমাজ। আর শিক্ষক তার সব ছাত্রের জন্য আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা করতেন। অন্যদিকে এসবের জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কোনো ধরনের ফি দিতে হতো না। ফি না দেয়ার কারণে কোনো শিক্ষার্থীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো না। বরং শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাধ্যতামূলক ফি দেয়ার ব্যবস্থাকে ঘৃণা করা হতো। কারণ জ্ঞানকে পবিত্র বিবেচনা করা হতো আর তাই অর্থমূল্যে এর বিতরণ পাপ ছিল। হিন্দু শাস্ত্রের শিক্ষাদানের প্রতিদানে অর্থ নেয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। মনুস্মৃতিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সমাজের ধনীরা জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করতেন। আবার শিক্ষার্থীদের ধনী অভিভাবকরাও দান করতেন। এ দান করতে হতো তাদের সন্তান ভর্তি হওয়ার সময় নয়তো তাদের শিক্ষা গ্রহণ শেষ হওয়ার পর। আর এ দানের বিনিময়ে তাদের সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো বিশেষ সুবিধা পেত না।

তক্ষশীলার শিক্ষার্থী ভর্তির কিছু নিয়ম ছিল— সব বর্ণের সন্তানই এখানে ভর্তি হতে পারত কিন্তু চণ্ডাল সম্প্রদায় এ প্রতিষ্ঠানে জায়গা পেত না। ছাত্র কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চায়, সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত। বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিণি এবং অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা চাণক্য বা কৌটিল্য তক্ষশীলার ছাত্র ছিলেন। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসক জীভাকাও তক্ষশীলার ছাত্র ছিলেন।

উনিশ ও বিশ শতকে ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন তাদের এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। বিশ শতকে এসব উপনিবেশের অনেকগুলো স্বাধীনতা অর্জন করে। এসব স্বাধীন দেশ ইউরোপীয় ও আমেরিকান মডেলেই তাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক তহবিলের সাহায্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বিকশিত হতে থাকে। শিল্পবিপ্লবের পর বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন অতীতে যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। জ্ঞান হয়ে ওঠে জীবীকা অর্জনের উপায়। ফলে ইউরোপের সার্টিফিকেট ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় মডেল দুনিয়াতে প্রয়োজনের ভিত্তিতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতিতে সনদ ভিত্তিক উচ্চশিক্ষার চর্চা সেভাবে ছিল না। এই পদ্ধতি ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উদ্ভব ঘটেছিল। এবং শিল্পনির্ভর বর্তমান সমাজে তা নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

সূত্র :

চার্লস হোমার হাসকিনস, দ্য রাইজ অব ইউনিভার্সিটিজ

ডি. জি আপ্তে, ইউনিভার্সিটিজ ইন অ্যানশিয়েন্ট ইন্ডিয়া


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]