সুবর্ণভূমি বা
সুবর্ণ দ্বীপের
অবস্থান ছিল
সুদূর পূর্বে,
যাকে বলা
হতো land of gold
বা স্বর্ণের
দেশ। সে
দেশ প্রচুর
সোনাদানা ও
মূল্যবান খনিজ
উপাদানে ভরপুর
এবং এ
দেশের হাতছানিই
প্রাচীন ভারতীয়
ব্যবসায়ী ও
বণিকদের মনোযোগ
কেড়ে নিয়েছিল
এবং নিজেদের
সীমানা অতিক্রম
করে বাণিজ্য
অভিযাত্রা চালাতে
আগ্রহী করে
তুলেছিল। পূর্বে
অবস্থিত পাহাড়-পর্বত
আর সমুদ্রের
জলসীমা ছাড়িয়ে
অবস্থান করা
এ দূরবর্তী
দেশ ও
দ্বীপগুলো মসলার
জন্যও সুখ্যাত
ছিল, যা
এ অঞ্চলের
প্রতি ভারতীয়
ব্যবসায়ীদের আকর্ষণকে
আরো বাড়িয়ে
তোলে। এ
মসলাই নবম
ও দশম
শতাব্দীতে আরবদের
এবং পঞ্চদশ
শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের
বহুল আকাঙ্ক্ষিত
দ্রব্যে পরিণত
হয়।
সুদূর পূর্বাঞ্চলকে
মোটা দাগে
দুই ভাগে
ভাগ করা
যায়—ইন্দো
চায়নিজ উপদ্বীপ
ও ইস্ট
ইন্ডিজ। ইন্দো
চায়নিজ উপদ্বীপ
অঞ্চলে আছে
আধুনিক মিয়ানমার,
থাইল্যান্ড, মালয়
উপদ্বীপ, কম্বোডিয়া,
লাওস ও
ভিয়েতনাম। আর
ইস্ট ইন্ডিজে
আছে ভারতীয়
দ্বীপপুঞ্জ, মালয়
দ্বীপপুঞ্জ। অংশটি
প্রায় ছয়
হাজার দ্বীপ
নিয়ে গঠিত।
এগুলোর মধ্যে
আছে সুমাত্রা,
বালি, জাভা,
লোম্বোক, বোর্নিও,
সেলেবেস, নিউগিনি,
ফিলিপাইন।
মানচিত্রের দিকে
তাকালে দেখা
যায় দক্ষিণ
চীন সাগর
ইন্দো চায়নিজ
উপদ্বীপ অঞ্চলকে
ইস্ট ইন্ডজের
দ্বীপপুঞ্জ থেকে
আলাদা করেছে।
প্রাচীন ভারতীয়রা
এ উপদ্বীপ
ও দ্বীপপুঞ্জ
অঞ্চলকেই বলত
সুবর্ণভূমি, যেখানে
মালয় উপদ্বীপ
বিশেষভাবে পরিচিত
ছিল সুবর্ণদ্বীপ
হিসেবে, যার
মানে দাঁড়ায়
স্বর্ণের দেশ
(আক্ষরিক ও
রূপক দুই
অর্থেই)।
সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে যারা এ অঞ্চলে গিয়েছে, তাদের অনেকেই ওই অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে পরিণয়বদ্ধ হয়ে পাকাপাকিভাবে সেখানেই বাস করতে শুরু করে। ভারতীয় রাজপুত্ররা অনেকে সেখানে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ দুই ধরনের ঘটনাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজগুলোয় ব্যাপক হারে ভারতীয়করণ ঘটিয়েছিল। ফলে শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতির হাত ধরে অঞ্চলগুলোয় বিস্তার ঘটেছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম এবং দর্শনের। মালয় উপদ্বীপে এ রকম একটি রাজ্যের বর্ণনা পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক তুয়েন সাইয়ের বর্ণনায়। তিনি সেখানে ৫০০ বণিক পরিবার, ২০০ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং কয়েক হাজার ব্রাহ্মণের স্থায়ী বসবাসের উল্লেখ করেছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে ভারতীয়দের বিয়ের কথাও জানা যায় তার বিবরণীতে।
সম্পদ আর
নতুন দেশের
খোঁজে প্রাচীন
ভারতীয়দের সুবর্ণভূমিতে
যাত্রা সংগঠিত
হতো সমুদ্রপথে।
তাম্রলিপ্তিতে ছিল
বিখ্যাত বন্দর।
এখান থেকে
জাহাজ বাংলা
ও বার্মার
উপকূল ধরে
বঙ্গোপসাগর অতিক্রম
করে মালয়
উপদ্বীপ ও
সংলগ্ন অঞ্চলে
চলে যেত।
উড়িশা ও
মসুলিপট্টম থেকে
নিয়মিত জাহাজ
যেত দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায়।
জাভার সাহিত্যে
পাওয়া যায়
কীভাবে কলিঙ্গের
হিন্দুরা সে
দ্বীপে রাজ্য
গড়ে তুলেছিল।
এ রকম
বিবরণী সংলগ্ন
অন্যান্য দ্বীপেও
পাওয়া যায়।
জাভার বিবরণীতে
আছে ৭৫
খ্রিস্টাব্দে এক
গুজরাটি শাহজাদা
সেখানে তার
রাজ্য গড়ে
তুলেছিলেন। এসব
বিবরণী থেকে
বোঝা যায়
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের
বিভিন্ন অঞ্চল
থেকে মানুষ
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় সমুদ্রপথে
যাতায়াত করত।
মিয়ানমারের স্থানীয়
ঐতিহ্য অনুসারে
এটা বিশ্বাস
করা হয়
যে গৌতম
বুদ্ধের জন্মের
বহু আগে
কপিলাবস্তুর একজন
শাক্য প্রধান
এখানে এসেছিলেন
এবং মিয়ানমারের
কেন্দ্রীয় অঞ্চলে
তার রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,
যা কিনা
৩১ প্রজন্ম
পর্যন্ত টিকে
ছিল। পরবর্তী
সময়ে যখন
শাক্য প্রধানের
পরিবারের আধিপত্য
সমাপ্তির দিকে
চলে এসেছিল,
সে সময়
সেখানে গাঙ্গেয়
সমভূমি থেকে
ক্ষত্রিয়দের একটি
দল পৌঁছে।
এ দলের
প্রধান শাক্য
উপজাতির সর্বশেষ
রাজার বিধবা
পত্নীকে বিয়ে
করেন এবং
মিয়ানমারে (Upper
Myanma) নিজের
রাজ্য প্রতিষ্ঠা
করেন। আরাকানের
স্থানীয় ঐতিহ্য
বলে বেনারসের
রাজপরিবার থেকে
একজন রাজকুমার
রামবতীতে (বর্তমান
রামী বা
রাম্বী) স্থায়ীভাবে
বসবাস শুরু
করেন এবং
তার রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেন।
কম্বোডিয়ার ঐতিহাসিক
বিবরণী জানায়,
ইন্দ্রপ্রস্থের একজন
শাসক রাজা
আদিত্যবংশ তার
এক পুত্রকে
নির্বাসিত করেন,
যে কিনা
সে সময়
কক থলক
দেশে যান
এবং সেখানকার
শাসককে পরাজিত
করে নিজের
রাজ্য প্রতিষ্ঠা
করেন। পরে
তিনি একজন
সুদর্শনা নাগা
রাজকুমারীকে বিয়ে
করেন, যার
পিতা ওই
রাজপুত্রকে উপহার
হিসেবে রাজধানী
শহরটিই দিয়ে
দেন এবং
সে রাজ্যের
নাম বদলে
‘কাম্বোজা’
রাখা হয়।
একইভাবে অনেক ভারতীয় পুঁথি ও লোকগল্পেও এমন অনেক কাহিনীর উল্লেখ আছে, যা খ্রিস্টের জন্মের আগেও ভারতীয়দের সুবর্ণভূমি ভ্রমণের কথা বলে। অনেক জাতকের গল্প এমন সমুদ্রযাত্রার কথা বলে, যেমন ধরা যাক এ গল্পের কথাই, যেখানে বিদেহর (মিথিলা) রানী যুদ্ধে তার স্বামীর পরাজয় ও মৃত্যুর পরে যতটা সম্ভব ধন-সম্পদ সঙ্গে নিয়ে চম্পায় পালিয়ে যান। তার পুত্র তার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে নেন এবং সুবর্ণভূমিতে পৌঁছার আশায় জাহাজে করে কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে যাত্রা করেন, যদিও তার মা তাকে কাতরভাবে অনুরোধ করেছিলেন যেন সে ভয়ংকর সমুদ্রসীমা অতিক্রম না করে। সবশেষে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটলেও রাজপুত্র সম্পদশালী হয়ে ফিরে আসেন এবং মিথিলায় তার বাবার রাজ্য পুনরোদ্ধার করেন। আরেকটি গল্পে দেখা যায়, বেনারসের সূত্রধরের একটি দল বনের কাঠ দিয়ে একটি জাহাজ তৈরি করে এবং বসবাসের জন্য একটি নতুন জায়গা পাওয়ার আশায় সুদূর পূর্বের (সুবর্ণভূমি) দিকে যাত্রা করে। সমুদ্রের মাঝখানেই তারা একটি দ্বীপ আবিষ্কার করে, যা কিনা বিভিন্ন ধরনের ফলমূলে পরিপূর্ণ ছিল এবং তাদের পরিবার নিয়ে সেখানেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতীয় পুঁথিগুলোর
মধ্যে
বৃহত্কথা
প্রাচীন ভারতের
নানা গল্পে
পরিপূর্ণ। এগুলোর
মধ্যে সবচেয়ে
বিখ্যাত হলো
সানুদোসার রোমাঞ্চ
অভিযানের গল্প।
সানুদোসা অচেরা
নামের একজন
অভিযাত্রীর দলে
যোগ দেয়,
যারা সুবর্ণভূমির
দিকে একটি
অভিযাত্রার প্রস্তুতি
নিচ্ছিল। যাত্রাপথে
দলটিকে যে
কঠোর ভাগ্য
পরীক্ষার মধ্যে
যেতে হয়েছিল,
তার বিস্তারিত
বর্ণনা পাওয়া
যায় এবং
চমত্কারভাবে আমরা
স্থলপথ ধরে
ইস্ট ইন্ডিজের
দিকে যাওয়ার
সময় অভিযাত্রীদের
নেয়া অনেক
পথের কথা
জানতে পারি।
এ ধরনের ভ্রমণ কাহিনীগুলো এবং অন্যান্য পুঁথি (ভারতীয় ও সুদূর পূর্বের দেশ উভয়েরই) আমাদের পূর্বের দূরবর্তী দেশগুলোয় ভারতীয়দের রাজ্য প্রতিষ্ঠার গল্প বলে, একই সঙ্গে এগুলো সে সময়কার ভারতের জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোর চিত্র সামনে আনে। সেকালে অনেক ভারতীয় বণিক বাণিজ্যিক লাভের আশায় (সম্পদ ও সৌভাগ্য) এ ধরনের বিপদসংকুল যাত্রাগুলোয় অংশ নিয়েছিলেন। রোমাঞ্চের আগ্রহ ও নতুন জায়গা অনুসন্ধান করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনেক কাহিনীতে একদম পরিষ্কার, যা প্রাচীন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে। এসব কাহিনী আর কিংবদন্তিগুলো আমাদের সুদূর পূর্বে হিন্দু রাজত্বের অস্তিত্ব ও সেসব অঞ্চলের জনগণের সামাজিক-ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেয়। তবে এসব সূত্র থেকে সে রাজ্যগুলো ঠিক কোন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার যথাযথ তারিখ নির্ণয়ের খুব একটা সুযোগ নেই। সে যা-ই হোক, বিভিন্ন শিলালিপি, ভাস্কর্য, মন্দির ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এবং অনেক চৈনিক ও গ্রিক সাহিত্য, বিবরণীর সূত্র থেকে এটা বলা সম্ভব যে ওই ভারতীয় রাজ্যগুলোর অনেকগুলো দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের খুব পরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং সম্ভবত তার বহু আগেই স্থাপিত হয়েছে। সুদূর পূর্বের বা বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিশ্চিতভাবে খ্রিস্টপূর্ব আমলেই শুরু হয়েছিল এবং তা এ দুই অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতিতে অনপনেয় ছাপ, সাদৃশ্য তৈরি করেছে।