মানবসভ্যতার একেবারে
ঊষালগ্ন, মানুষ
তখন শিকারি
ও সংগ্রহকারী
(হান্টার-গ্যাদারার),
বাস করে
আদিম জঙ্গলে
প্রতিকূল পরিবেশে,
তখন সূক্ষ্ম
শিল্পচর্চা বা
শৌখিন পোশাক
পরিধান করা
তার কল্পনার
বাইরে। পরে
ওই শিকারি-সংগ্রহকারীর
পর্ব পেরিয়ে
যখন কৃষিপ্রধান
যুগ এল
আর মানুষ
কোনো এক
জায়গায় স্থায়ীভাবে
বাস করতে
শুরু করল,
তখন তার
হাতে এল
অবসর সময়
এবং সে
সঙ্গে শুরু
হলো নানা
রকমের শিল্প-সংস্কৃতি
ও নান্দনিক
চর্চা। নানা
গানের সুর
সে বাঁধতে
শিখল, নানাবিধ
রান্না পরখ
করা শুরু
করল, পাথর
আর কাঠ
কেটে মূর্তি
তৈরি করতে
লাগল, নানা
ধরনের পোশাক
এবং গহনায়
নিজেকে আরো
আকর্ষণীয় করতে
শিখল। এসবের
সঙ্গে নিজেকে
আরো আকর্ষণীয়
করে তুলতে
শুরু করল
সুগন্ধির ব্যবহার।
ভারতে সুগন্ধির
ব্যবহার শুরু
সেই প্রাচীনকাল।
সঠিক বলতে
গেলে সেই
প্রাগৈতিহাসিক যুগেই।
ড. পাওলো
রোভেসটির ১৯৭৫-এর
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদন
থেকে আমরা
জানতে পারি
যে তার
টিম তক্ষশীলাতে
খননকার্য চালানোর
সময় খুঁজে
পায় পোড়ামাটির
বা টেরাকোটার
ডিস্টিলেশন অ্যাপারেটাস,
যার সঙ্গে
পাওয়া যায়
পোড়ামাটির তৈরি
বিভিন্ন তেলের
পাত্র। কার্বন
ডেটিং করে
জানা যায়
যে এগুলো
তৈরি হয়েছিল
৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
অর্থাৎ আজ
থেকে পাঁচ
হাজার বছর
আগে সিন্ধু-সরস্বতী
সভ্যতার অধিবাসীরা
জানত কী
করে সুবাসিত
ভেষজ থেকে
সুগন্ধি তৈরি
করতে হয়।
রিপোর্ট অনুযায়ী
এ তেলের
পাত্রগুলোর মুখ
বন্ধ করা
ছিল কাপড়
দিয়ে। এর
থেকে ড.
পাওলো অনুমান
করেন যে
নানা লতাপাতা
আর ভেষজ
ফুটন্ত জলে
দিয়ে বাস্প
সৃষ্টি করা
হতো এবং
সে বাষ্প
ওই মুখে
বাঁধা কাপড়গুলো
শুষে নিত।
পরে কাপড়গুলো
নিংড়ে তেল
বের করা
হতো, যা
দিয়ে তৈরি
হতো সুগন্ধি।
অর্থাৎ রসায়নের
ডিস্টিলেশন বা
পাতন প্রক্রিয়ার
ব্যবহার ভারতবর্ষে
তখনই ছিল।
ড. পাওলো
রোভেসটির পাওয়া
হরপ্পা যুগের
টেরাকোটা ডিস্টিলেশন
অ্যাপারেটাসটি এখন
করাচির জাদুঘরে
রাখা আছে।
সুগন্ধি তৈরির
ইতিহাস প্রাচীন
ভারত ছাড়াও
প্রাচীন মিসরেও
পাওয়া যায়।
সেখানে আমরা
দেখতে পাই
যে মিসরীয়
ফ্যারো বা
রাজা খুফুর
(২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
সময়ে লেখা
পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ
আছে বিভিন্ন
সুগন্ধযুক্ত ভেষজের,
তেলের, মন্দিরে
ব্যবহূত ধূপ
এবং জতুর
(রেজিন) সুবাস
থেকে আরোগ্য
সাধনের কথা।
ভারতে আমরা
দেখতে পাই
যে হরপ্পা
সভ্যতার বাসিন্দাদের
সুগন্ধযুক্ত জল
এবং নানা
লতাপাতা ভেষজ
থেকে ডিস্টিলেশনের
সাহায্যে সেগুলোর
নির্যাস বের
করার উপায়
জানা ছিল,
যেগুলো পরে
বৈদ্যরা ওষুধ
তৈরির কাজে
ব্যবহার করত।
সুগন্ধি তৈরির
পদ্ধতি ক্রমেই
বিবর্তিত হতে
থাকে এবং
সেটার উল্লেখ
আমরা পাই
অথর্ববেদে, মহাভারতে,
রামায়ণে, এমনকি
ভাগবত গীতাতেও।
ভাগবত গীতাতে
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর
সভার বর্ণনায়
দেয়া আছে,
সেখানে গোলাপ
আর চন্দন
মেশানো জল
ছিটিয়ে দেয়া
হয় জায়গাটা
সুবাসিত করে
রাখতে। ১০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ
ভারতের পণ্ডিত
নাগার্জুন বই
লেখেন নানা
প্রকারের সুগন্ধযুক্ত
মোমবাতি নিয়ে।
চড়ক
সংহিতাতে
জাল্যেয় আস্বান
বলে যে
প্রক্রিয়ার বর্ণনা
আছে, সেটা
ওয়াটার ডিস্টিলেশন
ও সুগন্ধি
তৈরির কাজে
লাগে। প্রাচীন
ভারতে এ
আতর বা
সুগন্ধযুক্ত জল
তৈরির প্রণালি
সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে
ওঠে বিশেষ
করে গুপ্তযুগে।
গন্ধশাস্ত্র
প্রাচীন ভারতের
প্রচলিত বিজ্ঞান
ও চারুশিল্প
হিসেবে ধরা
হতো এবং
শাস্ত্রটা ভারতীয়
মেটেরিয়া
মেডিকার
মধ্যে গণ্য
করা হয়।
প্রাচীন গন্ধশাস্ত্র
নানা প্রাকৃতিক
উপাদান নিয়ে
কাজ করত।
যেহেতু এগুলো
অনেক সময়
ওষুধ তৈরির
কাজেও লাগত,
তাই এদের
উল্লেখ আমরা
চড়ক
সংহিতা
ও সুশ্রুত সংহিতাতেও পাই।
লতা, পাতা,
ফুল ও
ভেষজ ছাড়াও
প্রাচীন ভারতের
গন্ধশাস্ত্রে নানা
মসলা আগুনের
সংস্পর্শে এনে
তার থেকে
সুঘ্রাণ বের
করার প্রক্রিয়াও
প্রচলিত ছিল।
সুগন্ধির ব্যবহার
যদিও অভিজাত
এবং উচ্চবিত্ত
সমাজের মধ্যে
বেশি প্রচলন
ছিল, ধর্মীয়
ও চিকিৎসার
কাজে সুঘ্রাণযুক্ত
জল, ধূপ,
মসলা দেয়া
আগুন প্রভৃতি
পদ্ধতি তখন
জনপ্রিয় ছিল।
বৈদিক রচনাতেও
আমরা উল্লেখ
পাই নানা
গাছ ও
মসলার, যেগুলো
এ সুগন্ধি
তৈরিতে কাজে
লাগত। যেমন
দারচিনি, জটামানসী,
কেতকী, মল্লিকা,
চম্পা, চন্দন,
আদা, কর্পূর,
মধু, অগরু,
কস্তুরী, কুমকুম,
তিল, মঞ্জিষ্ঠা
ইত্যাদি। বরাহমিহিরেরে
বৃহত্সংহিতা পড়ে
আমরা জানতে
পারি, সে
সময় নানা
রকমের মসলা,
ফুল, গাছের
মূল, ফল,
পাতা ও
ছাল দিয়ে
চুল ধোওয়ার
সাবান, মাথার
তেল, সুগন্ধি,
মুখশুদ্ধি, গায়ে
মাখার সাবান
বা গুঁড়ো
সাবান, পাউডার,
চুলের রঙ
(মূর্ধজারগা), পূজোর
ধূপ ইত্যাদি
তৈরি এবং
ব্যবহারের চল
ছিল। বৃহত্সংহিতা
ছাড়াও অগ্নিপুরাণ,
অমরকোষ, কল্পসূত্র,
উপনিষদ, জাতকের
গল্প, বেদাঙ্গ,
আরণ্যক, নানা
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ
এবং সপ্তদশ
শতাব্দীর কেলাদি
ভাসাবরাজার লেখা
‘শিব
তত্ত্ব রত্নাকর’
প্রাচীন ভারতে
ব্যবহূত সুগন্ধি
ও প্রসাধন
সামগ্রী নিয়ে
বিশদভাবে আলোচনা
করে এবং
নানা তেল,
ক্রিম, সুগন্ধি
কীভাবে তৈরি
করতে হয়
তার খুঁটিনাটি
এগুলোয় পাওয়া
যায়।
বৃহত্সংহিতা
আর শিব তত্ত্ব
রত্নাকর
পড়লে জানা
যায়, প্রথম
দিকে সুগন্ধি
তৈরি হতো
নানা সুঘ্রাণযুক্ত
লতাপাতা বা
ভেষজ দিয়ে,
যা মেশানো
হতো রজন,
গুড় বা
লোহবানের সঙ্গে।
পরে ভারতীয়রা
শিখল, তেল
বা চর্বির
সঙ্গে এ
সুঘ্রাণযুক্ত জিনিসগুলো
ফোটালে ঘ্রাণের
খানিকটা তেল
বা চর্বির
সঙ্গে মিশে
গিয়ে সেটার
মধ্যে রয়ে
যায়। এরপর
শুরু হয়
ক্রিমজাতীয় প্রসাধন
আর ওষুধ
তৈরি এবং
নানা রকমের
সুগন্ধি তেল
(অ্যারোমেটিক এসেনশিয়াল
ওয়েলস)।
ফুলের গন্ধ
অনুকরণ করে
ওই একই
গন্ধ কৃত্রিম
উপায়ে তৈরি
করার উপায়ও
দেয়া আছে
বৃহত্সংহিতা আর
শিব
তত্ত্ব রত্নাকর বই
দুটোয়। এ
সুগন্ধি তৈরির
জন্য নানা
রাসায়নিক প্রক্রিয়ার
চল ছিল
প্রাচীন ভারতে,
যার বর্ণনা
আছে বৃহত্সংহিতা
ও শিব তত্ত্ব
রত্নাকরে।
যেমন পক্ব,
তপ্ত, সংযুক্ত,
ধূপ্য, সিক্ত,
বোধ, ভেধ,
দ্রব্য সংস্কার
ও ভাবনা।
মিসরের মতো
প্রাচীন ভারতেও
বিভিন্ন সুঘ্রাণযুক্ত
তেল এবং
সাবানের সাহায্যে
গোসল করার
রেওয়াজ ছিল
এবং এর
রাজা সোমেস্বর
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে
তার মানাউল্লাস
বইতে এ
সুবাসিত গোসলের
রীতি নিয়ে
চারটি অধ্যায়
লিখে গেছেন,
যেটা পড়লে
খুব সহজেই
আন্দাজ করা
যায় তখনকার
শৌখিন নাগরিকদের
মধ্যে সুগন্ধির
জনপ্রিয়তা। হরপ্পার
প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট
এবং এ
প্রাচীন গ্রন্থগুলো
পড়লে খুব
পরিষ্কার বোঝা
যায় প্রাগৈতিহাসিক
ও প্রাচীন
যুগ থেকেই
সুঘ্রাণযুক্ত তেল
আর জলের
ব্যবহার ভারতে
জানা ছিল
এবং বহুল
প্রচলিত ছিল।
বাৎসায়নের কামসূত্র
পড়লে ভালো
করে বোঝা
যায় প্রাচীনকালে
সুগন্ধির ব্যবহারের
নানা পদ্ধতি
এবং সেগুলোর
জনপ্রিয়তা। কিছু
ইতিহাসবিদের দাবি,
প্রাচীন ভারতে
কোনো সুগন্ধির
প্রচলন ছিল
না এবং
তা মিসর
থেকে আরব
বণিকদের হাত
ধরে এসেছে।
তাদের এ
দাবি যে
সঠিক নয়
তা প্রমাণ
করার জন্য
যথেষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক
এবং সাহিত্যিক
উপাদান মজুদ
আছে, যেগুলো
ঘাটলেই বেরিয়ে
আসবে প্রাচীন
ভারতের সুবাস
আর সুগন্ধির
আবেশ, যা
এখনো পুরোপুরি
হারিয়ে যায়নি।
ছোট কোনো
গলির পুরনো
আতরের দোকানে
ঢুঁ মারলে
আজো তা
খুঁজে পাওয়া
যাবে।
মণিদীপা দে: ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভ্রমণবিষয়ক লেখিকা