সিল্করুট

হাবশি স্থাপত্যের স্মরণীয় নিদর্শন

সিদি সাইয়্যিদ জালি

রবিউল হোসাইন

সিদি সাইয়্যিদ মসজিদের বিখ্যাত জালি

মাঝখানের খিলানের ডান পাশে সূক্ষ্ম জালির কাজ। ১৬ ফুটের জালির ক্যানভাসে খোদাই করা জীবনবৃক্ষের প্রতিকৃতি। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, গাছ বেহেশতে জন্মায়। জালি সিদি সাইয়্যিদ জালি নামে পরিচিত। দাক্ষিণাত্যের ৬০০ বছরের পুরনো আহমেদাবাদ শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সিদি সাইয়্যিদ মসজিদে এমন অনেক সুদৃশ্য জালি আছে। এসব জালির ওপর খোদাই করা সূক্ষ্ম কারুকার্য মসজিদটিকে শিল্পানুরাগীদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত করেছে। বিংশ শতাব্দীর ভারততত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ বলেন, সারা বিশ্বের সব জালির কাজের মধ্যে সিদি সাইয়্যিদ মসজিদের জালির কাজই সবচেয়ে বেশি শৈল্পিক। মসজিদের দশটি অর্ধবৃত্তাকার জানালাকে সুসজ্জিত করেছে আলংকারিক জালিগুলো। এর মধ্যে কিছু জটিল জ্যামিতিক নকশাসমৃদ্ধ। আবার কিছুতে জড়ানো গাছ এবং পাতার নকশা। এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হলো জীবনবৃক্ষের নকশাযুক্ত সিদি সাইয়্যিদ জালি। জালি ইউনেস্কো ঘোষিত ভারতের প্রথম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি আহমেদাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক জেমস ফার্গুসনের মতে, সিদি সাইয়্যিদ মসজিদের জানালায় থাকা জালির কারুকার্যের কোনো তুলনা নেই। তিনি বলেন, আগ্রা দিল্লিতে রকম সুন্দর অনেক জালি আছে। কিন্তু তার কোনোটাই এত ব্যাপক এবং চমৎকারভাবে ভারসাম্যপূর্ণ নয়।...গ্রিস অথবা মধ্যযুগের সেরা স্থপতিদের কাজও এতটা যথাযথ হয়ে উঠতে পারেনি।

ষোড়শ শতাব্দীতে অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন হাবশি অভিজাত শেখ সাইয়্যিদ আল-হাবশি সুলতানি। অভিজাত হাবশিদের সিদি বলা হতো। তাই মসজিদ সিদি সাইয়্যিদ মসজিদ নামে পরিচিত। ইসলামী শিল্পকলা এবং সুলতানি আমলের নান্দনিকতার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে অপূর্ব মসজিদ।

হাবশিদের মসজিদ নির্মাণ কেবল আহমেদাবাদে সীমাবদ্ধ ছিল না। আদনি, ঔরঙ্গাবাদ, বিজাপুর, জানজিরাসহ দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে আছে তাদের স্থাপত্যকীর্তি। সপ্তদশ শতাব্দীতে আদনির জামে মসজিদ নির্মাণ করেন সিদি মাসুদ খান।

সিদিদের অনন্য স্থাপত্যের বহু নিদর্শন পাওয়া যায় ঔরঙ্গাবাদ শহরে। এগুলোর অধিকাংশের নির্মাতা হিসেবে নাম পাওয়া যায় হাবশি অভিজাত মালিক আম্বরের। এদের মধ্যে ১৬১৫ সালে খিড়কিতে নির্মিত জামে মসজিদ অন্যতম। এটি দৌলতাবাদ থেকে প্রায় আট মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। খিড়কিতে অবস্থিত নাওখান্দা প্রাসাদ এবং কালি মসজিদও তিনি নির্মাণ করেন। নাওখান্দা প্রাসাদের ভেতরে জেনানা মহল, মসজিদ, হাম্মামখানা, দিওয়ান এবং সুদৃশ্য বাগানে সুসজ্জিত। খুলদাবাদে মালিক অম্বর এবং তার স্ত্রী বিবি করিমার সমাধিসৌধ সিদি স্থাপত্যকর্মের আরো দুটি অনন্য নিদর্শন। এর চমৎকার খিলান এবং জালিগুলোতে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা। এর গম্বুজ পদ্মফুলের পাপড়ির নকশা দ্বারা সুসজ্জিত। সমাধিসৌধ নির্মাণে সিদিদের কৃতিত্বের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দুটি সমাধিসৌধ।

সিদিদের ধর্মীয় স্থাপত্যকর্মগুলো আদিলশাহি সাম্রাজ্যের নান্দনিকতা এবং নির্মাণ ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত। মুহাম্মদ আদিল শাহের এক ভৃত্য ছিলেন ইয়াকুত দাবুলি হাবশি। বিজাপুরের কয়েকটি চমৎকার স্থাপনার সঙ্গে তার নাম জড়িত। এর মধ্যে আছে একটি সমাধিসৌধ, একটি অভিজাত মসজিদ এবং জামে মসজিদের মেহরাব। শেষোক্তটি ১৬৩৫ সালে নির্মিত। এটি চমৎকার কারুকার্যমণ্ডিত। বিজাপুরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে আছে ইবরাহিম রওজা কমপ্লেক্স। আবিসিনিয়ান বংশোদ্ভূত মালিক সন্দেল সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। ইবরাহিম রওজা কমপ্লেক্স একটি সমাধিসৌধ। এর ভেতরে কূপ, ঝরনা, মসজিদ সৌধ আছে। জানজিরার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যের মধ্যে সিদি সিরুল খান, সিদি ইয়াকুত খান এবং তার ভাই সিদি খাইরিয়াত খানের সমাধি উল্লেখযোগ্য।

 

রবিউল হোসাইন: লেখক