পর্যালোচনা

মেট্রোরেলের দেশে মহাসড়কে অনুপস্থিত গণপরিবহন সেবা

ড. আর এম দেবনাথ

ছবি : বণিক বার্তা

শৃঙ্খলার সঙ্গে কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক আছে? অন্যভাবে বললে বলতে হয় বিশৃঙ্খল জাতি কি অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারে? ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ির উৎপাতের একটি প্রতিবেদন পাঠ করতে করতে আমার মনে এ প্রশ্নগুলো জাগে। আর মনে পড়ে স্কুলজীবনের কথা। আমাদের সময় কোনো বিষয়ের ওপর একটি রচনা লেখা ছিল আবশ্যকীয় বিষয়। এজন্য রচনা মুখস্থ করলাম। বিষয়গুলো মোটামুটি ছিল এ রকম: গরু, প্রিয় শিক্ষক, বনভোজন, নদী, সোনালী আঁশ (পাট), শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর রচনা লিখতে গিয়ে কত পড়েছি যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া জীবনে উন্নতি করা যায় না। শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। এসব রচনা ভূমিকা দিয়ে শুরু করে উপসংহার দিয়ে শেষ করতে হতো। রচনা ‘কমন’ পড়লে আমাদের ছিল মহা আনন্দ, যেমন অংকের ক্ষেত্রে। এখন এ বয়সে এসে সব পড়াশোনা মনে হয় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। যেসব জিনিসের গুণের প্রশংসা করেছি, এখন দেখছি ওইসব জিনিসের গুণহীনতারই জয়। এমন একটি বিষয় মনে হচ্ছে মহাসড়কের বিশৃঙ্খলা। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, তিন চাকার গাড়ির যন্ত্রণায় মহাসড়ক হয়ে পড়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দূরপাল্লার গতিশীল যানবাহন চলতে পারছে না এদের যথেচ্ছ পরিবহনে। অথচ মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ নিষেধাজ্ঞা মানে না। কেউ শৃঙ্খলায় আসতে চায় না। কভিড-১৯-এর আগের কথা। ঢাকা থেকে ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিলাম। তিন চাকার যানের উৎপাতে প্রাইভেটকার, বাস কোনো স্পিডই তুলতে পারছে না। অধিকন্তু রয়েছে একটু পরপর রাস্তার ওপরে দোকানপাট, কাঁচাবাজার। ওইসব কাঁচাবাজারের কারণে যানজট হচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। কারোর কিছু করার নেই। কেউ নিয়মনীতি মানতে রাজি নয়। অথচ দেখাই যাচ্ছে, বিশৃঙ্খলার মধ্যেই কাঁচাবাজারের সংখ্যা বাড়ছে, বেচাকেনা বাড়ছে, গ্রামগঞ্জে হাজার হাজার দোকানপাট হচ্ছে, নতুন নতুন বাজার হচ্ছে। যেখানে সেখানে বাজার হচ্ছে। তাহলে কী দাঁড়াল? বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটছে। অথচ ছাত্রাবস্থায় কী পড়লাম! ধরা যাক ঢাকা শহরের কথা। এটি তিলোত্তমা শহর—মহানগরী। আয়তনে এ মহানগর এত বড় হয়েছে যে একে দুই ভাগে বিভক্ত করতে হয়েছে। এত বড় শহর, এর রাস্তার ওপরই চলছে রিকশা, সিএনজি, মেশিনচালিত রিকশা। রাস্তায় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা। মেশিনচালিত রিকশা আমরা জনতাম ঢাকার রাস্তায় চালানো নিষিদ্ধ। কিন্তু পুরান ঢাকাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় এসব চলে অবলীলাক্রমে। এ চালকদের মধ্যে কেউ আবার প্রতিবন্ধী, যাদের কিছু বলা যায় না। রিকশা চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা নেই। তাদের পার্কিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। ভাড়ার কোনো মাপকাঠি নেই। মেশিনচালিত রিকশায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। কেউ দেখার নেই। রিকশা, সিএনজি, মেশিনচালিত রিকশার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন উৎপাত—মোটরবাইক। এদের প্রতিযোগিতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঢাকা মহানগরীর রাস্তা দিয়ে বাস, প্রাইভেট কার নিয়ে চলাচলের কোনো উপায় নেই। বিশৃঙ্খলা এমন এক পর্যায়ে যে মোটরবাইকওয়ালারা হরেদরে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করে। কার আগে কে যাবে? শত শত, হাজার হাজার মোটরবাইক রাস্তায় যেখান সেখান দিয়ে চলাচল করে। ডানে যাচ্ছে তো, পরক্ষণেই যাচ্ছে ডানে। চলছে মধ্য রাস্তা দিয়ে। আইন-বিধি, নিয়ম-কানুন, ট্রাফিক বিধি মানার কোনো লক্ষণ নেই। রয়েছে আবার বড় বড় ট্রাক-বাস। রাস্তায় প্রাইভেট কার রাখলেই জরিমানা। কিন্তু বড় বড় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গাড়ি রাস্তায় পার্কিং করা থাকে। মতিঝিলের আশপাশে শত শত গাড়ি থাকে পার্কিং করে। ট্রাফিক আইন মানার কোনো লক্ষণ নেই। মোটরবাইকের আবার রয়েছে আরেক উৎপাত। বিচিত্র এদের ডিজাইন, নতুন নতুন কোম্পানির মোটরবাইক। উপযোগিতা (ইউটিলিটি) থাকুক আর না-ই থাকুক, মোটরবাইককে আকর্ষণীয় করার জন্য কত উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে বিশ্রী ও ক্ষতিকর একটি ‘ইনোভেশন’ হচ্ছে অনেক বাইকের সাইলেন্সার পাইপ। এগুলো দিয়ে ধুয়া নির্গত হয়। অথচ এসব এসে রিকশাযাত্রী, পথচারীর পায়ে পড়ে। ৪৫ ডিগ্রিতে এদের অবস্থান। চলছে অবিরাম। কেউ দেখার নেই। প্রতিবাদ নেই। ট্রাফিক নিয়ম কী তাও কেউ জানেন না। সিএনজি চলার কথা মিটারে। তা কখনো চলে না। দেড়-দ্বিগুণ ভাড়া নেয় তারা। হরদম এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে অস্বীকৃতি। ট্রাফিক পুলিশ কিছু বলে না। পার্কিং ঢাকা মহানগরীতে নেই। হাজার হাজার গাড়ি। যাত্রীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। ১০ মিনিটের জন্য কোথাও পার্কিং করা যায় না। ২-৪ হাজার টাকা এখন নাকি জরিমানা! রাস্তায় চরম বিশৃঙ্খলা। কেউ নির্ধারণ করে দিচ্ছে না পার্কিং স্পেস। সর্বত্রই অ্যাডহকইজম। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গাড়ি, সিএনজি, রিকশা, মোটরবাইকের পার্কিং ঠিকই আছে, প্রাইভেট কার পেলে তা হয়ে যায় শত্রু। আইন অমান্যতা আর কী?

আসা যাক হকারদের কথায়। যেখানে সেখানে তারা বসে যাচ্ছে। ফুটপাতে তাদের দোকান বসছে। রাস্তায় তাদের দোকান বসছে। ওভার পাস দিয়ে যেখানে নামার পথ তার মুখে হকারদের দোকান শত শত। হকাররা সরকারের জায়গা দখল করছে, বেসরকারি সম্পত্তি দখল করছে। রেলের জায়গা, খাল-বিলের জায়গা, পাহাড়ি জায়গা, খাসজমি সব দখল করছে দিনের পর দিন ধরে। আইন অমান্যতা আর কাকে বলে! তারা দলবদ্ধ, সমিতিবদ্ধ। যোগাযোগ তাদের বড় বড় জায়গায়। তারা নিয়মিত চাঁদা দেয় ক্ষমতাধরদের, প্রভাবশালীদের। তাদের সম্পর্কে কোনো কথা বলা যায় না। কথা উঠলেই সবাই তাদের পক্ষে। তারা গরিব মানুষ। কোথায় যাবে? প্রতিবন্ধীরা মোটরচালিত রিকশা চালায়। তারা অসহায় মানুষ। তারা কোথায় যাবে? এসব যুক্তিতে প্রতিনিয়ত চলছে উচ্ছৃঙ্খলতা, চলছে শৃঙ্খলাহীনতা। যে যার খুশি মতো চলছে। ধরা যাক লিফটের কথা। বলা থাকে অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র সিটিজেনদের অগ্রাধিকার দিতে। বৃদ্ধদের অগ্রাধিকার দিতে। কেউ তা দেয় না। আপত্তি তুললে অনেক সময় দুর্ব্যবহারও করা হয়। সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মান দেখানো যে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের অঙ্গ তাও অস্বীকৃত।

আসা যাক ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে। বছরে দুবার বিনামূল্যে কাস্টমারদের ব্যালান্স সার্টিফিকেট পাওয়ার নিয়ম। কম্পিউটারায়ন হওয়ার পর তা মেসেজ দিয়ে জানানো হয়। কিন্তু এর জন্য চার্জ আদায় করা হয়। একেক ব্যাংক একেক নামে কত রকমের চার্জ যে কাস্টমারদের হিসাব থেকে কেটে নেয় তার হিসাব কে রাখে। এ এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। কি আমানত, কি ঋণ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো যথেচ্ছ হারে চার্জ কেটে নিচ্ছে। কাস্টমাররা তা জানেও না। অথচ দিনের পর দিন এসব করা হচ্ছে। তেরো মাস আমানত রেখে ১২ মাসের সুদ দেয়া হয়। অর্থাৎ ১৩ মাসে অনেক ব্যাংকের এক বছর। অবৈধভাবে সুদ থেকে, প্রাপ্য সুদ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কে আনবে শৃঙ্খলা? কে বলবে ব্যাংকগুলোকে যে এসব অন্যায়, অনিয়ম। না, তা করার কেউ নেই। কাঁচাবাজার, দোকানপাট, মাছের বাজার সর্বত্র চলছে উচ্ছৃঙ্খলতা। শৃঙ্খলার কোনো লক্ষণ নেই। দামে, গুণে, মাপে চলছে অরাজকতা। কি কাঁচাবাজারে, কি দোকানে, কি মাছের বাজারে, হরদম মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। কেউ এদের কোনো শৃঙ্খলায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে না। অনিয়মই হয়ে পড়েছে আমাদের জীবনের নিয়ম। অনিয়মের মধ্যে আমরা বড় হচ্ছি, অনিয়মের মধ্যেই আমরা বিদায় নিচ্ছি, বিশৃঙ্খলাই আমরা জীবনের নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছি। শৃঙ্খলা আনার কোনো প্রয়াস দেখলেই আমরা অবাক হয়ে যাই। কারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন হতে পারে তা আমাদের চিন্তার বাইরে এখন। আর কত উদাহরণ দেব? এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। এখানেই আমার প্রশ্ন। প্রশ্নটি গবেষকদের কাছে, চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কাছে, নীতিনির্ধারকদের কাছে। তবে কি উচ্ছৃঙ্খল, শৃঙ্খলাহীন অবস্থায় উন্নতি/উন্নয়ন অর্জন করা যায়? যদি তা না হয় তাহলে বাংলাদেশে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে কী করে? খাদ্যে বিষ, মাছে বিষ, সবজিতে বিষ খেয়েও আমাদের গড় আয়ু বাড়ল কী করে? কী করে আমরা ৫-৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছি। সর্বশেষ যে হিসাব জিডিপি প্রবৃদ্ধির তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা, যে মন্দাবস্থা চলছে দেশে দেশে, এ প্রেক্ষাপটে এ অর্জন তো আমি বলব অসাধারণ অর্জন, যদিও আগের বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। এখানে আমার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, বিশৃঙ্খল অবস্থায় কীভাবে আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটছে? এর কারণ কী? নাকি এ অবস্থার ভেতরে একটি বিষয় লুকিয়ে আছে। উদাহরণ হচ্ছে মৌমাছির মধু আহরণ। মৌমাছিরা যখন মধু আহরণ করে, চাক তৈরি করে, তখন তাদের দেখা যায় চরম উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায়। চারদিকে ভন ভন শব্দ। বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবস্থা। কিন্তু মজা হচ্ছে, দিনের শেষে মধুমিশ্রিত চাকটা কিন্তু মৌমাছিরা তৈরিই করে। তাহলে কি বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা? যদি তা না হয় তাহলে আরেকটা বিকল্প থাকে। দৃশ্যত বিশৃঙ্খল অবস্থায় আমরা যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি, যদি আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হতাম, শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতি হিসেবে কাজ করতাম, তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার হতো আরো অনেক বেশি। উচ্চ প্রবৃদ্ধি হারের সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও দেখা দেয়। তখন সামাজিক নিরাপত্তার চাহিদাও অনুভূত হয় বেশি। অসহায়ত্ব, গৃহহীনতা ইত্যাদি জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এটাই উন্নত দেশে দেখি আমরা। অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা যেমন আনতে হবে তেমনি শৃঙ্খলা আনতে হবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে।

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন