আলোকপাত

বাংলাদেশের অর্থনীতির চাবিকাঠি এখনো কৃষি

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা

প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ মাইকেল লিপটন কয়েক বছর আগে ঢাকায় এসে বলেছিলেন বাংলাদেশের গ্রাম রূপান্তরের কারিগর নাকি তিন ‘ফ’— ফারটিলিটি, ফার্ম ম্যানেজমেন্ট এবং ফুড (আধুনিক প্রযুক্তি-তাড়িত খাদ্যের জোগান)।

এটা আজ সুবিদিত যে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। স্বীকৃত এ সাফল্যের চিত্র ফুটে ওঠে বিবিএস কর্তৃক ২০২৩ সালে প্রকাশিত ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য থেকে। ওখানে দেখানো হয় যে মাথা-গণনা সূচকে সহনীয় দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য কমেছে ২০১৬ সালের ২৪ ভাগ থেকে ২০২২ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ; একই সময়ে মাথা-গণনা সূচকে চরম দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ (প্রায় ১৩ থেকে প্রায় ৬ শতাংশ)। এ সাফল্যের চালক গত দশকের প্রাপ্ত গড়পড়তা জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেমন ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ৭ শতাংশ। এমনকি করোনাকালেও ৩ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করে দেশটি হাতে গোনা কয়েকটি অর্থনীতির কাতারে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। 

দুই.

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা সংস্থা ইফ্রির আখতার ইউ আহমেদ দারিদ্র্য হ্রাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির, বিশেষ করে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ অন পভার্টি রিডাকশন) পর্যালোচনা করে উপসংহারে উপনীত হয়েছেন। অর্থাৎ গড় জাতীয় আয় যদি ১ শতাংশ বাড়ে তাহলে দারিদ্র্যের হার কী পরিমাণ কমে তিনি সেই সম্পর্কটা দেখার প্রয়াস নিয়েছেন। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে সহগটির মান গড়পড়তা মাইনাস ২ অর্থাৎ, গড়পড়তা প্রকৃত মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্যের হার কমবে ২০ শতাংশ। তাহলে পাঠক বুঝে নিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাসে কেন এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়, তোরা যে যা বলিস ভাই, প্রবৃদ্ধি আমার চাই, বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশে।

তবে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা সত্যি খুব কম এবং তাও ২০০৫ সাল থেকে নিম্নগামী। তিনি হিসাব কষে বের করেছেন যে ২০১৬-২২ সময়কালে সহগটির মান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শূন্য। এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সহনীয় দারিদ্র্য কমে মাত্র ৮ শতাংশ (উন্নয়নশীল দেশের গড় ২০ শতাংশ)। এর বিপরীতে ২০১০-১৬ সময়ে সহগটি ছিল শূন্য দশমিক ৮৪ এবং ২০০৫-১০ সময়ে শূন্য দশমিক ৯৬। মোট কথা, এটা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির পারঙ্গমতা বেশ কম এবং সেটা ১৭ বছর ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী। 

দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতাকে প্রায়ই আয় বিন্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়ে থাকে। আয় বিন্যাস সাধারণত জিনি সহগ দ্বারা প্রকাশিত যখন এর মান শূন্য মানে একেবারেই বৈষম্য নেই এবং সহগটি এক হলে মানে দাঁড়ায় জনসংখ্যার একজনই সব আয় এবং সম্পদের মালিক, বাকিরা শূন্য হাতে। মাঝামাঝি মান কম কিংবা বেশি বৈষম্যের বাহক। মজার ব্যাপার হলো এই যে আয় বিন্যাস যত অসম হবে, ততই দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির প্রভাব হ্রাস পাবে। অন্য কথায়, সমাজে আয়বৈষম্য বেশি হলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি হোঁচট খায়। 

তিন.

বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য বাংলাদেশের ক্রমবর্ধনশীল বৈষম্যের কথা বলে। আর তার প্রমাণ জাতীয় স্তরের গিনি সহগ যা ২০১০ সালের ০.৪৫৮ থেকে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ০.৪৮২ এবং অতিসম্প্রতি ২০২২ সালে ০.৪৯৯। আখতার ইউ আহমেদ খানা জরিপের তথ্য থেকে অধুনা ব্যবহৃত পালমা অনুপাত (মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে সম্পদশালী ১০ শতাংশের আয় এবং সবচেয়ে দরিদ্র ৪০ শতাংশের মধ্যকার আয়-অনুপাত) দিয়েও দেখাচ্ছেন যে ২০২২ সালে জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে সম্পদশালী ১০ শতাংশ বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ ভোগ করেছেন অথচ সবচেয়ে দরিদ্র ৪০ শতাংশের ভাগ্যে মাত্র প্রায় ১৩ শতাংশ পড়েছে। আরো অনুভূত যে এ পালমা অনুপাতটি ২০১৬ সালের ২ দশমিক ৯ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ২-তে এবং এটাই সম্ভবত স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে আয়বৈষম্যের এ ক্রমবর্ধিষ্ণু ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা সহনীয় দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির পারঙ্গমতা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তুলে। 

তবে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে বাতি থাকার মতো, এর বিপরীতে, ২০১৬-২২ সময়ে চরম দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা ছিল ২ দশমিক ৪৪, যার অর্থ মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি চরম দারিদ্র্য হ্রাস ছিল চমকানো ২৪ শতাংশ। এ সুখকর সংবাদটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে এই সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চরম দারিদ্র্য হ্রাসে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। স্মর্তব্য যে ২০১০-১৬ এবং ২০০৫-১০ সময়কালে এ স্থিতিস্থাপকতার মান ছিল যথাক্রমে ১ এবং ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এমন ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করেছে সম্প্রতি সামাজিক সুরক্ষা জালে অধিকতর বরাদ্দ প্রদান আনুমানিক মোট বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এবং জিডিপির ৩ শতাংশের প্রান্তিক বেশি। যা-ই হোক, সামাজিক সুরক্ষা জালের অনেক সমস্যা আছে, ধারণাগত এবং বাস্তবায়নে, নিশানা নির্ধারণে এবং অর্থায়নে, যেগুলোর সমাধান অধিকতর ইতিবাচক ফলাফল এনে দিতে পারে।

চার.

এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের ভূমিকা কী? কারণ ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি থেকে জিডিপির যে হিস্যাটা আসে, তা সমাজের সবচেয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ের সূত্রপাত ঘটায়। তাছাড়া শুধু সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নয়, পুরো অর্থনীতিতে শক্তিশালী লিংকেজ প্রভাব নিয়ে হাজির হয় কৃষি খাত। কৃষির পরোক্ষ অবদান আসে খামার-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে যেমন সার, সেচযন্ত্র, কীটনাশক এবং অন্যান্য উপকরণের চাহিদা সমেত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং প্যাকেজিং, পরিবহন, শিল্পজাত প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং কৃষিপণ্যের বাজার সমেত ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ার মাধ্যমে। এ কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটায় খামার-বহির্ভূত খাতে, যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আয়। যা-ই হোক, দেশ যতই সম্পদশালী হবে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধির ধার, খামার-বহির্ভূত খাতের তুলনায় ততই কমবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। 

প্রসঙ্গত এও বলে রাখা দরকার যে ২০২২ সালেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ জীবিকার জন্য মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং জিডিপিতে মাত্র ১২ শতাংশ অবদান নিয়ে শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষি খাতে। সুতরাং কৃষি খাতকে কোনোভাবেই অবহেলা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। 

যেমন একটা উদাহরণই যথেষ্ট। বিবিএসের তথ্য ব্যবহার করে গবেষক বের করলেন যে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতার মান ২ দশমিক ২৬, অর্থাৎ ২০১৬-২২ সময়কালে মাথাপিছু প্রকৃত কৃষি জিডিপি ১০ শতাংশ বেড়ে প্রায় ২৩ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়। অথচ এর বিপরীতে অ-কৃষি প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা হচ্ছে শূন্য দশমিক ৭২, যার অর্থ অ-কৃষি কর্মকাণ্ডে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় মাত্র ৭ শতাংশের কোঠায়। মনে হয়, এ ধরনের পরিসংখ্যান এটা প্রমাণ করতে চায় যে অন্তত দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অ-কৃষি খাতের তুলনায় তিন গুণের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে একই হারে প্রবৃদ্ধি অ-কৃষির চেয়ে কৃষিতে বেশি কার্যকর।

পাঁচ.

তাহলে দেয় লিংকেজ প্রভাব সাপেক্ষে কৃষিকে আরো গতিশীল, বেগবান করা যায় কীভাবে যাতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুততর করা যায়? আখতার ইউ আহমেদ বেশ ক’টা বিষয় সামনে এনেছেন, যা নীতিনির্ধারকদের জন্য নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়নে চিন্তার খোরাক হতে পারে।

ভবিষ্যতে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন এমন প্রযুক্তি প্রসার করা যা উৎপাদন বাড়ায় এবং উঁচু মূল্যের ফসল ও মাছ ও গবাদিপশুসহ ফসল-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে মনোযোগ আকর্ষণ করে। কৃষি খাতের দারিদ্র্য নিরসন ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রযুক্তিতে ব্যক্তি ও সরকারি খাতের নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি। 

ক্রমহ্রাসমান চাষের জমি, ক্ষয়িষ্ণু উর্বরতা, পোকার আক্রমণে বিশেষ ফসলের ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা মাথায় রেখে উৎপাদন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সময়ের দাবি। উপরন্তু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খামারের মধ্যকার উৎপাদন তারতম্য কমিয়ে আনা জরুরি। 

খুব গুরুত্বসহকারে গবেষক ভেবেছেন কৃষিতে অর্থায়নের কথা। বিশেষত ক্ষুদ্র চাষীদের জন্য ঋণের বাজারে খুব সীমিত প্রবেশগম্যতা তাদের প্রযুক্তি প্রসারণ, জীবিকা বহুমুখীকরণ এবং পণ্য বাজারজাতের পথে বড় বাধা। তাছাড়া সময়মতো এবং ব্যয়সাশ্রয়ী উপকরণ লভ্যতা তাদের লাভের মুখ দেখায়।

বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আধুনিকায়ন, উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং ফসল বহুমুখীকরণের ওপর। বহু আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পুত্রকে লিখেছিলেন:

‘অনুগ্রহ করে ওদেরকে বলো বসতভিটা ও ক্ষেতের সীমানায় যেখানে সম্ভব আনারস, কলা, খেজুর এবং অন্যান্য ফলের গাছ লাগাতে। আনারসের পাতা থেকে খুব ভাল এবং শক্ত আঁশ বের করা যায়। এই ফলটা আবার খুব সহজেই বাজারজাত করা যায়। ঝোপঝাড়ের বেড়া হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং শেকড় থেকে কীভাবে খাদ্য উৎপাদন বের করা যায় সে সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞান দেয়া দরকার। যদি তাদেরকে গোল আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করা যায় সেটা হবে খুব লাভজনক। অফিসরুমে আমেরিকান ভুটরা আছে,; দ্যাখো এগুলো বোনা যায় কিনা।’

মোট কথা, কৃষি খাতের উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির ভূমিকা বলিষ্ঠ করতে হলে একটা সমন্বিত পরিকল্পনার ছাতার নিচে থাকতে হবে প্রযুক্তির প্রসারণ, উঁচু মূল্যের ফসল উৎপাদনে স্থানান্তর, চলমান পুঁজির লভ্যতা যা কৃষিকে দেবে দারিদ্র্য হ্রাস করার অধিকতর শক্তি। 

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন