দেশের পর্যটন খাত জেগে উঠেছে

ড. সন্তোষ কুমার দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের পর্যটনের সংকট, সম্ভাবনা, ব্র্যান্ডিং, করোনা মহামারী-পরবর্তী অবস্থান এবং দেশে পর্যটন শিক্ষা ও ক্যারিয়ার নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম

করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ট্যুরিজম কেমন অবস্থানে রয়েছে?

কভিড-১৯-এর সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ পর্যটন শিল্প। আবার কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম যে পাঁচটি সেক্টরকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে পর্যটন কিন্তু উল্লেখযোগ্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি এ মুহূর্তে পর্যটনকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। যদি উন্নত দেশগুলোর কথা বলি, অস্ট্রেলিয়া যারা অন্যান্য শিল্পের ওপর এত বছর গুরুত্ব আরোপ করেছে, কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে দেখতে পাচ্ছি অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তারা ইনস্টাগ্রামে নতুন একটা পেজ খুলেছে। ‘আই লাভ অস্ট্রেলিয়া’ শিরোনামের পেজটি খুলে তারা আন্তর্জাতিক পর্যটক আকৃষ্টের চেষ্টা করছে। ইউরোপের দেশ চেক রিপাবলিক, যার রাজধানী রাহা, তারা ইনস্টাগ্রামে একটা পেজ খুলেছে ‘রাহা ওয়ার্ল্ড’। এর মাধ্যমে তারা এখন আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পর্যটনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। বাংলাদেশে কভিড-১৯ পরবর্তী এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম একটি জায়গায় রয়েছে অভ্যন্তরীণ পর্যটন। 

কভিড-১৯-এর সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বন্ধ হওয়ায় তখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের মার্চ থেকেই যখন কভিড-১৯-এর প্রভাব শুরু হয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছিল এ পর্যটন শিল্পে। তবে কভিডের প্রভাব কাটিয়ে পর্যটন এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। এখন পর্যটনের মৌসুম চলছে যেটি নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত থাকে, কিন্তু এ বছর যেহেতু মার্চের শেষের দিকে আমাদের ঈদুল ফিতর আছে, আমরা আশা করছি এ বছর পর্যটনের মৌসুম এপ্রিল পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এ জায়গা থেকে আমরা বলতে পারি পর্যটন মৌসুমটি বিগত বছরের চেয়ে এক থেকে দেড় মাস বাড়বে। 

বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বলুন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম ল্যান্ডমার্ক হতে পারে এ পর্যটন শিল্প। আমাদের দেশের প্রায় ৪৮ লাখ মানুষ এ পর্যটন শিল্পে সম্পৃক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটনে অনেক সম্ভাবনাময় একটি দেশ। আমাদের রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম স্যান্ডি সি বিচ কক্সবাজার, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। যেগুলো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। নদীমাতৃক এ বাংলাদেশে সাতশর বেশি নদী রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে রিভার ট্যুরিজমের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে হাওরভিত্তিক পর্যটন এখন খুব বেশি গ্রোআপ করছে। টাঙ্গুয়া, হাকালুকি, মিঠামইনসহ অন্য হাওরগুলো রয়েছে। সিলেটের যে চা বাগান রয়েছে, তার যে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ এবং টিলার ওপর সবুজের যে সমারোহ, যেটি পর্যটকদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। পর্যটকরা মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য দেখার জন্য চাঁদের গাড়ি নিয়ে সিলেটে যাচ্ছে। পর্যটন মৌসুমে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেটে প্রচুর পরিমাণ অভ্যন্তরীণ পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। 

কভিড-১৯ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম ভূমিকা রাখছে অভ্যন্তরীণ পর্যটক। এক্ষেত্রে ১৮-৩০ বছরের যে পর্যটক রয়েছে এ পর্যটকরাই কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের মুষ্টিমেয় অংশ। কভিড-১৯-এ পর্যটন শিল্প যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কভিড-পরবর্তী এ মুহূর্তে ৭০-৮০ শতাংশ রিকভারি কিন্তু হয়েছে। এভাবে কভিড যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেভাবে চলাচল করতে পারছে, এর ধারাবাহিকতা যদি ২০২৩ সালের পুরোটা সময় জুড়ে চলে তাহলে কভিডে পর্যটন যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেটি থেকে রিকভারি করা সম্ভব হবে। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরতে যাচ্ছে। কভিড-১৯ পরবর্তী অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যাপকভাবে জমে উঠেছে। এ জমে ওঠার অন্যতম একটি কারণ হলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানুষ যখন বাসায় ছিল, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা কাজ করত, এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা তাদের অবসর সময়টাকে রিক্রিয়েশনাল ওয়েতে পার করার জন্য বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে নিসর্গগুলো রয়েছে সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, কক্সবাজার, সুন্দরবন, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, হবিগঞ্জের চা বাগান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটিতে প্রচুর পরিমাণ অভ্যন্তরীণ পর্যটক যাচ্ছে। কভিড-১৯-এ মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো। কিন্তু আমরা এখন যেটি দেখতে পাচ্ছি কভিড-১৯-এর প্রভাবটি কমে যাওয়ার ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা, মনের আস্থার জায়গা যখন বেড়েছে, তখন আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরতে যাচ্ছি। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবারে এবং বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার এ দুটো দিন রাজধানী এবং ঢাকার আশপাশে যে হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলো রয়েছে সেগুলোয় শতভাগ অকুপেন্সি রেট থাকে। শনিবার বিকেলে তারা আবার ঢাকায় ফিরে আসে, রোববার থেকে আবার কর্মব্যস্ততা শুরু হয়, ঠিক আবার পরবর্তী উইকেন্ডে বৃহস্পতিবার, শুক্রবার আবার পর্যটকরা ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরতে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে দেখেছি যদি সরকারি ছুটি একদিন বৃদ্ধি পায়, সেটি যদি তিনদিনের ছুটি হয়ে যায়, তখন কিন্তু প্রচুর পরিমাণে পর্যটক কক্সবাজার থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন, সাগর কন্যা কুয়াকাটা যেখানে একই জায়গায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়, তার পাশে পায়রা বন্দরের গভীর সমুদ্রবন্দর দেখার জন্য যাচ্ছে। বাংলাদেশের পর্যটনে ব্যাপক একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ পর্যটক বাংলাদেশে আসছে। তারা এখন বিমানে না এসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আসছে, তাদের একটি লক্ষ্য পদ্মা সেতু দেখা। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে পদ্মা সেতু কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার একটি যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে। এ যোগসূত্র স্থাপন হওয়ার পর এখন পদ্মা সেতু দেখার পাশাপাশি গোপালগঞ্জে জাতির জনকের সমাধি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, কুয়াকাটা ও পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এ গন্তব্যগুলোয় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটকরা এ গন্তব্যগুলোতে ঘুরতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পর্যটনে প্রচুর ল্যান্ডমার্ক তৈরি করে দিয়েছে। আবার সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য দুই বছর ধরে কক্সবাজার থেকে ক্রুজ সার্ভিস চালু হয়েছে। সে ক্রুজগুলোয় মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার থেকে ৫/৬ ঘণ্টার জার্নিতে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছে। সেখানে দুইদিন থেকে সেন্ট মার্টিন থেকে তারা আবার ক্রুজে করে ফিরছে। কক্সবাজারে কিন্তু এ মুহূর্তে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। এ মুহূর্তে ধারণ সক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটক যখন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরতে যাবে, তখন ওই এলাকার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। মানুষ যখন ঘুরতে যায়, যারা হোটেল, মোটেল, রিসোর্টের ব্যবসা করে তাদের ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান কিন্তু বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের নতুন কিছু গন্তব্য বা পর্যটনের গন্তব্য সেগুলো কিন্তু পর্যটকরাই বেশি আবিষ্কার করেছে। ব্যাগ পেকাররা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে নতুন ছবি দিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমে তারা যে ছবি প্রচার করেছেন, সে ছবি দেখে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা জেগেছে এ জায়গাটা তো অসম্ভব সুন্দর, আমারও তাহলে এ জায়গা দেখতে যাওয়া প্রয়োজন। এভাবেই অধিকাংশ পর্যটন স্পটের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। যাই হোক বাংলাদেশের পর্যটনের যে সম্ভাবনা, এভাবে যদি পর্যটন এগিয়ে যেতে থাকে তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে বছরটি রয়েছে, সে সময়ের মধ্যেই কিন্তু অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তবে এ সম্ভাবনা যদি ধরে রাখতে চাই তাহলে বিদেশী পর্যটক আকর্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের আরো বেশি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। 

বিদেশীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগ কি যথার্থ বলে আপনি মনে করেন? এক্ষেত্রে কী করণীয় রয়েছে?

বিদেশী পর্যটক আকর্ষণের জন্য আমাদের অনেক প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন স্পট রয়েছে। ম্যান মেইড, আর্কিওলজিভিত্তিক পর্যটন গন্তব্য রয়েছে। তবে আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জায়গায় অনেক বেশি ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা গন্তব্যগুলোর উপযুক্ত ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া যেভাবে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছে, আমরা সে জায়গাটিতে এখনো যেতে পারিনি। আমরা একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত বিস্তারের কথা বলছি। প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রি যখন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্র্যান্ডিংটা খুবই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইনস্টাগ্রামে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ পেজ হতে পারে, ফেসবুকে গন্তব্যের ছোট ছোট প্রমো শেয়ার করতে পারি, সে প্রমোগুলোর নিচে যদি বর্ণনা এবং ছবি থাকে, সেভাবে কিন্তু আমরা পেজের প্রমোশনগুলো চালাতে পারি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড যারা বাংলাদেশের পর্যটনের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য কাজ করছে, এক্ষেত্রে মুজিব’স বাংলাদেশ, যে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংটি ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু এক বছরের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু আমাদের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হলো ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’। একটি হচ্ছে ইয়ার কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং, আরেকটা হচ্ছে ওভারঅল কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং। সুন্দরবনে ভারতের অংশে প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক পর্যটক রয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ অংশে সে পরিমাণ পর্যটক এখনো আমরা আকৃষ্ট করতে পারিনি। আমাদের পর্যটন আকর্ষণকে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এবং বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসার দেশের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি করা যায়। এবং ই-ভিসাও যদি আরেকটু দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে হয়তো আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা অল্প সময়ের মধ্যেই বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে দুটো পয়েন্ট বলতে চাই, আন্তর্জাতিক পর্যটকের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু আকর্ষণীয় প্যাকেজ ডিজাইন করতে হবে। যে প্যাকেজগুলোর মূল লক্ষ্য হবে একজন পর্যটক যখন দেখবে আমি থাইল্যান্ডে না গিয়ে থাইল্যান্ডের চেয়ে কম খরচে বাংলাদেশে উন্নত সেবা এবং সুবিধাগুলো পাব এবং পর্যটনের সেবাটা নিশ্চিত হবে। সেক্ষেত্রে কিন্তু একজন পর্যটক বাংলাদেশে আসবে। এ জায়গায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আকর্ষণীয় এবং প্রতিযোগিতামূলক প্যাকেজ যদি পর্যটকদের জন্য অফার করতে পারি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের আরো বেশি তৎপরতা প্রয়োজন। কারণ প্রমোশনাল ব্র্যান্ডিং একটি দেশের পর্যটনের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। সে জায়গাটিতে আরো বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করার প্রয়োজন আছে। এখন ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। আজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে কন্টেন্ট মার্কেটিং, ই-মেইল মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি চমৎকার একটি ওয়েবসাইট প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমের মার্কেটিং, পিআর গ্রুপ মার্কেটিং। এ জায়গাগুলোয় আমাদের অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ব হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, হোটেলগুলোয় রোবোটিক সার্ভিস, সেন্সর বেজড সার্ভিসগুলো চালু হয়েছে, থিংস অব ইন্টারনেটের প্রয়োগ রয়েছে। বিগ ডাটার যে জায়গাটি রয়েছে, সেটি কিন্তু নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এভাবে আন্তর্জাতিক মানগুলো যদি আমরা ফাইভ স্টার, ফোর স্টার, থ্রি স্টার হোটেলগুলোয় আনতে পারি তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যটকের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যাও বাড়বে। 

পর্যটন নিয়ে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং কি পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে?

পর্যটন নিয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পিত ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি তিনটি ধাপে এ ব্র্যান্ডিং দরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান যেটি হচ্ছে, এটি থেকে আগামী ২০ বছর পর বাংলাদেশের পর্যটন কোথায় যাবে, তার গাইডলাইন কী হবে, কোন ধারায় আমরা পর্যটন ক্ষেত্রগুলোকে এগিয়ে নিতে পারি, সেগুলো আমাদের একটা দিকনির্দেশনা দেবে। এটি যত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে, পর্যটনসংশ্লিষ্ট যত স্টেকহোল্ডার আছে তারা একটা গাইডলাইন পাবে, সেটি বাংলাদেশের পর্যটন প্রসারের জন্য অন্যতম একটি ভূমিকা রাখবে। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা খু্বই প্রয়োজন। আমাদের দেশে ১৬ শতাধিক পর্যটন আকর্ষণ স্থান রয়েছে। এ পর্যটন আকর্ষণগুলোর ক্ষেত্রে এখন জেলাভিত্তিক ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। প্রত্যেক জেলায় কিছু নিদর্শন, শিল্প স্থাপনাসহ কিছু ইতিহাস রয়েছে। এবং সেখানকার কিছু আকর্ষণীয় গন্তব্য রয়েছে। সে গন্তব্যগুলোকে যদি আমরা ব্র্যান্ডিং করতে পারি, তাহলে ডিস্ট্রিক্ট ব্র্যান্ডিংটা হতে পারে। যার ফলে ‍শুধু একটি বা দুটো জায়গায় পর্যটক ভিড় করবে না, যখন এ পর্যটকদের আমরা ডাইভার্সিফাইড করে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করে দিতে পারব, মানুষ একেক সময় একেক জেলায় ভ্রমণ করবে, তাহলে আন্তঃজেলার আর্থসামাজিক যে অবস্থা, সেটি বৃদ্ধি পাবে। আন্তঃজেলায় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কারণ একজন পর্যটক গেলে সে ওখানকার হোটেলে থাকে, সেখানকার স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে, স্থানীয় পরিবহন ব্যবহার করে, তারপর সেই সঙ্গে স্থানীয় হেরিটেজ যেগুলো আছে, যেগুলোকে আমরা বলি আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট বা সে অঞ্চলের ছোট ছোট কিছু শিল্পকর্ম, সেগুলো কিনে বাসায় এনে রাখে। এক্ষেত্রে অনেকগুলো মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিন্তু হয়। সব মিলিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান সমৃদ্ধ করা এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির অন্যতম একটি জায়গা হচ্ছে পর্যটন। উন্নত দেশের কথা যদি বলি, ফ্রান্সে প্রচুর পরিমাণ পর্যটক আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম দেখার জন্য ভিড় করছে। জার্মানিও পর্যটনের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ভ্রমণের জায়গাগুলোয় আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে। 

ব্র্যান্ডিংয়ের জায়গাটিতে দুটি ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং এবং তার পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল ব্র্যান্ডিং। ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংয়ের কথা এজন্য বলছি- এখন আমাদের পর্যটক যারা রয়েছে তার মধ্যে অধিক সংখ্যক পর্যটক হলো তরুণ। ১৮-৩০ বছরের যে পর্যটক রয়েছে, তাদের সংখ্যা পর্যটকদের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ। তাহলে এই যে মেজরিটি সংখ্যক পর্যটক যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করে, যারা স্মার্টফোনের মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত পেতে চায়, সে মানুষগুলোকে পর্যটনে আকৃষ্ট করার জন্য একটি গন্তব্যের ব্র্যান্ডিং ও প্রমোটের ক্ষেত্রে সে গন্তব্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ তারা দিনের ৪-৫ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করে, তারা কোনো এক জায়গায় ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ওয়েবসাইটে গিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে, কী কী সুযোগ-সুবিধা সেখানে রয়েছে, অ্যাকোমডেশন, খাবারের সুবিধা, স্থানীয় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ খাবার সম্পর্কে খোঁজ নেয়। আমি বলব সে ক্যাটাগরির গ্রাহকদের ধরে রাখার জন্য অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া ব্র্যান্ডিং, ডিজিটাল মার্কেটিং খুবই প্রয়োজন। আবার আমাদের সিনিয়র সিটিজেন রয়েছে। তারা ডিজিটাল ইনফরমেশনের প্রতি এতটা অভ্যস্ত না। অনেকেই এখনো অ্যানালগ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। সে মানুষগুলোকেও ধরে রাখার জন্য ট্র্যাডিশনাল যে মার্কেটিং পলিসি রয়েছে, সে প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বারোপ করতে হবে। সময় এসেছে হাইব্রিড প্রসেস বা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া যেটা ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং দুটোর মিক্সড অ্যাপ্রোচ মিলিয়ে আমরা যদি ব্র্যান্ডিংটা করতে পারি, তাহলেই কিন্তু দেশের সিনিয়র সিটিজেন থেকে শুরু করে তরুণ যে ট্যুরিস্ট রয়েছে তাদের আকৃষ্ট করতে পারব। আর ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংটা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য একান্ত প্রয়োজন, এর বিকল্প কিছু নেই। 

আমাদের দেশে পর্যটন খাত নিয়ে অধ্যয়ন এবং এ খাতে ক্যারিয়ার গড়ার কেমন সুযোগ রয়েছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের পথপ্রদর্শক। আমরাই প্রথম এটি শুরু করেছিলাম। এখন বাংলাদেশের সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশকিছু কলেজে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে। ঠিক তার পাশাপাশি আরো কিছু ট্রেনিং সেন্টার, ইনস্টিটিউট রয়েছে। যেখানে ডিপ্লোমা আর সার্টিফিকেট কোর্সগুলো হচ্ছে। একটি দেশের পর্যটন কত দূর এগিয়ে যাবে বা পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা যদি আমরা নির্ধারণ করতে চাই, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ কতটা তৈরি করতে পারছি, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগ থেকে ১০টি ব্যাচ গ্র্যাজুয়েশন করে বের হয়েছে। অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে, এর মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ ছেলে-মেয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার গ্রোআপ করছে। পাঁচ তারকা মানের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল ঢাকা, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, ওয়েস্টিন ঢাকা, র‌্যাডিসন ব্লু, রিজেন্সি ঢাকা থেকে শুরু করে সি পার্ল, রয়েল টিউলিপ, প্যালেসসহ যেসব পাঁচ তারকা রিসোর্ট রয়েছে সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। এ হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্যারিয়ার গড়ছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প, ধীরে ধীরে গ্রোআপ করছে। বাংলাদেশে পর্যটন জেগে উঠেছে। পর্যটন খাত যেভাবে তৈরি হয়েছে, এ খাতে ক্যারিয়ারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে আমরা বলি গ্ণোবাল ক্যারিয়ার। কেউ যদি ওয়েস্টিন, ঢাকা বাংলাদেশে চাকরি করে সে কিন্তু ওয়েস্টিন দুবাইয়ে চাকরি করতে পারবে। এখানে অল্প সময়ে বড় একটি জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন