দেশে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে

তৃণমূলে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা সম্প্রসারণ করুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

দেশে প্রতি পাঁচজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মানুষের কর্মক্ষমতা উৎপাদনশীলতার ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয়। উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে পরিবেশ দূষণ খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আশঙ্কার বিষয় হলো, শহর গ্রামে সমানভাবে উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে। কিন্তু রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসা কার্যক্রম সম্প্রসারণ হচ্ছে না। এখনো রাজধানীকেন্দ্রিকই বিশেষ রোগের চিকিৎসা। এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি তৃণমূলে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসাসেবা  সম্প্রসারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা প্রয়োজন।

প্রতি বছর বিশ্বে চার কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতা প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগের অন্যতম। দুটি সমস্যা থেকে সরাসরি স্ট্রোক, হৃদরোগ, হৃদযন্ত্র বিকল, অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন, রক্তনালির রোগ হতে পারে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে দেখা দিতে পারে কিডনি ফেউলিউর, ডেমিনশিয়ার মতো জটিলতাও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি চারজনের একজন পুরুষ এবং পাঁচজনে একজন নারী উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। ইউনিসেফ পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রংপুরের মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এসব এলাকার আরো ১৪ শতাংশ মানুষের রয়েছে ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি। বাংলাদেশে নারীদের তুলনায় পুরুষদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার হার তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি ৩৬ শতাংশ মানুষ স্থূলতার ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বাড়বে। সুরক্ষায় সব প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন যেমন, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার করা, ফাস্টফুড ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা, ধূমপান না করা, নিয়মিত ব্যায়াম শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ট্রান্সফ্যাট ঘটিত হৃদরোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারকেখাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হবে।

সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে চিকিৎসাসেবা। সরকার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স করেছে; তৃণমূলে কমিউনিটি ক্লিনিক করেছে। এসব নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিশেষায়িত হাসপাতাল ঢাকাতেই; অন্য কোথাও নেই। যৌক্তিক প্রয়োজনেই প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরে এবং পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে কার্যকর রেফারেল সিস্টেমও গড়ে তুলতে হবে। ভুললে চলবে না, সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সাংবিধানিক নির্দেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় রাষ্ট্রের অঙ্গীকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৮-তে বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির উন্নয়ন জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। আর জনস্বাস্থ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ চিকিৎসাসেবা। রাষ্ট্র দায়ভার বহনে অস্বীকার করতে পারে না।

পাশের দেশ ভারতে একেক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। যেমন দিল্লিতে বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল, চেন্নাইয়ে চোখের বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশেও বিশেষায়িত হাসপাতালের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। অব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার অভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অবকাঠামো থাকলেও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকের সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি অনুপস্থিত থাকছেন নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই। বিশেষ করে দুর্গম এলাকাগুলোয় চিকিৎসকের অনুপস্থিতি রোগীর বড় ধরনের দুর্ভোগের কারণ। আবার চিকিৎসক থাকলেও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ। ফলে অবকাঠামো থাকলেও সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতার কার্যকারিতা নেই রোগীর চিকিৎসায়। স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে বলছে, বাংলাদেশ মোট জিডিপির শতাংশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন করে; যা সমকক্ষ উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কম। এর মধ্যে মাত্র শতাংশ অর্থায়ন সরকারি খাত থেকে আসে। বাকি অর্থায়ন আসে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে। সরকারি খাতে আমাদের অবকাঠামো দুর্বলতা কম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে বার্ষিক বরাদ্দ জিডিপির - শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেখানে ভারতে জিডিপির দশমিক ৫৪ শতাংশ (২০১৮) এবং নেপালে দশমিক ৮৪ শতাংশ (২০১৮) ভবন আছে কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই। আবার যন্ত্রপাতি থাকলেও তার ব্যবহার নেই। অর্থাৎ সক্ষমতা যা আছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। সমস্যা পরিকল্পনায়। যুগোপযোগী পরিকল্পনা করতে পারলে এত সমস্যা হতো না। উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো পড়ে আছে, চিকিৎসক, নার্সের মতো জনবলও হয়তো দেয়া আছে কিন্তু কোনো কিছুরই কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে একটা সমন্বিত প্রয়াস তদারকি দরকার।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেশকিছু নীতি কর্মপরিকল্পনা থাকলেও বিষয়ে দেশব্যাপী উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই। সরকার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর (রিলেটিভ রিডাকশন) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সুতরাং সঠিক নিয়মে উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সব হাসপাতাল এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা এবং ওষুধ প্রদান নিশ্চিত করতে খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় কমিউনিটি ক্লিনিক ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বিশেষায়িত রোগ শনাক্ত চিকিৎসা প্রদানের মতো উপযুক্ত নয়। এমনকি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধও নাকি পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা সম্প্রসারণ, পরীক্ষার ব্যবস্থা ওষুধ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে রাজধানীতে অবস্থিত হাসপাতালগুলোর পক্ষে রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।

জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি সেবার সম্প্রসারণ করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের পদমর্যাদা উন্নীত করতে হবে, সে সঙ্গে কমপক্ষে তিনটি অতিরিক্ত সিভিল সার্জনের পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। জেলা সদর হাসপাতালগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে জেলার স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত এবং নতুন পদ সৃষ্টি করে জনবল বৃদ্ধি করা যেতে পারে। জেলা সদর হাসপাতালগুলোয় ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার (ইএমও), মেডিকেল অফিসার, বিশেষজ্ঞদের নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব বিভাগে স্পেশালিস্ট পদ তৈরি করতে হবে। জেলা সদর হাসপাতালগুলোয় স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসিইউ, সিসিইউ, অপারেশন থিয়েটারের সঙ্গে সিটি-এমআরআইসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। টারশিয়ারি স্পেশালাইজড হাসপাতালগুলোয় স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এবং বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সেবাদানের লক্ষ্যে নতুন পদ তৈরি এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত শক্তিশালী স্বাস্থ্য অবকাঠামো আছে। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্য সহকারী পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা রেখে কয়েক স্তরে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো পরিচালনা করতে সরকার অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু জনগণ ব্যয়ের সুফল খুব অল্পই পাচ্ছে। অবকাঠামোর ভেতরেই আরো উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব ছিল কিন্তু পারছে না। এর প্রধান কারণ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীর অপ্রতুল সরবরাহ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। তবে কাঙ্ক্ষিত উচ্চমানে স্বাস্থ্যসেবাকে নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই বাড়তি বাজেটের সংস্থান এবং স্বাস্থ্য খাতে জনশক্তি বৃদ্ধি তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন