সম্প্রতি বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাৎসহ বেআইনি সুবিধা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে তার এ মন্তব্য তাত্পর্যপূর্ণ বটে। এসব অনিয়ম প্রতিরোধ ও দায়ীদের শাস্তি বিধানের দায়িত্ব কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দেননি। এক্ষেত্রে হুমকি হয়ে ওঠা ট্রাস্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা। নইলে ক্রমে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তো বটেই সমাজ ও অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে ‘অলাভজনক’ হলেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ আয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সিন্ডিকেট-একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে চলার কথা এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত অফিসের মতো চালাচ্ছেন কেউ কেউ। এমন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ২৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। কিছু অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আর কিছু সরাসরি ইউজিসিতে জমা পড়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে চিঠি পাওয়া গিয়েছে। ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটির তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ও প্রশাসনের দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশির ভাগই আর্থিক। এছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব, অবৈধভাবে চাকরিচ্যুতি, উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা না দেয়ার ঘটনাও আছে। শিক্ষক সংকট, এমনকি সনদ বাণিজ্যের মতো অভিযোগ আছে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার হতে পারত, যদি সেভাবে এগুলো পরিচালিত হতো। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী আসা শুরু করেছিল এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, বর্তমানে সেভাবে আসছে না, যারা আসছে তারা এসব দেখে তাদের দেশে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতির খবর পৌঁছে দেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের কাজের ক্ষেত্র আলাদা করে দেয়া আছে। আইন অনুযায়ী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের কাজটি তিনিই করেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখেন উপাচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে উপাচার্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না কিছু ট্রাস্টি বোর্ড। এমনকি পছন্দসই ‘ডামি’ উপাচার্য বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখার অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো ট্রাস্টির বিরুদ্ধে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অংকের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা ব্যবহার, সমালোচনার মুখে পড়ে তা আবার ফেরত দেয়ার মতো অভিযোগও আছে। সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের গ্রেফতার ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ভর্তিবাণিজ্যের কথাও শোনা যাচ্ছে দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচার করার অভিযোগ আছে, আছে শিক্ষকদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির অভিযোগ। এমন প্রবণতা বন্ধ না করা গেলে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিম্ন হতে বাধ্য। ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।
ভারতে তিন পদ্ধতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়। এক. বিদ্যমান সোসাইটি অ্যাক্টের আওতায়, ২. বিদ্যমান ট্রাস্টি আইনের আওতায়, ৩. কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন আইনের আওতায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কোম্পানি ও সংস্থার আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালিত হচ্ছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ব্যতীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সম্ভব নয়। কিন্তু কেন? কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন বা সংস্থার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ‘কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন বা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হলে উদ্যোক্তাদের আর্থিক অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে।’ মোটেই অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে না। যদি আইনের মধ্যেই উদ্যোক্তাদের নিয়মমাফিক আর্থিক সুবিধা বা সম্মানী গ্রহণের ব্যবস্থা থাকে তাহলে অনিয়মের প্রশ্নই ওঠে না। তার পরও যদি কেউ অনিয়ম করে, সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়ই সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধনী এমনভাবেই হওয়া উচিত যাতে কেউ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনিয়ম করার সুযোগ না পায় এবং যুগোপযোগী আইনি কাঠামোর মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার একটি মজবুত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত ক্ষেত্র। উন্নত গবেষণা হবে যা দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যবহূত হবে। এখান থেকে তৈরি হবে আদর্শ মানুষ, প্রকৃত বিজ্ঞানী, গবেষক, উঁচু মানের শিক্ষক আর এগুলোর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত ও অবারিত সুযোগ। কিন্তু কী হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়? উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র, বিশেষত কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক স্বেচ্ছাচারিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই প্রচলিত আইনগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। আর্থিক অনিয়ম, অর্থ বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগদানে বিরত থাকা, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে যেনতেন উপায়ে শিক্ষাক্রম চালিয়ে নেয়ার ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। ইউজিসির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে লিখিতভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফলে এসব অনাচারে কেবল শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, উচ্চশিক্ষার সংস্কৃতিটাই মুনাফার লোভে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রের এ দৈন্যদশা বিকাশমান একটি দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশে স্থাপিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি কোনো সহায়তা দেয়া হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পেছনে রাষ্ট্রের কোনো খরচ নেই। কিন্তু একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের খুব বেশি তারতম্য নেই। বাস্তবতা হলো, বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এগিয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে সরকারি তহবিল জোগান দেয়া হয়। এছাড়া ধনী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারও বিপুল অংকের সহায়তা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রবণতা অনুপস্থিত বলা যায়। এক্ষেত্রে আইনের সংস্কারও করতে হবে যাতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অর্থের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষা গবেষণায় সহায়তা জোগাতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সুশাসনের চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। সেজন্য প্রয়োজন ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’-এর আলোকে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব সুলিখিত বিধিমালা থাকা। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শর্ত হচ্ছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ও অন্যান্য উৎস থেকে আয়-ব্যয়ের হিসাব বিবরণী, বাজেট প্রণয়ন থেকে শুরু করে কোন খাতে কত বরাদ্দ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং মানসম্মত গবেষণায় কত বরাদ্দ—এর কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূর করার জন্য উদ্যোক্তাদের নিয়ে উদ্যোক্তাবান্ধব আইনের খসড়া প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি ওই আইনি কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় কিনা সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, সরকার/ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কঠোর তদারকি প্রয়োজন। শুধু আইনি সংশোধনের মাধ্যমে বা উদ্যোক্তাদের হাত-পা বেঁধে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাবান্ধব আইনি কাঠামোর মাধ্যমে প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে পাঁচ, দশ বা বিশ বছর মেয়াদি শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ওই কর্মপরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা বা সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।