দেশ ও দল পুনর্গঠনে শেখ হাসিনার সংগ্রাম

শরীফ এনামুল কবির

প্রতিষ্ঠার পর থেকে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যৌক্তিক গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক সামাজিক সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে দলটি। জাতির ক্রান্তিকালে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বদা মানুষের পাশে থেকেছে আওয়ামী লীগ। গণমানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর হাতে বেড়ে ওঠা দলটিকে গণমানুষের সংগঠনে পরিণত করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পর নানা চড়াই-উতরাই শেষে অভিভাবকহীন সংগঠনের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। দীর্ঘ চার দশক ধরে তিনি সংগঠনের প্রধান হিসেবে দেশের মানুষের হয়ে তাদের দাবি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সফলভাবে কাজ করছেন। তিনি কখনো সরকারপ্রধান হিসেবে, কখনো বিরোধীদলীয় প্রধান নেতা হিসেবে, কখনো আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে মানুষের অধিকারের প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ রয়েছেন। মানুষের জন্য কাজ করায় শেখ হাসিনা স্থান পেয়েছেন মানুষের হূদয়ে। শেখ হাসিনার অর্জন আওয়ামী লীগের অর্জন। আওয়ামী লীগের অর্জন দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের অর্জন।

নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও চার দশক আগে ১৯৮১ সালের ১৭ মে রোববার শেখ হাসিনা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ছয় বছরের প্রায় বাধ্যতামূলক প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে ফেরেন। যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকার মাটি স্পর্শ করে, বাংলার মানুষের মনে তখন উচ্ছ্বাসের হাওয়া বইছিল। ঢাকার বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে লাখো মানুষ অভিবাদন জানাতে আসে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। সারা দেশের গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর থেকে লাখো মানুষ জড়ো হয় রাজধানীতেশেখ হাসিনাকে একনজর দেখতে, অভিবাদনের জোয়ারে ভাসিয়ে নিতে। শেখ হাসিনাকে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি সেদিন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও উচ্চারিত হতে থাকে বজ কঠিন ধ্বনি।

ভারতে অবস্থানরত অবস্থায় শেখ হাসিনাকে দলের নেতা নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগ। তরুণ বয়সে এই বৃহৎ সংগঠনের দায়িত্ব নিতে হয় শেখ হাসিনাকে। দেশে ফিরে তিনি দলকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসনে পিষ্ট নেতাকর্মী দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। দেশে ফিরে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সেদিন তিনি বলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলকে এবং বাকি সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।দেশে ফেরা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ যখন আমাকে সভানেত্রী নির্বাচিত করল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে আসবই। ১৯৮১ সালে আমি যখন দেশে ফিরে আসি তখন দেশের অবস্থা কেমন ছিল? জাতির পিতার খুনিরা অবাধে ঘোরাফেরা করত। দেশে জয়বাংলা স্লোগান দেয়া যেত না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিষিদ্ধ ছিল। আমি মানুষের কাছে গেছি, আমি জানতাম, আমার তো অন্য কোনো জায়গা নেই। আমার জায়গা তো বাংলাদেশের মানুষের কাছে, জনগণের কাছে। আমি সভা-সমাবেশে যেতাম, পিতৃহত্যার বিচার চাইতাম।

বাধ্যতামূলক প্রবাস জীবন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় অতিথি হিসেবে অবস্থান করছিলেন। রাষ্ট্রদূত যখন জানলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন তখন বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়কে তার বাসা থেকে বের করে দেন। তখন জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে ব্রাসেলস থেকে বন শহরে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সানাউল হককে অনুরোধ করেন। সানাউল হক এতে অস্বীকৃতি জানালে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বিশেষ ব্যবস্থায় দুই বোনকে সেদিনই জার্মানির বনে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে নিয়ে আসেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসভবনেই অবস্থান করেন। ১৯৭৫-এর ১৯ আগস্ট ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সহায়তায় নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তাদের পরিবারকে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ এবং পরিচয় দেয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। এক সাক্ষাত্কারে শেখ রেহানা বলেন, ‘দিল্লি থাকাকালীন আমাদের নামও পরিবর্তন করে থাকতে হয়েছে। মিস্টার তালুকদার, মিসেস তালুকদার, মিস তালুকদার। যেন আশেপাশে কেউ আমাদের কথা জানতে না পারে। আমি প্রথমে বললাম, দেশ ছাড়া, ঘর ছাড়া, বাবা-মা ছাড়া, এখন নামও বদলাব!’

সে সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবর ছাপা না হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাননি বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়। তখনো তাদের আশা ছিল, পরিবারের কেউ হয়তো এখনো বেঁচে আছে। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পরে শেখ হাসিনা ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ জানতে পারেন।

দলের দায়িত্বগ্রহণ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দলের দায়িত্বভার নেয়ার পর সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থক  স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিসবার মাঝে সাহস উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। মূলত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেই লুকিয়ে ছিল আওয়ামী লীগের পুনর্জীবনের মূল প্রণোদনা। ততদিনে দেশে একাত্তর পঁচাত্তরের খুনি চক্র, আওয়ামী লীগ দেশবিরোধী শক্তি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির যৌথ প্রয়াসে একটি রাজনৈতিক ধারা গড়ে ওঠে। তারা সমাজ রাজনীতির নানা স্তরে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলীয় প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাজনীতির মঞ্চে তখন দ্রুত সব পরিবর্তন ঘটছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জেনারেল জিয়ার প্রস্থান, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ, বিএনপি প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়ার আগমন রাজনীতিতে নিত্যনতুন মেরুকরণ তৈরি করে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজনীতির মাঠ গুছিয়ে নিতে এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নানা ঝক্কি পোহাতে হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দাবিতে তিনি সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয় ১৫ দলীয় জোট। জোট সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্র আন্দোলন দমানোর জন্য সামরিক শাসনের পক্ষে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে নির্বিচারে লাঠিচার্জ গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পরদিন ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। ফের ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নভেম্বরে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৫ সালের মার্চে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং তিন মাস কারাবন্দি করে রাখা হয়। শত জেল-জুলুম উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতন পর্যন্ত চলমান থাকে।

১৯৯৬- আওয়ামী লীগের সরকার

১৯৯১ সালে যেনতেন এক নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে জেনারেল জিয়ার দল বিএনপি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলটির ক্ষমতাগ্রহণ সরকার পরিচালনা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সরব ছিলেন অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে ১৯৯৩-৯৪ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে সংসদ রাজপথে অবস্থান নিলে ধারণা জনপ্রিয় হয়। ১৯৯৪ সালে মাগুরা- আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করে। নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ। বিএনপি সরকার জনগণের দাবি মেনে না নেয়ায় ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি জামায়াতের ১৪৭ জন সংসদ সদস্য। ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই সংসদীয় আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়। শূন্য আসনগুলো উপনির্বাচনের আয়োজন করতে উদ্যোগী হয় বিএনপি সরকার নির্বাচন কমিশন। বিরোধী দলগুলো উপনির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি আরো জোরদার হয়।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করে তা প্রতিরোধের ডাক দেয়। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়ে ২৭৮টি আসন লাভ করে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অর্জনের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬ পাসের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নিহতদের মৃত্যুর তদন্ত খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন, যা আওয়ামী লীগ সরকারের বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪১ দিনের মাথায় খোন্দকার মোশতাকের সরকার হত্যাকাণ্ডের বিচার আজীবনের জন্য বন্ধ করার লক্ষ্যেইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সজারি করে। বাংলার মানুষ ভাবতেও পারেনি যে এই বাংলায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং সামরিক আইন জারিতে কোনো ধরনের আইনগত হস্তক্ষেপ যেন কেউ করতে না পারে। এটি ছিল খুনি চক্রকে বাঁচানোর পাকাপোক্ত একটি প্রক্রিয়া।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ২৩ জুন প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে। তত্কালীন আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদেদি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট ১৯৯৬শিরোনামে একটি বিল উপস্থাপন করেন। সেদিন জাতির পিতার হত্যাকারীদের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে। এর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী মোশতাকের করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল হয়। অধ্যাদেশটি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতাবিরোধী ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খুলে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডের রায় আংশিক কার্যকর হয়। বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। এর আগে ২০০২ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজিজ মারা যায়। অবশিষ্ট ছয়জন এখনো পলাতক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। অতিসম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আত্মগোপনে থাকা ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ পালিয়ে ফিরলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছে, তারা মিলে দেশের নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা, লুটতরাজ চালিয়েছিল। ফলাফল হিসেবে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং আড়াই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারায়। কোটি বাঙালি জীবন বাঁচাতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে দেশ ছাড়লেও বিচারহীন অবস্থায় থেকে যায় তাদের দেশীয় সাহায্যকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রাণপণ কাজ করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রায় কার্যকরের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটির কিছু তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তন করে, যাতে অপরাধীরা কোনোভাবে অনৈতিক সুবিধা না পায়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ অফিশিয়াল গেজেটের মাধ্যমে তিনজন বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে মানবতাবিরোধীদের বিচারের আওতায় আনার পথ সুগম হয়।

 

শরীফ এনামুল কবির: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন