ফিরে দেখা

সত্তরের নির্বাচন: মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু

আবুল কাসেম ফজলুল হক

১৯৬২ সালে জননেতা কে ফজলুল হক মারা যান। ১৯৬৩ সালে মারা যান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। খাজা নাজিমউদ্দিন মারা যান ১৯৬৪ সালে। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়। মওলানা ভাসানী জনপ্রিয় নেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। তবে তার নেতৃত্বে কোনো দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে এমন চিন্তা তার ছিল না। অবস্থায় ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার এবং পরে পাকিস্তানভিত্তিক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হন।

শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফা কর্মসূচিকে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি মনে করেন। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব নেতাই শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নেতা মনে করতে থাকেন। আইয়ুব সরকার জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন ছয় দফা আন্দোলন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের যথাসম্ভব বিরোধিতা করতে থাকেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। সে সময় ভাসানী ন্যাপ থেকে এবং আওয়ামী লীগ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের নানা তথ্য প্রচারপত্র পুস্তিকার মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে।

ওই পরিস্থিতিতে নৌবাহিনীর লে. . মোয়াজ্জেম হোসেন   তিনজন সিএসপি অফিসার নৌবাহিনীর কিছু সদস্য নিয়ে অত্যন্ত গোপনে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈঠক করে সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবছিলেন। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী প্রচেষ্টার কথা জেনে যায়। তখন সরকার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত জনা ত্রিশেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়। মামলার নাম দেয়া হয় স্টেট ভার্সাস লে. . মোয়াজ্জেম হোসেন অ্যান্ড আদার্স। মাসখানেক পর প্রক্রিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সংযোগ আছে বলে তাকেও মামলায় আসামি করা হয়। তখন মামলার নাম দেয়া হয় স্টেট ভার্সাস শেখ মুজিব অ্যান্ড আদার্স। বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান প্রক্রিয়ায় থেকে আগরতলা গিয়ে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এতে দিল্লি সরকারের সমর্থন লাভের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। আইয়ুব সরকার জুলফিকার আলী ভুট্টো এমনভাবে প্রচার চালাচ্ছিলেন যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় সব আসামির মৃত্যুদণ্ড হবে। তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মামলার সব আসামির প্রতি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি প্রবল অনুরাগ সহানুভূতি প্রদর্শন করতে থাকে। ভুট্টো এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করে নিজের নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাতে থাকেন।

স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার বিচার শুরু করা হলে সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। মামলার সব আসামিকে তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। সে অবস্থায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগের প্রায় সব নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। সরকারি মুসলিম লীগ তার সহযোগী সংগঠন ছাত্র সংগঠন এনএসএফের কর্মীরা তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মারমুখো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বামপন্থীরাও তখন তাদের নির্যাতনের মধ্যে পড়ে যায়।

সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবিতে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবল আন্দোলন চলছিল। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এক বেতার ভাষণে জানান যে তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না; তবে তিনি দেশে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করে যাবেন। আন্দোলনকারীরা তখন বুঝে নেন যে আইয়ুব খানের মনোবল ভেঙে গেছে। তখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী অন্যান্য শহরেআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করো, শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও, রাজবন্দিদের মুক্তি দাওইত্যাদি স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগ বামপন্থী দলগুলো আন্দোলন চালাতে থাকে। প্রায় সব দল তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন দিতে থাকে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্দোলন তখন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গণঅভ্যুত্থান পশ্চিম পাকিস্তানেও হয়। মওলানা ভাসানী তখন মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান অন্য সব আসামির মুক্তি দাবি করেন। তখন গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে বিনা শর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং আসামিদের মুক্তি দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ঊনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভা করে তাকেবঙ্গবন্ধুউপাধি দেয়। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ।বঙ্গবন্ধুউপাধি দেয়ার প্রস্তাব তিনিই করেছিলেন এবং হাততালি দিয়ে সবাই তা গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জনসমর্থন তখন তুঙ্গে।

১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে পল্টন ময়দানে জনসভা করে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী। পরে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীসহ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি) স্বতন্ত্রভাবে গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা দিলে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাসানী সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে যোগ না দিয়ে ঘেরাও আন্দোলন চালাতে থাকেন। তার সঙ্গে ছিল পিকিংপন্থী বলে পরিচিত বামপন্থী দলগুলো এবং শ্রমিক ফেডারেশন কৃষক সমিতি। মস্কোপন্থী দলগুলো ক্রমে আওয়ামী লীগের সমর্থনে গিয়ে আন্দোলনে যুক্ত থাকে। মওলানা ভাসানীর জনপ্রিয়তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তবে তার অনুসারী যে বামপন্থীরা ছিলেন, তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল না এবং কোনো গ্রুপের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না। ন্যাপের মধ্যেও সে আকাঙ্ক্ষা ছিল না।

ডানপন্থী দলগুলোও তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে থাকে। তবে তারা পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িকতাবাদী বক্তব্যও অব্যাহত রাখে। ডানপন্থীদের মধ্যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীকে সক্রিয় দেখা যায়, অন্য ডানপন্থীরা তখন গোটা অবস্থাকে আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ অনুকূলে দেখে মনোবল হারিয়ে ফেলে। পরে ১৯৭০-এর নির্বাচনে কনভেনশনাল মুসলিম লীগের কিছু সদস্য আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আবদুস সবুর খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সবুর খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের কিছু সদস্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জামায়াতে ইসলামী জিয়াউর রহমানের শাসনকালে পুনরুজ্জীবিত রাজনীতিতে সক্রিয় হয়।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে নিঃশর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা এবং সব আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে সরে যান। তিনি বলে যান, একমাত্র দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারবে। গণঅভ্যুত্থানের সময়ে মওলানা ভাসানী সরকারের সহিংস আন্দোলনের ডাক দেন। টাইম পত্রিকার কভার স্টোরিতে মওলানা ভাসানীকে তখনপ্রোফেট অব ভায়োলেন্সবলে অভিহিত করা হয়। ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তখন বিরাজ করছিল বিপ্লবী সম্ভাবনা। বামপন্থী কোনো কোনো ধারা থেকে ওই অভ্যুত্থানের সময় বিপ্লবের স্বাধীন-সার্বভৌম পূর্ব বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত কোনো বৈপ্লবিক চিন্তা বা দলীয় প্রস্তুতি ছিল না। তবে ভাসানী অনুসারী সব সংগঠনের শক্তি নিতান্ত কম ছিল না। যদিও তাদের কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মানসিকতা ছিল না।

 ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা করেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে কিছু পরিবর্তন ঘটান। সংবাদ সম্মেলন করে তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের ধারণা দিতে থাকেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রয়োজনে নতুন আদেশ জারি করার কথা বলেন। তিনি জানান, পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রবর্তন করতে হবে। জাতীয় পরিষদ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন করতে হবে। তিনি আরো জানান, নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের কাজ হবে ১২০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। সংবিধানে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে। এজন্য তিনি নির্বাচনের বিধিবিধান-সংবলিত একটি আইনগত কাঠামো আদেশ ঘোষণা করবেন।

তিনি বলেন, সাধারণ পরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে অভিপ্রেত সংবিধান প্রণয়ন করতে না পারলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সে অবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সাধারণ পরিষদ গঠন করা হবে।  জাতীয় পরিষদ যে সংবিধান প্রণয়ন করবে, তা প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট দেখবেন তা পাকিস্তানের সব অংশের ঐক্য সংহতির অনুকূল হয়েছে কিনা। তিনি যদি মনে করেন সংবিধান আইন কাঠামো আদেশের শর্তানুযায়ী প্রণীত হয়েছে, তাহলে তিনি তা অনুমোদন করবেন এবং সাধারণ পরিষদ থেকে নতুন সরকার গঠিত হবে। তিনি নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং তার সরকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

প্রেসিডেন্ট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারক বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই গৃহাভ্যন্তরে রাজনৈতিক আলোচনা এবং জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে সভা করার সুযোগ দিয়ে আদেশ জারি করেন। ১৯৭০ সালের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ অবারিত করে দেন।

১৯৭০ সালের মার্চে আইন কাঠামো আদেশ ঘোষণা করা হয়। আদেশে ইয়াহিয়া খান যেসব কথা বলে আসছিলেন তার সবই আছে। সব ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন। এতে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ছয় দফায় এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এগারো দফায় যেসব কথা প্রচার করতেন, সেগুলোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী সব কথা আছে। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, মোজাফফর আহমদ আইনগত কাঠামো আদেশের সমালোচনা করেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে নির্বাচন করতে সম্মত হন।

জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার পর দক্ষিণের জেলাগুলোয় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিস্তর ক্ষতি হয়। ইয়াহিয়া সরকার দুর্গত এলাকায় লোকদের সাহায্য দাবির কাজে বিশেষ কিছু করেনি। দুর্গত এলাকা সফর করে এসে মওলানা ভাসানী ১৫ দিনের ব্যবধানে পরপর দুটি জনসভা করেন। দুটি সভায়ই তিনি দুর্গত এলাকায় মানুষের দুর্গতি ক্ষতির চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ স্থগিত করার দাবি জানান। তিনি সমুদ্র উপকূলের জেলাগুলোয় দুর্গত লোকদের সহায়তাদানের জন্য গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। অন্যান্য দলের লোকরাও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা দেখে ঢাকায় এসে দুর্গত লোকদের সহায়তা দাবি করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের দাবিকে অসংগত বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত সরকার গঠিত হলে তাতে পূর্ব বাংলার নেতৃত্ব থাকলে সে নেতৃত্ব এখানকার জনগণের জন্য কাজ করবেন। 

নির্বাচন পূর্বঘোষিত তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের তারিখ ছিল জাতীয় পরিষদ ডিসেম্বর এবং প্রদেশিক পরিষদ ১৭ ডিসেম্বর। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয় এবং দুই পরিষদের নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি।

নির্বাচনের ফলাফল সবাই জানেন। একটি কথা উল্লেখ করা হয়নি। সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত কার্যকর করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। কিন্তু সে সংবিধান অনুযায়ী কোনো নির্বাচন হয়নি। সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পরে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬২ সালে আরেকটি সংবিধান চালু করেছিলেন। দুটি সংবিধান প্রণীত হয়েছিল সংখ্যাসাম্যের  ভিত্তিতে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যতজন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঠিক ততজন। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের  জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এই সংখ্যাসাম্য চালানো হয়েছিল ইয়াহিয়া খান সংখ্যাসাম্য রক্ষা করেননি। তিনি জনসংখ্যার ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদে সদস্য সংখ্যা নির্বাচন করেন। তাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা বেশি হয়। ১৯৭০-এর সাধারণ পরিষদের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ তখন সাধারণ পরিষদে যেকোনো প্রস্তাব পাস করে নেয়ার ক্ষমতা লাভ করেছিল। এটা বুঝতে পারার ফলেই ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাধারণ পরিষদের অধিবেশন দিতে চাননি। তার ফলে বেশি সংকট শুরু হয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরই। নির্বাচনের আগে পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছেন ছয় দফা পরিহার করার ঘোষণা দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিছুতেই তার সংকল্প থেকে সরেননি।

১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের আরো অনেক কিছু জানা দরকার। নির্বাচনের সময় দেশবাসীর উদ্দেশে প্রত্যেক দলের নেতা জাতির উদ্দেশে যে বেতার ভাষণ দিয়েছেন, সেগুলো পড়লে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ ঘটে। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল লিখিত সুদীর্ঘ। তাতে তত্কালীন রাজনীতি তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানী বক্তব্য দিয়েছিলেন অলিখিত সংক্ষিপ্ত। তিনি একটি কথাই বলেছিলেন তা হলো, আমরা গভীর নৈতিক সংকটে পড়ে গিয়েছি। সংকট থেকে উদ্ধার লাভ এখন আমাদের মূল কাজ। তিনি তার দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। মওলানা ভাসানীর ভূমিকা আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয়ে সহায়ক হয়।

 

আবুল কাসেম ফজলুল হক: সমাজ বিশ্লেষক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন