সময়ের ভাবনা

খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর ও তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা

পাভেল পার্থ

মহামারীর ইতিহাস বলে, মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে যায়। ব্যক্তির সম্পর্ক, পরিবার, উৎপাদন ব্যবস্থা, খাদ্যরুচি, স্বাস্থ্য খাত, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, স্থাপত্যশৈলী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষমতার ময়দান। একেকটা মহামারী গেছে, কলেরা কি বসন্ত। বদলে গেছে অনেক কিছুই। চলমান করোনা মহামারী যেমন বদলে দিচ্ছে অনেক কিছু, হয়তো বদলে যাবে অনেক কিছু। তার আভাস ইশারা শুরু থেকেই কিছু আন্দাজ করা গেছে। এর ভেতরখাদ্যএক প্রধানতম তর্ক বা মনোযোগ বা সিদ্ধান্তের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী হবে ভবিষ্যতের খাদ্য ব্যবস্থা? কীভাবে বা কারা করবে উৎপাদন? কারা এর ভিত মজবুত রাখবে আর কারা মুনাফা লুটবে? কেমন খাদ্য উঠে আসবে আমাদের থালায় কিংবা গরুর গোয়ালে? খাবারে কি বিষ মেশানো থাকবে? মাংসের ভেতর কি মিশে থাকবে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম বা সিসার দানা? চায়ের সঙ্গে শরীরে কি ঢুকে যাবে মনসান্টো কোম্পানির রাউন্ডআপ বিষ? লিচু কি সিনজেন্টার রিপকর্ড বিষে বিষাক্তই হয়ে থাকবে? চারধারে কচু-থানকুনি-কলমি-গিমা শাকের মতোভিটামিন- অবারিত উৎস থাকতেও কি বিল গেটস আমাদের সামনে খুলবেন জেনেটিক্যালি মডিফায়েড গোল্ডেন রাইসের দোকান? মাটি, জল, বায়ু আর বীজের সঙ্গে কি শিশুর কোনো সম্পর্ক থাকবে না? ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদনের বাগান কি নিয়ন্ত্রণ করবে বহুজাতিক কোম্পানির রোবট? ক্ষেত নিড়ানি দিতে দিতে, পাট জাগ দিতে দিতে, আউশের নাড়া কাটতে কাটতে কিংবা জুম পাহাড়ে বীজ বুনতে বুনতে আর কি কোনো গীতবাদ্য রচিত হবে না দুনিয়ায়? মানুষ কি কেবল অনলাইনেই খাবার অর্ডার করবে? বিচিত্র সব নাম আর বিজ্ঞাপনের মায়া-ভোলানো নামের খাবার। প্যাকেট থেকে খুলে খাবার মুখে পুরবে কিন্তু জানবে না কীভাবে, কোথা থেকে খাবার তৈরি হলো? জানবে না এক ধান থেকেই চাল, চিড়া, মুড়ি, খই, গুঁড়ি কত কিছু হয়। খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে কি ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না? এক ভোক্তা কিংবা খুব বড়জোর কিছু বিক্রেতা বা হয়তো কেউ কেউ এদেরই ভেতর হয়ে উঠবে বহুজাতিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক। কিন্তু খাদ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক রূপান্তর, বিশেষ করে মানুষসহ সব প্রাণসত্তা এবং সব বাস্তুতন্ত্রের নিরাপদ খাদ্যের জন্য কি লড়বে না ভবিষ্যতের তরুণ প্রজন্ম? বিশ্বাস করি, অবশ্যই লড়বে। এখনো গ্রামে কিছু তরুণ কৃষিতে নিয়োজিত, শহরে অনেক তরুণ নিরাপদ খাদ্য বিক্রি পরিবেশনের নানা রকম সৃজনশীল উদ্যোগ আন্দোলন শুরু করেছে। করোনা মহামারী অনলাইন খাদ্য উদ্যোক্তা তৈরির একটা পরিবেশও চালু করেছে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গ্রাম এলাকায় ৫৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং শহরের ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ লোকের কৃষি খামার আছে। রাষ্ট্র এখনো কৃষিকে দেখে খাদ্য উৎপাদনের মূল খাত হিসেবে। সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারভিশন ২০২১গ্রহণ করে। তবে কৃষি কেবল এককভাবে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নয়; দেশের মানুষের আয় কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি প্রতিটি বাস্তুসংস্থানের অপরাপর জীবিত প্রাণসত্তার বেঁচে থাকাকে সহায়তা করে। জাতীয় খাদ্যনীতির মূল লক্ষ্য সব নাগরিকের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মজুদ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয়, পরিবেশন কি বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগ মিলেই দেশের খাদ্য ব্যবস্থা। আর খাদ্য ব্যবস্থা একটা সময় পারিবারিক কৃষি ঐতিহ্য নিয়ে বিকশিত হলেও দিন দিন কৃষিতে পরিবারের সব সদস্যের সমান অংশগ্রহণ থাকছে না। বিশেষভাবে কৃষিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, কৃষক পরিচয়ে সামাজিক মর্যাদা না পাওয়া, কর্মসংস্থানের অভাব, কৃষিপণ্যের অনিশ্চিত বাজার, সামাজিক বৈষম্য বঞ্চনা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নানামুখী অভিবাসন এবং পরিবেশগত জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কারণে গ্রামবাংলার এক বিশাল যুবসমাজ আজ কৃষি পেশা ছেড়ে শহরমুখী নানা জীবিকা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় কৃষিনীতি তৈরি করে, কিন্তু এতে কৃষিতে যুবদের ভূমিকাকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের জাতীয় কৃষিনীতি প্রথমবারের মতোকৃষিতে যুবশক্তিশিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় (ধারা-১৪) যুক্ত করে। জাতীয় কৃষিনীতি (২০১৮) মনে করে, ‘একটি শিক্ষিত, সচেতন, জ্ঞানসমৃদ্ধ, দেশপ্রেমিক উদ্যমী যুবশক্তি দ্বারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কৃষি পরিচালিত হবে।কিন্তু জাতীয় কৃষিনীতির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এখনো যুবসমাজকে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্তকরণের কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় কর্মকৌশল নেই। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ যুবসমাজ। দেশের খাদ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন রূপান্তরে যুবশক্তিই ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার ভিতকে মজবুত করতে পারে।

প্রতি বছরের মতো গতকাল পালিত হলো আন্তর্জাতিক যুব দিবস। বছর করোনা মহামারীকালে যুব দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরে তরুণ সমাজের সৃজনশীল ভূমিকার প্রসঙ্গ। তরুণদের সক্রিয় সৃজনশীল ভূমিকাই মানুষ পৃথিবীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বৈচিত্র্যময় খাদ্য ব্যবস্থা সবার জন্য উপহার দিতে পারে। এখনো বাংলাদেশের শহর-গ্রামে কৃষি, পরিবেশ বৈচিত্র্য সুরক্ষাসহ নানামুখী সামাজিক কাজের সঙ্গে যুবরাই নানাভাবে জড়িত। গ্রামে যুবরা যেমন কৃষি উৎপাদনে জড়িত, আবার নতুনভাবে শহরে নানাভাবে নিরাপদ প্রাকৃতিক খাদ্যনির্ভর যুবদের উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। তবে সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থায় উৎপাদক, ক্রেতা-বিক্রেতা, ভোক্তা, গবেষক, নীতিনির্ধারক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, কৃষক সবার এক যৌথ সমন্বয় জরুরি। আজকের তরুণসমাজ খাদ্য ব্যবস্থায় নিজেকে কীভাবে যুক্ত করতে চায়, কী ধরনের খাদ্য ব্যবস্থা দেখতে চায়, কীভাবে চায়, কেন চায় কিংবা খাদ্য ব্যবস্থায় নিজেদের যুক্ত না করতে চাইলে কেন চায় না এমন সব খাদ্যবিষয়ক যুব ভাবনা আজ জানাবোঝা জরুরি। তরুণদের সংকট সম্ভাবনা এবং তাদের সৃজনশীল উদ্ভাবনী চিন্তাগুলো একত্র করা জরুরি।

করোনা মহামারী স্পষ্টতই আবারো আমাদের নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। নিরাপদ খাদ্য কেবল মানুষের নয়, সব প্রাণসত্তার মৌলিক অধিকার। মাটি, জমি, জলাভূমি, বন, পাহাড়সহ সব বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য পরিবেশের সুরক্ষাও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার শর্ত। এমনকি লিঙ্গ, জাতি, পেশা, ভাষা, সমাজ, ভূগোল সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণও খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম বিষয়। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে গ্রাম কি শহর, ভিন্ন ভূগোল সংস্কৃতিতে আজকের তরুণসমাজের খাদ্য ভাবনা এবং খাদ্য ব্যবস্থায় তরুণসমাজের অংশগ্রহণের বিষয়গুলো আমাদের যুবকেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ খাদ্য ব্যবস্থার ভিত মজবুত করতে সহযোগিতা করবে। স্বপ্ন দেখি আগামী দিনের মানুষসহ সব প্রাণসত্তা বাস্তুতন্ত্রের নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার সক্রিয় নেতৃত্ব দেবে তরুণরাই। দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু সংকট মোকাবেলাসহ সব স্থানীয়, আঞ্চলিক জাতীয় প্রশ্নকে সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থার আলোচনায় যৌক্তিকভাবে তুলে ধরবে আজকের তরুণসমাজ। সংকট মোকাবেলায় সব সৃজনশীল চিন্তা পরামর্শকে একত্র করবে, মৌলিক প্রায়োগিক গবেষণার ভিত্তি মজবুত করবে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত সাফল্যগাথাকে একসূত্রে গাঁথবে, অভিনব উদ্যোগগুলোকে গুরুত্ব দেবে, সত্যিকারের খাদ্যযোদ্ধার স্বীকৃতি মর্যাদার সংস্কৃতি তৈরি করবে, মাঠ থেকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সবার কণ্ঠস্বরকে শামিল করবে, কাউকে পেছনে না রেখে সবার অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে এক বহুত্ববাদী খাদ্য ব্যবস্থা বিনির্মাণে প্রত্যেকেই নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসবে। আজকের তরুণসমাজের দায় দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই রচিত হবে আগামীর নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা। যে খাদ্য ব্যবস্থা মানুষসহ সব প্রাণসত্তা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য, পুষ্টি স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে নিশ্চিত করবে। 

 

পাভেল পার্থ: লেখক গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন