ফিরে দেখা

যুদ্ধদিনের ভারতীয় বন্ধুরা

ড. এমএ মোমেন

১৯৭১- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সমর্থন এবং সক্রিয় সহযোগিতা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই দ্বিখণ্ডিত হতে হবে, আর তাতে ভারতের আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক কৌশলগত কী লাভ হবে, একাত্তরে তা কখনই আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল না। বিগত দশকগুলোয় ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষকরা ধরনের কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন।

লেখায় একাত্তরের যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কয়েকজনকে স্মরণ করা হবে। তারা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, একাত্তরের চিফ অব আর্মি স্টাফ ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এসএম নন্দা, ইস্টার্ন কমান্ডার চিফ কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, ফোর্থ কোরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং এবং ইস্টার্ন কমান্ডার চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। সেই সঙ্গে খানিকটা বিশেষভাবে যোগ করা হয়েছে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের পরিচালক রমেশ্বর নাথ কাওকে।

ইন্দিরা গান্ধী

১৯৭১- ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুগপৎ বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে, বিশ্বজনমত পক্ষে এনে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু কৌশলগত যুদ্ধ জিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সম্ভব সহযোগিতা করেছেন, তেমনি পাকিস্তানকে দুই খণ্ড করে ভারতের পূর্ব সীমান্তকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আক্রমণের ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করেছেন।

১৯৭১-এর ডিসেম্বরের যুদ্ধের যে আর্থিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়, প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দীর্ঘমেয়াদি লালন-পালনের যে ব্যয়, তার চেয়ে বরং যুদ্ধে নেমে পাকিস্তানকে দুই খণ্ড করে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো অধিকতর অর্থবহ; কার্যত আর্থিক সাশ্রয় আরো অনেক বেশি। একাত্তরের ডিসেম্বরের পর থেকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশ ঘেরা যে সীমান্ত, সেখানে সমরসজ্জায় সজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন রাখার প্রয়োজন আর নেই। ভারতের জন্য পাকিস্তান শুরু থেকেই বৈরী রাষ্ট্র। বাংলাদেশ শুরু থেকে বন্ধুরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের শরণার্থীর বোঝা কাঁধে নিয়ে, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে ভারতের অভ্যন্তরে স্থান দিয়ে, সর্বোপরি মুক্তিবাহিনী গঠনে সার্বিক সহায়তা দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী অকংগ্রেসীয়দের সমালোচনার মুখে যেমন ছিলেন, নিজ দলের রক্ষণশীলরাও তাকে ছাড় দেননি। নিক্সন-কিসিঞ্জারের হুমকি রূঢ় আচরণের মুখেও তিনি অনড় ছিলেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংকট, সেনা নির্যাতন এবং শরণার্থীর স্রোত পর্যবেক্ষণ  করছিল। একজন বিদেশী পর্যবেক্ষক বললেন, ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদকে মার্চের শেষে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শ ছিলভারত পূর্ব বাংলার আশু সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। বাঙালিদের সামরিক সাহায্য করতে হলে তাদের আরো কিছু অপেক্ষায় থাকতে হবে। গ্রীষ্মের শুরুর দিকে পাকিস্তান যখন বুঝতে পারে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নেয়নি, তখন আওয়ামী লীগের বৈধ রাজনৈতিক দাবি না মানার প্রশ্নে আরো অনমনীয় হয়ে ওঠে।

ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ভুগতে হয়েছে। তরুণ ছেলেরা স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য আত্মবলিদানের সংগ্রামে লিপ্ত। ভারতের জনগণও একই আদর্শের প্রতিরক্ষায় লড়ে যাচ্ছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এই শ্রেষ্ঠতম উদ্যোগ আত্মদান ভালো কাজের জন্য. আমাদের আত্মনিবেদনকে তা আরো শক্তিশালী করবে এবং দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন রাখবে। যাহোক, পথ যত দীর্ঘই হোক, আত্মদান যত বেশিই হোক, আমাদের দুই দেশের মানুষের ভবিষ্যতে ডাক পড়বে, আমি নিশ্চিত আমরা বিজয়ীই হব। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে ম্যান্ডেট দিয়েছিলবিস্ময়কর সেই ম্যান্ডেট থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন। গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য জনগণ আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যান্ডেটের তুলনায় তা কিছুই নয়।

জগজীবন রাম

জগজীবন রামের জন্ম বিহারে, এপ্রিল ১৯০৮, একটি কৃষক পরিবারে। তবে তার বাবা একসময় ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু মতপার্থক্যের কারণে শিগগিরই চাকরি ছেড়ে চাষাবাদে মন দেন। ১৯২৮ সালে ২০ বছর বয়সে ওয়েলিংটন স্কয়ারে মজদুর র্যালি করার সময় তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দলিত অধিকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৩৪-এর বিহার ভূমিকম্পের পর দিন-রাতের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তিনি অনেকের নজর কেড়ে নেন। ১৯৩৪ সালেই তিনি রাঁচিতে হ্যামন্ড কমিশনের সামনে দলিত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অধিকার দাবি করেন। যখন ভারতের সংবিধান প্রণীত হয়, তখন দলিত সম্প্রদায়ের সমান অধিকার রক্ষার দাবি তোলেন। ১৯৬৩-১৯৬৫ বাদে ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি ভারত সরকারের কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এত দীর্ঘ সময় কোনো ভারতীয় মন্ত্রী পদ ধরে রাখতে পারেননি।

ভারতের সবুজ বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক তিনি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি স্মরণীয় সাফল্যের অধিকারী। ১৯৭১-এর যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশর মধ্যে তিনিই ছিলেন সার্বক্ষণিক যোগসূত্র। ভারতের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নেও তিনি ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ তার সম্মতিতেই হয়। জুলাই ১৯৮৬ জগজীবন রাম প্রয়াত হন।

১৯৭১-এর স্মরণীয় যুদ্ধবিজয়ী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একজন সহায়ক বন্ধু হিসেবে তাকে স্মরণ রাখতেই হবে। ভারত তাকে আরো বেশি মনে রাখবে দলিত মানুষকে মূলধারায় আনার অন্যতম সংগ্রামী নেতা হিসেবে।

ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ

১৯৭৯ সালে ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং ১৯৭৯- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের প্রধান সমরনায়ক মানেকশের জন্ম এপ্রিল ১৯১৪, অমৃতসরে। ১৭ জুন ২০০৮ সালে ৯৪ বছর বয়সে তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটন শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

দেরাদুনে ভারতীয় মিলিটারি একাডেমিতে প্রথম ব্যাচের সৈনিক মানেকশ ১৯৪৭-এর পর গুর্খা ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে ভারতের সপ্তম সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৭১-এর গৌরব তাকে এনে দিয়েছে পদ্মবিভূষণ পদ্মভূষণ খেতাব। মানেকশর ব্যাচমেট মুসা খান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মানেকশ লড়েছেন বার্মা রণাঙ্গনে। স্পষ্টভাষী মানেকশকে নেহরু থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী সবাই সমীহ করতেন।

ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় স্যাম মানেকশ তার সঙ্গে চমত্কার একটি অপ্রথাগত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ১৯৭১-এর যুদ্ধজয় তাকে রাষ্ট্রীয় বীরে পরিণত করে। তারও বেশ আগে, মানেকশ বলেছেন, ইন্দিরা তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনি নাকি আমাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছেন? তা কবে কাজটা করছেন?

তিনি বলেন, ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, আপনার বদলে আমি যে ঠিক উপযুক্ত হব না, এটা কি আপনি মনে করেন না? আমার কাজটা আমি করব, আপনার কাজটা আপনি করে যান।

এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল

এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল ( ডিসেম্বর ১৯১৬-১৩ আগস্ট ১৯৮১), জন্ম ভারতের লুধিয়ানায়। লন্ডনের কিংস কলেজে পড়েন সাংবাদিকতা, ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য যোগ দিলেন লন্ডনের একটি ইন-এ। বেসামরিক উড়োজাহাজ চালানোর পাইলট লাইসেন্স ছিল তার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তার সব পরিকল্পনা শিকেয় তুলে দিল, তিনি এয়ার ফোর্স রিজার্ভে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেন এবং যোগ দিলেন। ১৯৩৯ সালে কমিশন পেয়ে প্রথমে করাচি, ১৯৪৪- স্কোয়াড্রন লিডার হয়ে বার্মায়, স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে, পাঁচ বছর ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসে। ১৯৬০ সালে তখনকার এয়ার চিফ এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জির জাপান সফরকালে শ্বাসনালিতে খাদ্যকণা আটকে মৃত্যু ঘটলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেনন এয়ার চিফের সফরসঙ্গী হিসেবে তাকে চাকরিচ্যুত করেন। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে ভারতের বিপর্যয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেননকে পদত্যাগ করতে হয়, তিনিও চাকরিতে বহাল হন। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে বীরত্ব সাহসিকতার জন্য পদ্মভূষণ খেতাব পান। ১৯৬৯-এর জুলাইয়ে এয়ার চিফ মার্শাল পদোন্নতি পেয়ে বিমান বাহিনীর প্রধান হন। ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তার কর্মজীবনকে আরো উজ্জ্বল করে তোলে। তার বাহিনী ডিসেম্বরের মধ্যে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে বোমাবর্ষণ করে উড্ডয়নের সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে ফেললে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ইস্টার্ন কমান্ড সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তারা জীবন রক্ষা করে।

অ্যাডমিরাল সর্দারিলাল মাথরাদাস নন্দা

এসএম নন্দা (১০ অক্টোবর ১৯১৫-১১ মে ২০০৯), জন্ম শৈশব পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা করাচিতে। স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি করাচি বন্দরে পোর্ট পাইলটেজ বিভাগে কাজ শুরু করে  দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগদানের আবেদন করেন। তাকে নেয়া হয়। তিনি দক্ষতার সঙ্গে পদোন্নতি পেতে থাকেন। ১৯৬২ সালে রিয়ার অ্যাডমিরাল পদে পদোন্নতি পেয়ে নৌবাহিনীর ডেপুটি চিফ হন। ১৯৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধে নৌবাহিনীর কোনো ভূমিকা ছিল না। ১৯৬৫-এর যুদ্ধে তাদের ভারতীয় নৌসীমা অতিক্রম করার নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজীর ডুবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পরাজয়ও নিশ্চিত হয়ে ওঠে। অ্যাডমিরাল নন্দার নির্দেশে ভারতীয় নৌবাহিনী ইস্টার্ন কমান্ডোর আওতাধীন বঙ্গোপসাগর সুরক্ষিত রাখে। নন্দা তার স্মৃতিকথা রেখে গেছেনদ্য ম্যান হু বোম্বড করাচি : মেমোয়ার-এ। তিনি বীর যোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত। ইস্টার্ন কমান্ডে পাকিস্তানের নৌশক্তি বরাবরই অপর্যাপ্ত ছিল। ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অপারেশন জ্যাকপট চট্টগ্রাম ঘাঁটির নৌশক্তি একেবারে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা 

জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জগজিৎ সিং অরোরার জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, পাকিস্তানের কালা গুজরান। ১৯৩৯ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন, বার্মা ফ্রন্টে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী বেছে নেন। ১৯৫৭-তে ব্রিগেডিয়ার, ১৯৬৪-তে মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। ১৯৬৫-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, ১৯৬৬-তে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, ১৯৬৯ সালে ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান। তার গৌরবময় পেশাদার জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের এই ছবি বাংলাদেশের জীবনে যেমন, তার জীবনেরও শ্রেষ্ঠ অর্জন।

তিনি শিখ স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযানের বিরোধিতা করে কংগ্রেস সরকারকে গালমন্দ করেছেন। মে ২০০৫ তিনি ৮৯ বছর বয়সে নয়াদিল্লিতে প্রয়াত হন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং

সাধারণ সেপাই থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করতে হলে কতটা মেধা, যোগ্যতা পরিশ্রম করতে হয়, তা অনুমান করাও দুষ্কর। ১৪ জুলাই ১৯১৮ রাজস্থানে জন্ম সগৎ সিংয়ের। তিনি জীবদ্দশাতেই লিজেন্ড হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হায়ার কমান্ডের নির্দেশ না মানা জেনারেল হিসেবেও পরিচিত। ১৯৭১- এমন সিদ্ধান্তে মেঘনার পূর্ব প্রান্ত থেকে হেলিকপ্টারে তার সৈন্যদলকে পশ্চিম প্রান্তে পাঠিয়েছেন। তখন তিনি আসামের ফোর্থ কোরের কমান্ডিং অফিসার। সগৎ সিংয়ের সিদ্ধান্তেই পাকিস্তানি সেনাশিবিরে কাঁপন ধরিয়ে দেয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতন ত্বরান্বিত করে। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১ দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি মেঘনা। অবসর জীবনযাপনের জন্য জয়পুরে যে বাড়ি নির্মাণ করেছেন, তার নাম রেখেছেন মেঘনা, নিজের নাতনির নামও রেখেছেন মেঘনা।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব

জ্যাক-ফার্জ-র্যাাফায়েল জ্যাকবের জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় সাফল্য ১৯৭১- পাকিস্তানকে পরাজিত করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখা। ১৯৭১- তিনি ছিলেন ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। জন্ম  ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কলকাতায়, ইরাক থেকে আসা এক বাগদাদি ইহুদি পরিবারে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে পরিবারটি কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করে।

জ্যাকব যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যান, সঙ্গে নিয়েছিলেন অক্সফোর্ড অব মডার্ন ভার্স। আধুনিক কবিদের রচনা তার পছন্দের, তিনি ডব্লিউ বি ইয়েটস, জি ডব্লিউ হপকিন্স, ডব্লিউ হেনলে, প্যাড্রিক কলামের কবিতা পড়তেন। তার বিশেষ পছন্দ ওয়ার পোয়েমসযুদ্ধের কবিতা। ইংল্যান্ড আমেরিকার আর্টিলারি স্কুলের গ্র্যাজুয়েট জ্যাকব ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রাজস্থানে একটি ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের  নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৬৯ থেকে ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। সময়ই তিনি পান পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পরে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে; আক্রান্ত না হয়ে তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাদের অবদান অপরিসীম। তারা পাকিস্তানিদের যোগাযোগ পথ মাধ্যমে আক্রমণ চালায়, তাদের মনোবল ভেঙে দিয়ে আমাদের অগ্রগতি অনেক সহজ করে দেয়।

কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার স্মরণীয় অবদান রয়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বিজয়ের যে ক্ষেত্রটি তৈরি করে দিয়েছে, সে গৌরবটুকু প্রদান করতে তিনি কিছুটা কার্পণ্য করেছেন। জ্যাকবের স্মৃতিকথা স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব নেশন সুখপাঠ্য। কিন্তু এতে তিনি নিজেকে যতটা কীর্তিমান হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, বাস্তবে তা সত্য ছিল কিনা, নিয়ে তখনকার ভারতীয় সৈনিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রেখেছেন।

আর এন কাও

একাত্তরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং কৌশল শিল্পী রমেশ্বর নাথ কাও। আরএন কাও নামেই তার পরিচিতি। তার জন্ম ১৯১৮ সালে বারানসিতে একটি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারে। লক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক রামেশ্বর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য হন। কিছুকাল পর তাকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে বদলি করা হয়। ১৯৬৮-এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণ এবং ১৯৬৫ সালে জম্মু কাশ্মীরে পাকিস্তানের অপারেশন জিব্রাল্টারে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ভারতকে পীড়িত করে এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য ১৯৬৮ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং গঠিত হয় এবং  প্রথম পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রমেশ্বর নাথ কাও। তিনি -কে বিশ্বমানের একটি গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত করতে উদ্যোগ নেন। তার মেধা উদ্যম যতটা না তার সংস্থাকে, তার চেয়ে বেশি পরিচিত বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে তাকে।

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে থাকার সময়ই এয়ার ইন্ডিয়ার কাশ্মীর প্রিন্সেস লকহিড বিস্ফোরণের আন্তর্জাতিক তদন্ত দলের সদস্য ছিলেন। কথা ছিল ফ্লাইটে সাংহাই থেকে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন। অনুমান করা হয় চীনা গোয়েন্দারা ফ্লাইটটিকে সন্দেহভাজন মনে করে প্রধানমন্ত্রী  চৌ এন লাই-কে তাতে চড়তে দেয়নি। টাইম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে জাহাজটি বিধ্বস্ত হয় এবং তিনজন যাত্রী বাদে সবারই মৃত্যু হয়।

মনে করা হয়ে থাকে ভারত থেকে হাইজ্যাক করা উড়োজাহাজ লাহোরে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, তাও ছিল আরএন কাওয়ের একটি পাতা ফাঁদ; যার খেসারত পাকিস্তানকে দিতে হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগেই ভারতের আকাশের ওপর দিয়ে সব পাকিস্তানি উড়োজাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বল্পভাষী এই মানুষটি ইন্দিরা গান্ধীর একান্ত আস্থাভাজন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের টিমে ডিপি ধর, পিএন হাকসার, টিএন কাউলের সঙ্গে দলভুক্ত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় রাজনীতিবিদরা তাকে দোষারোপ করে থাকেন। তবে তিনি যে ইন্দিরাকে জরুরি অবস্থা জারিতে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছেন, এটাও অনেকে বলেন। ইন্দিরা ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে রাজীব গান্ধীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হন। ২০০২ সালে এই নিভৃতচারী মানুষটির মৃত্যু হয়।

তার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ভুয়োদর্শী স্পাই মাস্টার দুর্লভ। একাত্তর যুদ্ধের দুই বছর আগেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে পাকিস্তান ভাগের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। যে সময় পাকিস্তান প্রশ্নে ভারতে পরস্পরবিরোধী দুটো ধারা বিরাজ করতে থাকেএকটির নেতৃত্বে থাকেন -এর প্রধান আরএন কাও। তিনি নিশ্চিত সত্তরের নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদার জোতদার আমলা রাজনীতিবিদ প্রমুখের চাপে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে না। তার পরামর্শভারতের স্বার্থেই সে সময় পূর্ব পাকিস্তানকে সহায়তা করে প্রয়োজনে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।

কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স) সম্পূর্ণভাবে এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার কৃষ্ণ আচার্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন বাঙালিরা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হলেই কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের পাথরের দেয়াল সরিয়ে ভারত তার পররাষ্ট্র নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে পারবে। আর তা করতে হলে পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানকে এক দেশ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের নীতিমালা পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃত্বের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। পররাষ্ট্র সচিব টিএন কাউলও বললেন, পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়াকে ভারত উৎসাহিত করতে পারে না, আবার তিনি এটাও বলেন  যে এই বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতাও ভারতের নেই। জানুয়ারি ১৯৭১ ইন্টার এজেন্সি বৈঠকে আরএন কাও বললেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রত্যাশার শিকড় এত গভীরে প্রোথিত যে সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই। তিনি আরো বলেন, বাঙালি তথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে পাকিস্তানের রাজনীতির যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে তা সেনাবাহিনী মেনে নেবে না। সেজন্য ১৯৬৯ থেকেই পূর্বাংশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে ভারতের প্রস্তুতির ওপর তিনি জোর দিয়ে আসছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অশোক রায় কাওকে পূর্ণ সমর্থন করলেনতাদের চিন্তা এবং ইন্দিরা গান্ধীর চিন্তা মিলে যাওয়ায় ভারতের জন্য দিকনির্দেশনার দ্বৈধতার কার্যত অবসান ঘটল। কাওই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব প্রধানকে যেন প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন। ইন্দিরা মার্চ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ পরামর্শ প্রদানের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টিম তৈরি করলেন, তারা বাংলাদেশকে সহায়তা করার আর্থিক রাজনৈতিক সামরিক সক্রিয়তা বিশ্লেষণ করবেন, এতে পাকিস্তানের হাতে কাশ্মীর এবং চীনের হাতে ভারতের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ও খতিয়ে দেখবেন। কাও মনে করলেন, আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাফল্য লাভের জন্য বাঙালিদের সহায়তা করা অপরিহার্য বলে তিনি বিবেচনা করেন।

কার্যত রমেশ্বর নাথ কাও ডকট্রিনই ভারতকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করতে প্রণোদিত করে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সমীকরণটি তাদের ব্যাপার। বাংলাদেশের লক্ষ্য তখন স্বাধীনতা অর্জন। ইন্দিরা গান্ধীসহ গোটা ভারত সরকারকে বাংলাদেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে রমেশ্বর নাথ কাওয়ের অবদানও স্মরণ করতে হবে।

 

. এমএ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন