তথ্যগত ঘাটতি

বাংলাদেশে ‘তথ্যের চরম দারিদ্র্য’ বিমোচন জরুরি

সৈয়দ আবুল বাশার

সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি গ্রুপ আমাকে একটি লেকচার দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমার হঠাৎ মনে হলো ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো যদি নতুনভাবে আবার একত্র হতে পারে তাহলে ব্যাপারটি কেমন হবে। আমার লেকচারের বিষয় ছিল, মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই), যা ছিল পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক এবং ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের চিন্তার ফল। হক-সেনের যৌথ প্রয়াস এমন এক নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন সূচক সৃষ্টি করেছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মতো সূচকের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে টেকসই সর্বব্যাপ্ত সূচক হিসেবে এখন বিবেচিত। তাদের সফল উদ্যোগটি আমাকে ভাবায় যে আমরা কেন এইচডিআইয়ের মতো নতুন সূচক তৈরিতে ধরনের সহযোগিতা-প্রচেষ্টা আর দেখি না

সর্বসাম্প্রতিক এইচডিআই পর্যালোচনাপূর্বক আমার লেকচারে একটি ইস্যু উঠে আসে যে সমস্যার উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে আমাদের তথ্যের ঘাটতি আসলে কতটা প্রবল। আমরা যদি তথ্যের সমাহার-মজুদের ওপর একটি র্যাংকিং করি, সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশ তলানিতে থাকবে, এইচডিআইতে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও। এটিও একই সঙ্গে বিস্ময়কর যে পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া বাংলাদেশ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে কীভাবে ভালো করেছে। তবে ভবিষ্যতে এটি আর সম্ভব হবে না। আধুনিক জ্ঞানচালিত অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য বস্তুগত পুঁজি মানব পুঁজির সঙ্গে নিরীক্ষিত তথ্যের বিপুল সরবরাহ প্রয়োজন হবে। এর বিকল্প নেই। 

লেকচারের শুরুতে আমি অংশগ্রহণকারীদের একটি সহজ প্রশ্ন করেছিলাম, কেন জিডিপি তথ্য বাংলাদেশে বার্ষিকভাবে আর ভারতে প্রতি প্রান্তিকে প্রকাশ করা হয়? প্রশ্নটি একটু ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, দেশে জেলা পর্যায়ের জিডিপি তথ্য পাওয়া যায় না, এমনকি বার্ষিক ভিত্তিতেও। তারা মনে হয় উভয় প্রশ্নই পছন্দ করেছিল। কেউ কেউ যথার্থভাবে উল্লেখ করেছে যে প্রতি প্রান্তিকে জাতীয় জিডিপি তথ্য প্রকাশের সঙ্গে বিপুল অর্থের ফ্যাক্টর যুক্ত। যেহেতু অংশগ্রহণকারীরা সবাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, আমি জেলাওয়ারি খণ্ড খণ্ড (ডিসএগ্রিগেটেড) জিডিপি প্রকাশে সরকারের অসামর্থ্যের ওপর দায় চাপাতে বিরত থাকি। জিডিপি এমন এক সূচক, যেখানে বিভিন্ন অংশ যোগ করে একটি পুরো বিষয় পাওয়া যায়, হতে পারে এটি খাতভিত্তিক কিংবা জেলাভিত্তিক। প্রকৃত বিষয় হলো, খাতভিত্তিক জিডিপি প্রকাশ করা হলেও জেলাভিত্তিক জিডিপি প্রকাশ না হওয়া আমাদের বলে যে সরকার আয়ের ক্ষেত্রে তার নাগরিকদের ভৌগোলিক পার্থক্য শেয়ার করতে এখনো প্রস্তুত নয়। বড় কথা, ধরনের খণ্ড খণ্ড তথ্য প্রকাশ বিষয়ে একাডেমিক কিংবা নাগরিক সমাজ থেকে তেমন কোনো চাপও নেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে তখন ১৯৯৬-২০০০ সময়ের জন্য জেলাভিত্তিক জিডিপি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ওয়েবসাইটে তথ্য এখনো পাওয়া যায়। আমরা তত্কালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার লিগ্যাসির শূন্যতা অনুভব করছি। 

ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্যের ঘাটতি বিদ্যমান। এটিও বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন বিষয় ধরার আরেকটি অর্থনৈতিক সূচক। সিপিআই সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ হয়, তবে এটি ব্যাপকভাবে একত্র সন্নিবিষ্ট আকারে (দুই অংকের মাত্রায়) পাওয়া যায়। যদিও মৌলিক তথ্য আট অংকের মাত্রায় পাওয়ার কথা। বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি কিন্তু আমরা জানি না যে খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মাংস কিংবা দুগ্ধপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে কিনা। যদি মাংসের কারণে হয় তাহলে সেটি কি মুরগি, গরু নাকি ছাগলকোন মাংসের দাম বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে? সেটিও এক বড় প্রশ্ন। গবেষক নীতিনির্ধারকদের জন্য এসবের বিস্তারিত তথ্য বিস্ময়করভাবে সুফলপ্রদায়ী। যেভাবে সিপিআই তৈরি করা হয়, তাতে বিভিন্ন অংশের তথ্য না-জানা ছাড়া এর সামগ্রিক মূল্য বা চিত্রের হদিস কেউ পায় না। কাজেই আবারো আমরা খণ্ড খণ্ড দাম মাত্রা থেকে বঞ্চিত হই, যা আমাদের বোঝার সুযোগ দিতে পারত কারা মূল্যস্ফীতি থেকে লাভবান হয়, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়। 

এখানে আমি মনে করি যে বিশ্বব্যাংক বা জাতিসংঘের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোর বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে খণ্ড খণ্ড বিস্তারিত তথ্য চাওয়ার কথা বলা উচিত বা বিষয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা উচিত। ধরনের সবিস্তারে তথ্য পাওয়ার মাত্রা সরকারকে টেকসই পরামর্শ প্রদানে তাদের বেশি করে সমর্থ করে তুলবে। বিশ্বব্যাংকের ওপেন ডাটা পলিসির জন্য ধন্যবাদ, ফলে ১৯৬০ সাল থেকে বাংলাদেশের সময়ক্রমিক তথ্য পাওয়া সহজ। বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর ডাটাবেজ ব্রাউজ করার মাধ্যমে যে কেউ এটি যাচাই করতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক জিডিপির তথ্যে খুব কমই বিদেশী তথ্যদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে, কারণ এটি বিবিএসের ওয়েবসাইটে সহজলভ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি এক্সেল স্প্রেডশিটে সব অর্থনৈতিক তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে তথ্যের দুর্বল প্রাপ্যতার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচেষ্টা আরো কার্যকর হতো, যদি তারা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব সেন্ট. লুইজের মতো প্রফেশনাল ডাটা প্রোভাইডারের প্রযুক্তি ব্যবহার করত। আমার শিক্ষার্থীদের খুব ঝামেলা পোহাতে হয়, যখন রেমিট্যান্স আন্তঃপ্রবাহ কিংবা বাংলাদেশের চলতি হিসাবের স্থিতির মতো ঐতিহাসিক তথ্যের প্রয়োজন হয়। এমনকি এসব তথ্যের মালিক বাংলাদেশ হলেও ধীর সেকেলে সরকারি ওয়েবসাইটগুলোর কারণে আমাদের বিদেশী ওয়েবপোর্টাল থেকে তথ্য নিতে হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে, অপর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ তথ্য রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের আক্ষেপ এখানেই থেমে নেই। পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মানবসম্পদ না থাকলে আমরা কখনই তথ্যের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হতে পারব না। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিসংখ্যান খুব একটা জনপ্রিয় বিষয় নয়। সর্বোপরি, চাচা-চাচীরা, যারা পরিসংখ্যান পড়েছেন, তাদের মধ্যে কতজন আসলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিসংখ্যান পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। এটি একটি পুরনো একাডেমিক ডিসিপ্লিন। কিন্তু এটি এখানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দেয়া যাক। নিম্ন ভর্তিহারের কারণে পরিসংখ্যান বিভাগকে এখন গণিতের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। আমি জানি না আদৌ অন্য কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যানে স্নাতক ডিগ্রি অফার করছে কিনা। প্রতি বছর আট হাজারের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যখন বলি যে যুক্তরাষ্ট্রে পরিসংখ্যান দ্রুত চাহিদা বেড়ে চলা শীর্ষ পাঁচ পেশার অন্যতম, তখন তারা মনে হয় এটি ভেবে বিস্মিত হয় যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কমই পরিসংখ্যান নিয়ে পড়তে যায়। আমরা যদি এটা সম্পর্কে চিন্তা করি তাহলে দেখব কম্পিউটার সায়েন্সের মতো পরিসাংখ্যানিক জ্ঞান ব্যাপকভাবে হস্তান্তরযোগ্য/বিনিময়যোগ্য। অন্য সামাজিক বিজ্ঞানের মতো, যেখানে প্রায় ক্ষেত্রে স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় জ্ঞান প্রয়োজন, সেখানে অধিকাংশ তথ্য পরিসংখ্যান সম্পর্কিত বিষয়গুলো দূরবর্তী মহাদেশ থেকেও অ্যাড্রেস করা যেতে পারে। সুপ্রশিক্ষিত সরকারি পরিসংখ্যানবিদের ঘাটতিই বাংলাদেশে সঠিক তথ্য দুষ্প্রাপ্যতার প্রাথমিক কারণ। তথ্য যেহেতু ভবিষ্যতের জ্বালানি হচ্ছে, সেহেতু একটি কৌশলগত খাত হিসেবে তথ্য পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনায় আমাদের একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টাইল কর্মসূচি প্রয়োজন।

কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে ব্রিটেন এবং তার মিত্রদের কয়েক ডজন পরিসংখ্যানবিদ সাহায্য করেছিলেন। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে যেমনটা উঠে এসেছিল যে ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদরা প্রতিদিন লন্ডনে নিক্ষিপ্ত জার্মান বোমার বণ্টন বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং আবিষ্কার করেছিলেন যে জার্মানরা তেমন সাফল্য ছাড়াই ডকগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল। তারা বিমানের ওপর চাপও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল যে যাতে পাখা খসে পড়ার আগেই ফ্লাইটগুলো বেশি বোমা বহন করতে পারে। উল্লিখিত যুদ্ধের পর ব্রিটিশ আমেরিকান উভয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরিসংখ্যান প্রাধান্যশীল বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। একে ঘিরে শক্তিশালী গবেষকগোষ্ঠীও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা অন্য অনেক দীর্ঘস্থায়ী অবদানের মধ্যে উৎপাদন খাতে মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উন্নয়নে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ভয়াবহ অর্থনৈতিক নিষ্পেশন। এখানেও প্রাক-স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশ মুখোমুখি হওয়া বহুমাত্রিক অসমতা-বৈষম্যের বিষয়টি বাঙালি লেখকদের লেখায় তুলে ধরতে তথ্য পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পরিসংখ্যান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল। এখন দারিদ্র্য মোকাবেলা এবং দুর্নীতি রোধে পরিসংখ্যানকে কাজে লাগানোর সময়, যাতে নাগরিকদের ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়।

 

সৈয়দ আবুল বাশার: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন