মতামত

গবেষণা-জালিয়াতি ও রাজনীতি

ড. আশেক মাহমুদ

যেকোনো স্বীকৃত গবেষণা কতটুকু নৈতিক মানদণ্ডে চলছে, তার জন্য Plagiarism শব্দটা অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করছে। Plagiarism সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। তবু কিছু কথা লেখার চেষ্টা করছি, এটা এজন্য যে বিষয়টি বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর স্বাভাবিকভাবেই গবেষণার অনৈতিকতা নিয়ে সংবাদ বিশ্লেষণ হাজির করা সাংবাদিকতারই কাজ।

কারণ সাংবাদিকতা সমাজের ক্যামেরা হিসেবে কাজ করে। তাই তার ক্যামেরার সেটিংয়ের কারণে সঠিক চিত্র আসতে পারে, আবার অন্যায়ভাবে রাজনীতির মারপ্যাঁচে কেউ ফেঁসেও যেতে পারে। গবেষণা জালিয়াতির নামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বহু সংবাদ পরিবেশনের পেরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি এখন কারো অগোচরে নেই। ফলে প্রচ্ছন্ন সাংবাদিকতা আর নীতিহীন রাজনীতির আশঙ্কা থেকে আমরা মুক্ত নই। আবার ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, আমাদের গবেষণা কতটুকু নৈতিকতাসম্পন্ন, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর তাই গবেষণার নৈতিকতা, পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আদর্শিক সাংবাদিকতার প্রয়োজন সর্বজনীন।

আমরা জানি, Plagiarism-এর বাংলা অর্থ ধরা হয় জালিয়াতি। কিন্তু এর আসল মানে না বুঝে বাংলা শব্দ যেখানে সেখানে ব্যবহার করা ঠিক নয়। আধুনিক কম্পিউটারের যুগে অন্যের লেখা নিজের নামে কপি-পেস্ট করে চালিয়ে দেয়া সহজ। তাই কতটুকু কপি-পেস্ট করল, তা ধরার জন্য আমেরিকায়ই Turnitin নামের সফটওয়্যার আবিষ্কার করা হলো ১৯৯৮ সালে। আস্তে আস্তে আমরা বিষয়ে পরিচিত হই। Turnitin সফটওয়্যার অনেক দামি বলে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর ব্যবহার সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বিষয়ে অজানার মাত্রা বেশি বলেই সাংবাদিকতার ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে।

আমি যতদূর জানি, Turnitin- কোনো রিসার্চ পেপার রান দিলে তাতে স্পষ্ট হয় কত মাত্রায় সাদৃশ্য আছে। সাদৃশ ২৫ শতাংশের নিচে হলে সবুজ দাগ দেখাবে, ২৫-৪৯ শতাংশ হলে হলুদ দাগ দেখাবে, ৫০-৭৪ শতাংশ হলে কমলা দাগ আর ৭৫ শতাংশের ওপরে হলে লাল দাগ দেখাবে। এর মানে ২৫ শতাংশের নিচে হলে সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য, ৭৫ শতংশের উপরে হলে সম্পূর্ণ নকল। কারো পেপারে যদি ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ আসে, তাহলে সেটা হলুদ কার্ড দেখাবে। কিন্তু দেখতে হবে গবেষণা কি প্রাইমারি ডাটা দিয়ে করা নাকি সেকেন্ডারি ডাটার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। Sage-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল কোম্পানি অনেক সময় ৩৫ শতাংশের মতো সাদৃশ হলেও সেই পেপার ছাপায়, যদি দেখে লেখাটি পুরোপুরি সেকেন্ডারি ডাটার ওপর নির্ভরশীল। প্রাইমারি ডাটাভিত্তিক হলে সাদৃশ অবশ্যই কম হতে হবে, কেননা ডাটা সম্পূর্ণ নিজের।

এবার আসি Plagiarism-এর ধরন নিয়ে। প্রধানত চার প্রকার Plagiarism আছে। . Direct Plagiarism: এর মানে অন্যের লেখা সরাসরি নিজের নামে চালিয়ে দেয়া . Self-Plagiarism: এর মানে নিজের আগের প্রকাশনার সঙ্গে মিলে যাওয়া। . Mosaic Plagiarism: এর মানে শব্দ গঠন পরিমার্জন করে নিজের লেখা হিসেবে চালানো। . Accidental Plagiarism: এতে ভুলবশত অন্যের কথা চলে আসে, আর নিজের নামে সাব্যস্ত হয়। Direct Plagiarism হলো সরাসরি ক্রাইম কিন্তু অন্যগুলো অনৈতিক হিসেবে গণ্য। প্রতিটার আলাদা আলাদা পার্সেন্টেজ দেখানো না হলে ক্রাইম বা অনৈতিকতার মাত্রা বোঝা যাবে না।

সেকেন্ডারি ডাটার ভিত্তিতে পেপার আর প্রাইমারি ডাটার ভিত্তিতে পেপারের মধ্যে Plagiarism-এর মাত্রাগত ভিন্নতা থাকতেই হবে। কেননা সেকেন্ডারি ডাটা বেশি হলে Plagiarism বেশি দেখাবে, এতে যদি রেফারেন্স উল্লেখ করা হয় তবুও। বহু প্রবদ্ধ সন্নিবেশ করে যদি লিটারেচার রিভিউ করা হয় অথবা বুক রিভিউ করা হয়, এতে সাদৃশের হার বাড়বে। এর কারণ সঠিকভাবে Paraphrasing বা ভাষান্তর না হলে সাদৃশের মাত্রা বেশি থাকবে। কেননা প্রবন্ধগুলোর টেক্সট রেফারেন্স উল্লেখ থাকলেও শব্দের মিলের জন্য সাদৃশ বেশি হবেই। তাছাড়া Paraphrasing বা ভাষান্তর কীভাবে করতে হয়, ব্যাপারে জানাশোনা যেমন কম, তেমনি কষ্টসাধ্য।

তাছাড়া পাবলিকেশনস বাড়ানোর ঝোঁক প্রায় সবারই কম-বেশি থাকে। কিন্তু Plagiarism সম্পর্কে ধারণা লাভের আগেই কেউ কেউ ভুলবশত মাস্টার্সের থিসিস বা রিসার্চ মনোগ্রাফ অনলাইনে ছেড়ে দেন। তা থেকে আর্টিকেল বের করতে গেলে Plagiarism বেশি আসবে। ফলে Self-Plagiarism বেশি দেখাবে। পিয়ার রিভিউড জার্নালের কাজ হবে সেই  Self-Plagiarism-এর মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য লেখককে রিপোর্ট করা, আর সংশোধনের ভিত্তিতে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া। তবে ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের জার্নাল ভালো করেই জানে কোন ধরনের পেপারে কোন মাত্রায় সাদৃশ গ্রহণযোগ্য। কারণ সাদৃশের ধরন সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অনেক বেশি স্পষ্ট।

আরেকটি সমস্যা আমরা লক্ষ করি। কীভাবে Turnitin- পেপার রান দিতে হয়, তা অনেকের কাছেই অজানা। এমনও দেখা গেছে, রিসার্চ টেবিল, গ্রাফ, রেফারেন্সসহ পুরো পেপারটাই সফটওয়্যারে রান দিয়ে দেয়। এতে ভুল রিপোর্ট দেখাবে। হওয়ার কথা ২০ শতাংশ, দেখাবে ৪০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়মকানুন না জেনে সঠিক রিপোর্ট বের করা সম্ভব নয়।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো মাথায় নেয়া জরুরি। কেননা সঠিক সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যকে বোঝার অধিকার ফিরে পেতে পারে। কারো বিরুদ্ধে যেভাবেই হোক লিখতেই হবে, এটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো, Plagiarism-এর নিয়মকানুন জেনে তার ভিত্তিতে ডকুমেন্টসহ লেখা। এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। Turnitin software-এর মধ্যে নকল বা দুর্বল মানের সফটওয়্যারও আছে। অথেনটিক Turnitin ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, সেটাও দেখতে হবে। নকল সফটওয়্যার নিয়ে বাজারে বহু বেচাকেনা হয়। বিষয়গুলো হিসাব করে লেখালেখি করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে হলুদ রাজনীতি বন্ধ করা জরুরি। Plagiarism নিয়ে হলুদ রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে গবেষণার মান উন্নত হবে না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে Plagiarism-কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পরিণতি ভালো হতে পারে না। এর চেয়ে বড় প্রয়োজন, কীভাবে গবেষণাকে মানসম্পন্ন করা যায় সেই উদ্যোগ নেয়া।    

তবে আমরা যারা গবেষণায় থাকি, আমাদের সবারই সতর্ক থাকা দরকার, যাতে আমরা একটা নৈতিক মানদণ্ডে গবেষণা করতে পারি। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া দরকার তা হলো: . Plagiarism-এর ওপর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগে ওয়ার্কশপ করা, বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক বা গবেষককে নিযুক্ত করা। . রিচার্স মেথডোলজি কোর্সের সিলেবাসে Plagiarism নামের বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, শিক্ষক যেন পাঠদানের সময় এর বিষয়াদিসহ ভাষান্তর কীভাবে করতে হয় তা শেখাতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। . প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ফ্যাকাল্টিতে অথেনটিক Turnitin সফটওয়্যার ক্রয় করে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া। . Plagiarism সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত হয়ে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য সাংবাদিকদের যথোপযোগী উদ্যোগ নেয়া। আমরা চাই সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে পরিচ্ছন্ন গবেষণার মনোবৃত্তি যেন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। 

 

. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন