আলোকপাত

উত্তরসূরির সমস্যা ও দেশের পারিবারিক ব্যবসার ভবিষ্যৎ

ড. আরএম দেবনাথ

পারিবারিক ব্যবসা সম্পর্কে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮ সালের শেষ দিকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন (১৮.১২.১৮) একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সরকার যাতে নিয়ন্ত্রণ নেয় এজন্য একটি গ্রুপের প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা পড়েছে। তিনি বলেন, এর কারণ তিনি জানেন না। তবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকের শরীর ভালো নয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক গ্রুপকেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তিনি আর একটি বিশাল বিজনেস গ্রুপের কর্ণধার সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। জিজ্ঞেস করেন ওই মালিকের উত্তরসূরি কে? দুটো মন্তব্যের সার কথা একটাই উত্তরসূরি কে? প্রথম গ্রুপটির মালিকের শরীর ভালো নয়, এতে কী হয়েছে? তার ছেলেমেয়ে তো নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও গ্রুপের কর্ণধার সরকারকে অনুরোধ করেছেন তার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে। বিষয়টি অস্বাভাবিকই বটে। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি কে সরকারের হাতে তুলে দেয় বাধ্য না হলে। এখানে দেখা যাচ্ছে আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, স্বাস্থ্যগত অবস্থাই দায়ী। এবং বোঝা যায় উত্তরসূরিদের ওপর মালিকের ভরসা খুবই কম। দ্বিতীয় যে গ্রুপের কর্ণধারের কথা তিনি নাম উল্লেখ করেই বলেছেন সেই গ্রুপটি উদীয়মান, কিন্তু বর্তমানে বিশাল এবং খুবই প্রভাবশালী। ব্যাংক, বীমা, -আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আমদানি-রফতানি ব্যবসা এবং বিভিন্ন শিল্পে তার বিনিয়োগ বিশাল পরিমাণের। বিদেশেও তার ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ, অফিস বিল্ডিং আছে বলে খবরের কাগজে বিস্তারিত প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু এই গ্রুপের সমস্যা কী? ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করলে, উন্নতি করলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি কী? বরং তা তো দেশের জন্য, অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক খবর। কিন্তু সমস্যাটা এখানে নয়। মুহিত সাহেবের জিজ্ঞাসা: তার উত্তরসূরি কে? আশঙ্কা থেকে তিনি ওই উদ্যোক্তাকে একটি হুমকি (থ্রেট) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হুমকিটি কী, অতিরিক্ত ব্যবসা সম্প্রসারণের হুমকি, নাকি উত্তরসূরি সম্পর্কিত হুমকি। প্রশ্নটি তিনি তুলেছেন, কিন্তু কোনো উত্তর দেননি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত এখন আর অর্থমন্ত্রী নন। তিনি অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। মুহিত সাহেবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মুস্তফা কামাল। তিনি, অর্থমন্ত্রী প্রায় বছর দুয়েক। তিনি স্বনামধন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মেধাবী ছাত্র ছিলেন। উপরন্তু তিনি অত্যন্ত সফল একজন ব্যবসায়ী বলে খ্যাত। ব্যবসা-বাণিজ্যের অলিগলি তিনি চেনেন জানেন। মুহিত সাহেব ছিলেন চৌকস আমলা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দুই ব্যাকগ্রাউন্ডের দুজন অর্থমন্ত্রী (একজন সাবেক এবং আরেকজন বর্তমান) পারিবারিক ব্যবসা সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের ধারণা রাখেন। কীভাবে তা বুঝলাম? বুঝলাম তার একটি সতর্ক বাণী থেকে। সতর্কতার কথাটি তিনি ব্যাংকারদের জানিয়েছিলেন (১০..১৯) ব্যাংকের চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের এক সভায় বলেছিলেন, সন্তান-সন্ততি বিদেশে বসবাস করছে এমন পরিবারকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যটি ততটা সরাসরি নয়। তবে বুঝতে কষ্ট হয় না যে এটিও পারিবারিক ব্যবসার উত্তরসূরি সম্পর্কিত বিষয়। ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন উদ্যোক্তা। হয়তো সফল এবং বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অধিকারী। কিন্তু উদ্যোক্তার সন্তান-সন্ততি দেশে নেই। তারা থাকে ভিন দেশে। তাদের ঋণ দিলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে দুজনই পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে উত্তরসূরির প্রশ্নটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।

আমাদের দৈনন্দিন খবরের কাগজের আলোচনায় উত্তরসূরির প্রশ্নটি সেভাবে আসছে না। আমরা খেলাপি ঋণ, ঋণখেলাপি এবং ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে চলে যাওয়া ব্যবসায়ীদের আলোচনা খবরের কাগজে অধিকতর পাচ্ছি। এটা খুবই স্বাভাবিক। মুশকিল হচ্ছে, বর্তমানকে ভালো করে বোঝার চেষ্টায় যদি ভবিষ্যতের সমস্যার কথা আমাদের হিসাবের মধ্যে না থাকে, তাহলে এক সময়ে বিপদ হতে পারে। এক সময়ে কেন, এরই মধ্যে আমাদের দেশে পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে উত্তরসূরিগত তীব্র সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সম্পর্কিত একটি গবেষণার কথায় পরে আসছি। আগে দুটো সাম্প্রতিক খবরের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রথম খবরটি স্বনামধন্য একটি বড় গ্রুপের। এর নাম আবদুল মোনেম লিমিটেড বণিক বার্তার খবরের একটি শিরোনাম হচ্ছে: আবদুল মোনেম লিমিটেড পুত্রদের ঐক্য ধরে রাখতে ব্যবসার হাল ধরলেন মা। মা মানে মোনেম সাহেবের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা। গ্রুপটির ব্যবসার শুরু ১৯৫৬ সালে। ধীরে ধীরে আবদুল মোনেম লিমিটেড বড় হয়েছে বড় থেকে আরো বড় হয়েছে, মোনেম সাহেব মারা যান গত ৩১ মে। তার দুই ছেলে তিন মেয়ে। তাদের মধ্যে দুজন বিদেশে। তাদের মধ্যে এখন হিস্যা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছে। এদিকে প্রধান নির্বাহী কোম্পানি ছেড়েছেন। পেশাদার কর্মীরা এখন দুর্নীতি করছে বলে খবরে প্রকাশ। গ্রুপটির অধীনে মোট কোম্পানি ১২টি। তাদের ব্যাংকঋণ হবে শত শত কোটি নয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বলাবাহুল্য ঋণদাতা সব ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আবদুল মোনেম লিমিটেডের পরের খবরটি সিকদার গ্রুপের। গ্রুপের অধীনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মোট ১১টি। তাদের রয়েছে একটি ব্যাংক। বিদ্যুৎ, আবাসন, নির্মাণ শিল্পে তারা নিয়োজিত। বণিক বার্তার (২৭..২১) খবরে প্রকাশ, এর মালিক উদ্যোক্তা জয়নুল হক সিকদার সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তিনি অত্যন্ত গরিব অবস্থা থেকে বড় হয়েছেন। কর্মজীবন শুরু করেন ড্রাইভার হিসেবে ১৯৫৭ সালে। তার মোট আট সন্তান। খবরে প্রকাশ, তাদের প্রায় সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। দুজন ফৌজদারি মামলার আসামি। সিকদার সাহেবের মৃত্যুর পর পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে উত্তরসূরিদের মধ্যে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রুপের হাল ধরেছেন সিকদার সাহেবের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। অথচ তাদের ব্যাংকঋণ প্রায় হাজার কোটি টাকা।

ওপরে চারটি বড় বড় গ্রুপের খবর দিলাম। বড় বড় গ্রুপ মানে সত্যি সত্যি বড়। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এরা। প্রথম দুটোর নাম উল্লেখ করিনি। দ্বিতীয় দুটোর নাম দিলাম। দুটোর মালিক সদ্য প্রয়াত। এবারে ভিন্ন ধরনের আরেকটি খবর দেব, যা আমাদের ভাবার সুযোগ দেবে। গত মার্চের একটি বিজ্ঞাপন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড বিজ্ঞাপনের শিরোনাম: চেক ডিজঅনারের মামলায় সিনহা স্পিনিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান-এমডি এবং পরিচালকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা চেয়ারম্যান পরিচালক যথাক্রমে আনিসুর রহমান সিনহা এবং আরিফুর রহমান সিনহা। দুজনেরই ছবিসহ বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়েছে। ভাবা যায়, ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মালিকের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বণিক বার্তার (..২১) খবরের শিরোনাম: ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কারখানা এখন নিবুনিবু করছে খবরে প্রকাশ গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানায় একসময় ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এখন ১৩-১৪ হাজার। আনিসুর রহমান সিনহা তার কারখানা বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এত বড় ব্যবসা কেনার মতো ক্রেতা নেই। খবরে প্রকাশিত আনিসুর রহমান সিনহা পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা। আজ থেকে ৩৬-৩৭ বছর আগে কাঁচপুরে ৪৩ একর জমির ওপর তিনি তার কারখানাটি স্থাপন করেন। পথিকৃৎ এখন নিবুনিবু। তিনি বোঝামুক্ত হতে চান। কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। ব্যাংকে ব্যাংকে তার দেনা প্রচুর। এসব খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত। পরিপ্রেক্ষিতে যখন সিনহা সাহেবের ছবিসহ বিজ্ঞাপন ছেপেছে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক, তখন তার একমাত্র সন্তান তানজিয়া সেমহা দেশে নেইযুক্তরাজ্যে। দেখা যাচ্ছে এখানেও উত্তরসূরির সমস্যা লুক্কায়িত।

বস্তুত বাংলাদেশে বড় বড় পারিবারিক ব্যবসায় উত্তরসূরির সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটার হাউজ কুপারস (পিডব্লিউসি) পারিবারিক ব্যবসার ওপর সম্প্রতি একটি জরিপের খবর কাগজে দিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের পারিবারিক ব্যবসাগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরই উত্তরসূরি কে হবে তার কোনো পরিকল্পনা নেই। সুশাসন যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব সর্বত্র। ভঙ্গুর পরিস্থিতি লক্ষণীয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালিকের মৃত্যুর পর পারিবারিক দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাস্তব ঘটনা এবং পিডব্লিউসির জরিপের তথ্য প্রায় একই। বস্তুত সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। চট্টগ্রামে আমাদের পুরনো অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ছিলেন। তাদের অনেকেরই শুরু পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি সময়ে। তাদের বয়স হয়েছে। অনেকে প্রয়াত হয়েছেন। সেখানেও দেখা যাচ্ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব চরমে। কারণে ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে। ব্যাংকের টাকা আটকা পড়ছে। ব্যাংকে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের মামলা বাড়ছে। জেল-জরিমানা হচ্ছে। বহু নামিদামি প্রতিষ্ঠান এখন ঋণখেলাপি।

মূল মালিক জীবিত নেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে একতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা ধরে রাখার মতো যোগ্যতাও নেই। সমস্যার দৃশ্যত শিকার ব্যবসার মালিক তাদের পরিবার, কিন্তু শেষ বিচারে এসবের বোঝা কিন্তু ব্যাংকের ঘাড়ে।

যে কথাটি বলা দরকার বলে মনে করি তা আমার মনে হয় আমাদের আলোচনার মধ্যে নেই। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ঋণখেলাপি নয়। নানাভাবে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেউ যোগ্যতার বলেই টিকে আছে, কেউ কেউ সুযোগ-সুবিধার বলে টিকে আছে। কিন্তু তাদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে লুক্কায়িত বিশাল এক সমস্যাউত্তরসূরির সমস্যা। যোগ্য, শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত উত্তরসূরি খুবই কম। অনেকেরই ছেলেমেয়ে বিদেশের নাগরিক। তারা দেশে ফিরতে আগ্রহী নয়। শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার দায়-দেনাসহ বিশাল বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষতা অনেকেরই নেই। আবার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করার ইচ্ছাই তাদের নেই। তারা মুনাফা ভাগাভাগি করতে চান না। আবার চান না নিয়মকানুনের মধ্যে আসতে। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতার মধ্যে আসা মানেই নানা সমস্যা। অর্থাৎ তারা ম্যানেজমেন্টকে প্রফেশনালাইজ করতেও রাজি না। অনেকে দেশেও থাকতে চান না। অনেকের সন্তান-সন্ততি বিদেশে। অবস্থায় যা ঘটার তাই কিন্তু ঘটতে শুরু করেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে, কেউ কেউ জেলে যাচ্ছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওইসব প্রতিষ্ঠান বিক্রি করতে গেলে কোনো ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ব্যাংকের টাকার কী হবে? ঋণ খেলাপির ওপর আলোচনার পাশাপাশি সম্পর্কেও আলোচনা দরকার।

 

. আরএম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন