আমার বাবা আমার শিক্ষক

কারিশমা ফারহীন চৌধুরী

একটু বড় হওয়ার পর থেকেই আমি আমার ভাই বুঝতে পারি যে আমাদের বাবা অন্যদের বাবা থেকে কিছুটা আলাদা। তিনি সব সময় অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন এবং আমাদের স্কুলের পড়াশোনা বা ফলাফল নিয়ে তার কোনো বিকার নেই। তিনি আমাদের স্কুলে ভালো ফলাফলের জন্য কোনো চাপ তো দেনই না, বরং পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করলে বা খারাপ ফলাফল করলে অভয় দেন যে স্কুলের ফলাফল পরবর্তী জীবনের সাফল্যে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। তিনি বলেন, স্কুলের পরীক্ষাভিত্তিক পড়াশোনা নিয়ে বেশি হাঁপিয়ে উঠলে জীবনেরম্যারাথন’- ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার বদলে একটা কঠিন অংক পারলে বা বিতর্ক/ কুইজ/ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেলে তিনি বেশি খুশি হন। এভাবেই কাটে আমাদের বাবা জামিলুর রেজা চৌধুরীর সংস্পর্শে আমাদের ভাবনাহীন শৈশব।

স্কুলজীবনে আমার বন্ধুবান্ধবরা গল্প করত, তাদের বাবারা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করতে বলতেন। আমি শুনে অবাক হতাম, কারণ আমার বাবা বলতেন তার উল্টোটা। তার জীবনদর্শন ছিল, ‘লাইফ ইজ ম্যারাথন, নট স্প্রিন্ট তাই সারাক্ষণ পড়ালেখা করা বা স্কুলে প্রথম হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন বিষয়ে কৌতূহলী থাকা এবং শেখার যাত্রাটা উপভোগ করা।

বাবার সঙ্গে আমার শৈশবেরকম প্রিয়একটা স্মৃতি হচ্ছে তার কাছে অংক শেখা। গণিতে গতানুগতিক মানদণ্ডে ভালো হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপারে আমার বাবাকে খুশি করতে পারা ছিল দুরূহ কাজ। -১০ বছর বয়সেই আর্মস্ট্রং নাম্বার, হেক্সাগোনাল নাম্বার, ফিবোনাচি সিরিজের মতো জটিল বিষয় এবং নানা রকম মানসাঙ্ক শিখিয়ে তিনি আমার শৈশব জর্জরিত করেন।

তিনি ছোট-বড় সবার সঙ্গে সমান আগ্রহ নিয়ে গল্প করতেন। ছোটরা তাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি সহজ করে বলতে গিয়ে অশুদ্ধ উত্তর দিতেন না। তার ভাষ্য ছিল, সঠিক অথচ জটিল উত্তরটি শিশুরা তাত্ক্ষণিকভাবে না বুঝলেও তাদের মতো করে জরুরি অংশটি আত্মস্থ করবে এবং পরে কোনো একসময় এটি তাদের পুরো বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের যৌথ পরিবারের সব শিশুকেই অনুসন্ধিত্সু হয়ে বড় হতে সাহায্য করেছে। তিনি পরিবারের সব দুষ্টু চঞ্চল বাচ্চার কাছে বিশেষভাবে প্রিয় ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘দুষ্টু বাচ্চা মানে বুদ্ধিমান বাচ্চা।আমি, আমার ভাই পরে আমার ছেলে তার এইদুষ্টুমি করার অনুমতিরপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে একটি আনন্দময় শৈশব উপভোগ করেছি।

মূলত, আমার বাবা ছিলেন স্বশিক্ষায় এবং পরোক্ষ শিক্ষায় বিশ্বাসী। তাই আমাদের নিয়ম করে কখনো তার কাছে পড়তে বসতে হতো না। তবে পরোক্ষভাবেখাবার টেবিলে, গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময় বা লোডশেডিংয়ের রাতগুলোতে তার নানান বিষয়ে গল্প থেকে অনেক কিছু শেখা হয়ে যেত। তিনি ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন এবং সুযোগ পেলে আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই আমাদের গন্তব্য হতো সাধারণের চেয়ে কিছুটা আলাদা। প্রতি বছর শীতকালে আমাদের প্রবাসী স্বজনরা দেশে বেড়াতে এলে আমরা ঢাকার বাইরে নির্মীয়মাণ বা সদ্যনির্মিত কোনো প্রকৌশল স্থাপনা দেখতে যেতাম। এভাবে আমাদের দেখা হয়েছিল তিস্তা ব্যারাজ, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি এবং পরবর্তী সময়েড বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় উল্লেখ্য। প্রথমত অনেক ক্ষেত্রে এসব জায়গায়, বিশেষত নির্মীয়মাণ প্রকল্প এলাকাগুলোয় কিছুটা ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকত। হয়তো বিপজ্জনক কোনো পথ দিয়ে যেতে হবে অথবা যেকোনো সময় অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ঝুঁকির কোনো সম্ভাবনা থাকলেও আমি মেয়ে বলে তিনি গতানুগতিক অভিভাবকদের মতো আমাকে কখনো তার সঙ্গে যেতে বাধা দেননি। বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একদিকে যেমন আমার লোহার বালতি চড়ে মধ্যপাড়া খনিতে মাটির প্রায় ৩০০ মিটার নিচে নামার সৌভাগ্য হয়েছিল, অন্যদিকে আমার জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও সমসাময়িক মেয়েদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়েছিল।মেয়ে বলে আমি এই কাজটা করতে পারব না’— ধরনের চিন্তা আজ পর্যন্ত কোনো কাজে আমার কখনো মনে হয়নি। বিশেষত জীবনের প্রথম ২৪ বছর যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার পর ২০০২ সালে একা যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে পিএইচডি করতে পাড়ি জমাতে বা পরবর্তী জীবনে, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং কাজের দায়িত্ব নিতে কোনো ভয় বা দ্বিধা কাজ করেনি।

দ্বিতীয়ত, প্রকল্পগুলো দেখানোর সময় একটা বিষয়ে তিনি সব সময় আক্ষেপ করতেনআমাদের দেশে যোগ্য প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্পগুলো নির্মাণে তাদের যথাযথ অবদান রাখার সুযোগ থাকত না। বিশেষত, যেসব প্রকল্প বিদেশী অনুদান বা ঋণের টাকায় বাস্তবায়িত হতো সেসব প্রকল্পে, অনেক ক্ষেত্রেই দাতা বা ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো নানান রকম শর্ত জুড়ে দিত, যার কারণে আমাদের দেশের যোগ্য প্রকৌশলীদের বদলে, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী উপদেষ্টাদের কাজের দায়িত্ব দেয়া হতো। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক অনুদান বা ঋণের সিংহভাগ দেশের বাইরে চলে যেত, অন্যদিকে আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের চ্যালেঞ্জিং কাজে অবদান রেখে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের কোনো উপায় থাকত না। যেন ছিল এক পৌনঃপুনিক চক্র! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কারণে, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি তার কাছে বিশেষ অর্থবহ ছিলসরকার আমাদের দেশের নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পে দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে সবচেয়ে যোগ্য প্রকৌশলীদের নিয়োগের পথ উন্মুক্ত করেছিল এবং দেশে কর্মরত প্রবাসী অনেক বাংলাদেশী প্রকৌশলী সেতু নির্মাণে তাদের দক্ষতার পরিচয় রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

নতুন প্রযুক্তির প্রতি আমার বাবার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। সেই সুবাদে, বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের উন্নত দেশের অনেক ছেলেমেয়েদের চেয়ে অল্প বয়সে আমাদের কম্পিউটার ইন্টারনেটে হাতেখড়ি। নতুন কোনো কিছু শেখার ব্যাপারেও তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আগ্রহ ছিল। সেটা আমার আট বছরের ছেলের কাছ থেকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের নতুন কোনো ফিল্টার হোক বা আমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ভাগ্নির কাছ থেকে কভিড-১৯-এর জেনোমিক বিশেষত্ব হোক।লাইফলং লার্নিংকী এবং সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি আমাদের হাতেকলমে শিখিয়ে গেছেন।

পেশাগত শিক্ষা দিকনির্দেশনার পাশাপাশি বাবার কাছ থেকে যে জীবনের মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়েছি তা কোনো অংশে কম মূল্যবান নয়। এক্ষেত্রেও তিনি কোনো উপদেশ আমাদের দেননি। বরং নিজের জীবনাদর্শ দিয়েই দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন সততা, অধ্যবসায় সহমর্মিতা। বাবার কাছে কেউ কোনো সাহায্যের জন্য এলে তিনি যদি কোনো কারণে সাহায্য করতে নাও পারতেন, অন্তত সুপরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করতেনহোক সেই সাহায্যপ্রার্থী কোনো আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কোনো ছাত্রছাত্রী বা সহকর্মী অথবা স্বল্পপরিচিত বা অপরিচিত কেউ।প্লেইন লিভিং, হাই থিংকিং’-এর অনন্য উদাহরণ ছিলেন তিনি।

আমার বাবা পদ্মা ব্রিজের উদ্বোধন আর বাংলাদেশের ২০২১ আইসিপিসি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের আয়োজন সশরীরে দেখে যেতে পারেননি। পারেননি জেনে যেতে বাংলাদেশ কবে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হবে বা কবে কোনো একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবেন। কিন্তু তার বহু প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ছাত্রছাত্রীকে তিনি সেই ভবিষ্যৎ সুদিনের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে গেছেন। আমার দুর্ভাগ্য, তিনি কীভাবে তাদের আশাবাদী করতেন বা অনুপ্রাণিত করতেন সেই রহস্যটা তার কাছ থেকে শেখার আগেই তিনি চলে গেছেন।

 

কারিশমা ফারহীন চৌধুরী: জামিলুর রেজা চৌধুরীর কন্যা

সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিডস, যুক্তরাজ্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন