শোকের আগস্ট

বঙ্গবন্ধু—বাঙালির মানসপটে এক দিগ্বিজয়ী দার্শনিক

রেজওয়ান উর রহমান

দেশে মুজিব বর্ষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ আজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে। একটা জাতির জন্ম তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম অভ্যুত্থান যাঁর আহ্বানে নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজকে গভীরভাবে এবং সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর এই অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করছে। জয় বাংলা! আমার জন্ম তাঁর প্রয়াণেরও পাঁচ বছর পর। আমার কোনো দিন আর সেই সৌভাগ্য হবে না তাঁকে কাছ থেকে দেখার। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকেই দেখতে শুরু করেছি সামরিক শাসন। মনে করেছি এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি যে সামরিক আমলারা অনেক বেশি দক্ষ কর্মঠ। স্কুলে যখন পিটি করতাম, তখন বিশ্বাসটা আরো চেপে বসল, মনে হতো আমাদেরকেও হয়তো একদিন সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, আমার বাবা একজন বেশ উচ্চপর্যায়ের বেসামরিক আমলা ছিলেন, কিন্তু যা হয়, বাবাকে একটা বয়স পর্যন্ত সবাই ভয় পায়, তার পরে সন্তান বুঝতে পারে যে তার বাবা কী ছিল, তখন দেখা যায় সন্তানটিও বাবা হয়ে গেছে! তখন টিভি চ্যানেল বলতে ওই যক্ষের ধনের মতো সেই বিটিভি! মানুষ তখন আয়োজন করে অনুষ্ঠান দেখত। আহারে কী ছিল সেইসব দিন! অনেক দিবসে হরেক অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, কিন্তু কেন জানি না কোনো দিন ১৭ মার্চ অথবা ১৫ আগস্ট তেমনভাবে চোখে পড়েনি! হয়তো খবরের কাগজের এক কোণে চোখে পড়েনি। পাঠ্যবইয়ে কখনো পড়িনি শেখ মুজিব কে? কী তাঁর পরিচয়? আমরা যখন হাইস্কুলে পড়ি, অনেক বই পড়ানো হতো বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো দিন বলেনি যে তোমার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানা উচিত কিংবা তুমি কি জানো কীভাবে বাংলাদেশের জন্ম? এটা এই কারণে বলছি যে ওইটুকু পিপাসা থাকলে হয়তো অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারতাম, কেননা বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু কখনো দুটি আলাদা নাম হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু চলতে থাকল, আমাদের প্রজন্ম নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান দেখেছে, অনেক কিছুই পরবর্তী সময়ে দেখলাম। তখন যেটা বুঝতে পারলাম, সেটা যদি না জানতাম তাহলে আরো ভালো হতো! শুধু জানলামই না, বিশ্বাসও করলামশেখ মুজিবুর রহমান হলেন শুধু একজন সাবেক প্রথম রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান হলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি! ব্যস, হয়ে গেল! মনে করলাম আচ্ছা! এই ব্যাপার! তাহলে সেই মোতাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মতো তাঁরা সাবেক রাষ্ট্রপতি। কত দেশে কত সরকারপ্রধান আসেন, আবার চলেও যান, বাংলাদেশেও তা-, কী আর ব্যতিক্রম!

এরপর তো ঘটনা অনেক দেখলাম ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোরগোল শুনলাম দেশের ইতিহাসের একজন নেতিবাচক চরিত্রস্বরূপ: যেমন তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না, তিনি ছাত্রজীবন থেকে একজন উড়নচণ্ডী, উগ্র মননের, ছিলেন একরোখাআরো কত কী! এখন ওইদিনগুলোর কথা মনে হলে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়। তো সেই উদ্ভট চিন্তাভাবনা নিয়েই বড় হতে থাকলাম। মজার ব্যাপার হলো, যখন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এল, অনেক কিছু দেখলাম, সব কয়টি টিভি চ্যানেলে বঙ্গবন্ধুর সেই বঙ্গশার্দূলস্বরূপ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, অনেক ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি। তখন শুধু মনে হয়েছে যে আওয়ামী লীগ তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হয়তো বঙ্গবন্ধুকে প্রচার করছে, পণ্যসামগ্রীর ন্যায় সবকিছুর নামকরণ হচ্ছেবঙ্গবন্ধু’! এই অধম ভাবছে আসলেই তিনি মনে হয় শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা। সেই সময়ে চলছে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এক প্রকারের নোংরামি সেটাকে ঘিরে নানা রকম অপাঙেক্তয় উক্তি সীমাহীন ভণ্ডামি। খেয়াল করে দেখলাম, চারপাশের আত্মীয়স্বজনও কিঞ্চিৎ বিরক্ত। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার অনেক কাছের মানুষগুলোর জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মতো প্রলাপ এবং মরা বাড়ির মতো বিলাপ, কিছুটা অন্তঃসারশূন্য যুক্তি; যা কিনা বৃথা আত্মতুষ্টির নেশায় রাজনৈতিক তর্কাতর্কি কিংবা আহাজারি। এই কিশোর মনে অনেক প্রশ্ন উঠত, কিন্তু বিচিত্র এই সেলুকাস! দেখছি সবাইকানা ছেলের নাম পদ্মলোচনদৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বকে যাচ্ছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম—‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

এর পরে শুধু লেখাপড়া হলো, চাকরি করলাম বেশ কিছুদিন। পাঠ্যপুস্তকের ওপরে একপ্রকার নিরাশা হতাশা জন্ম নিল এবং সেটার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ল সামগ্রিকভাবে বই পড়ার ওপর। অগত্যা কী আর করা! কিন্তু এই অপদার্থ তখনো বোঝেনি যে কী ক্ষতি সে করে ফেলেছে। এর পরে মাথায় একটা ভূত চাপল নর্থ আমেরিকান ডিগ্রির। চিন্তা করিনি যে সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য বা মেধা আছে তো? দেখি চেষ্টা করে! হয়ে গেল এবং দেশান্তরী হলাম। প্রবাসে এসে সেই লেখাপড়া, ভালো ফলাফল করতে হবে, না হলে ভালো চাকরি হবে না। সবকিছু সুন্দর মতো যাচ্ছিল। প্রবাসে বসবাসরত আমার এক স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চিত্ত জাগ্রত হলো। সে বলল, তুই অবসরে কী করিস? আমি বললাম, মুভি, ইউটিউব আর ঢাকায় কথা বলি মা-বাবার সঙ্গে। বলল, তুই তো এখানে অনেক সময় পাচ্ছিস, বই পড়িস না কেন? আমি বললাম, বই পড়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ! বলল, শুরু কর, তোর তো লেখার প্রতি আগ্রহ আছে, না পড়লে কী লিখবি? তখন ভাবলাম, তো ঠিকই বলছে! দেখি না একবার চেষ্টা করে! আবার ভাবলাম, কী পড়ব? কাকে নিয়ে পড়ব? কী জানতে চাই? কী জানা উচিত? অগ্রাধিকার কোনটা আগে হবে? রকম নানান জটিলতা! ঠিক সেই মুহূর্তে মনে এল, আচ্ছা আমি যে একজন বাংলাদেশী, কিন্তু আমি তো বাংলাদেশের ইতিহাসটা ঠিকমতো জানি না! হায়রে! ভাবলাম এখান থেকেই হোক পথচলা। বাল্যকাল কৈশোরে ফিরে গেলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে পারিবারিকভাবে আমরা কিছুটা সাংস্কৃতিক ঘরানার, আমার মা জাতীয় পর্যায়ে একজন নজরুলসংগীত শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগরএসব মনীষীকে নিয়ে কিছুটা পড়া হয়েছে, কিন্তু ভীষণভাবে অপ্রতুল। ঠিক করলাম আরেকজনকে না জানলেই নয়বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হলো। তাঁকে বুঝতে চাইলাম, চেষ্টা করলাম একটি নিরেট নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই মহীয়সী মানুষটাকে জানার। এখানে বলে রাখতে চাই, আমি কস্মিনকালেও কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ ভক্ত নই, সেই কারণে আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মতাদর্শ দর্শনকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। যে সময়টার কথা বলছি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মার্চের ভাষণ ততদিনে জাতিসংঘের সনদ পেয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ গ্রন্থকার জ্যাকব এফ ফিল্ডের বইউই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি সূচিপত্রে দেখি—‘1971- The Struggle This Time is the Struggle for Independence- Sheikh Mujibur Rahman. অনেক গর্ব অনুভব করলাম। বইটায় অন্য যাঁদের ভাষণ রয়েছেআব্রাহাম লিংকন, চার্চিল, ভ্লাদিমির লেলিন, এডলফ হিটলার, চার্লস ডি গল, মাও জে দং, হো চি মিন, রোনাল্ড রিগ্যান, নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটনসহ আরো ইতিহাসের মহামানব। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো নাম উল্লেখ নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি গর্ব!

বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতি চিনতে শুরু করে প্রধানত আইয়ুববিরোধী একজন বিদ্রোহী আপসহীন নেতা হিসেবে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন, কিন্তু পরোক্ষভাবে জেলে বসেই প্রতিবাদ করেছিলেন। আরেকটু পেছনে ফিরলে ১৯৪৬ সালে ভোটের প্রচারে অংশগ্রহণ আলোচনার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের উত্পত্তি হয়অল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু দেশে এলেন এবং তখন মোগলটুলীতে হলো ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস। সময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা মূল বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ভিত্তিই হচ্ছে মাতৃভাষা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই রাষ্ট্রভাষা কী হবে, নিয়ে বিতর্ক ছিল। আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেহাদ পত্রিকায় লিখেছেন, . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা।১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হলো, বঙ্গবন্ধুর লেখায়ও আছে, তখনো অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ছিল। ১৯৫৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ক্ষমতায় এল, সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন ধর্মের ভিত্তিতে ভোটাধিকার বাতিল করে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে সমান মর্যাদা দেয়া হলোএক ব্যক্তি এক ভোট। সোহরাওয়ার্দী পার্লামেন্টে জোরালো বক্তৃতা দিয়ে এটা পাস করলেন। এভাবেই আমাদের জাতীয়তাবাদের তিনটি ভিত্তি গড়ে উঠেছেভাষা, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের কথা বলার অধিকার এবং গণতন্ত্র। এর ভিত্তিতেই পূর্ববঙ্গে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে।

১৯৫৮ সালে প্রথম দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ভোটার তালিকা তৈরি করা হচ্ছিল। তখনই এল মার্শাল ল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জাঁতাকলে শাসনতন্ত্র নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার দাবি শানিত হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে এসে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাটিই স্বাধিকার সংগ্রামে রূপ নিতে থাকে। স্বাধীনতার একটি প্রচ্ছন্ন চেতনা বাঙালিদের মধ্যে দেখা দেয়, যা সর্বাগ্রে বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, ‘এভাবে হবে না, আলাদা হতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের পথে এগোতে হবে।মূলত তাঁর এই স্বাধীনতার চেতনা একটি স্বাধীন বাংলাদেশের দর্শন থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন সমগ্র বাঙালির জাতীয় নেতা। জাতীয় নেতা যখন হয়েছেন তখন তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। জাতিকে মুক্ত করতে হলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে ভেবেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, এখানকার মানুষ মুসলমান-হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি। সবার ভাষা বাংলা। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ মেঠো ভাষায় ছয় দফাকে অলংকৃত করেছিলেন মাত্র তিনটি বাক্য দিয়ে—‘কত নেছ, কত দেবা, কবে যাবা?’ তিনি এর পরে ছয় দফা মুক্তির সনদের ভিত্তিতেই৭০-এর নির্বাচনে লড়েছেন। তাতে ৯০ শতাংশ মানুষ তাঁকে সমর্থন করেছে। ছয় দফার পুরোটাই জাতির সার্বিক বিকাশ জাতীয়তাবাদের আন্দোলন। প্রেক্ষাপটেই চলে আসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতিজাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ শুধু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের দর্শন নিয়েই ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্রিয়ামূলক প্রতিষ্ঠান যেন এই দর্শন নিয়ে গঠিত হতে পারে। কেননা তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি দেখেছেন সামাজের গরিব-দুঃখী মানুষগুলো কীভাবে নির্যাতিত হয়, কীভাবে তাদেরকে দিনের পর দিন অবহেলিত হতে হয় শুধু মৌলিক অধিকারের জন্য। সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ঔপনিবেশিক দুঃশাসনে দুষ্টচক্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাঁর যে মনন জগৎ গঠিত হয়, তার আলোকেই সৃষ্ট তাঁর রাজনৈতিক বোধ এবং সর্বমানবিক কল্যাণের আদর্শ। রাজনৈতিক কৌশল, কর্মসূচি পরিকল্পনায় তিনি ছিলেন হাড়ে-মজ্জায় নিখাদ এক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতীয়তাবাদী নেতা হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রকার জাতীয়তাবাদী উগ্রতা, ক্ষুদ্রতা, জাতিবিদ্বেষ বা অন্য জাতির প্রতি অসূয়া তাঁকে স্পর্শ করেনি। কারণ তাঁর মানবিক শ্রেয়বোধ ছিল প্রকট, গণতান্ত্রিক চেতনা ছিল সর্বমানবিক এবং ন্যায় মানুষে মানুষে বৈষম্য নয়, সাম্যে ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি যেমন সাম্রাজ্যবাদের তীব্র বিরোধী ছিলেন, ঠিক ততটাই জাতীয়তাবাদের একজন ঘোর প্রবাদপুরুষ ছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদের মূল দর্শনই ছিল—‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, যদিও ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ পৃথক হয়েছে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এই বৈষম্য কোনোভাবেই চলতে দেয়া যাবে না। এই সূত্র ধরে তিনি আরেকটি ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না, এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এবং এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের, যারা এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।’ [চলবে]

 

রেজওয়ান উর রহমান: আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র

[email protected] 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন