একজন একাগ্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকার

আনিস এ. খান

মাঝে মাঝে আমরা বিশেষ বিশেষ উপহার দিয়ে বর্ষিত হই, অলংকৃত হই। কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে আল্লাহ মালিক কাজেমীর উপস্থিতি আমাদের জন্য ছিল তেমনই এক উপহার, যা আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার সমৃদ্ধিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আমরা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। ১৯৮০-এর দশকের তরুণ সংবেদনশীল ব্যাংকার হিসেবে আমরা আল্লাহ মালিক কাজেমী নামটি শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। আমরা তখন বাংলাদেশে আর্থিক খাত সংস্কার প্রকল্প এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সুদহার বিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে ছিলাম, যা আমরা বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করছিলাম। একটি ব্যাপকতর নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে যাত্রার উদ্দেশ্যে সূচিত এসব পরিবর্তনের পেছনের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন কাজেমী। 

শ্রদ্ধেয় কাজেমীর সঙ্গে আমার কয়েকটি ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। মনে পড়ে, একবার কি দুবার একটি বিষয়ে আলাপের জন্য তিনি আমাকে তার অফিসে ডেকেছিলেন, তার সামনে বসিয়ে ওই বিষয়টির অংকটি কষার জন্য বলেছিলেন। তার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা বাহ্যিকভাবে কঠোর দৃষ্টির সামনে অনেকটা কম্পিত হয়ে আমি ওই বিষয়টির সুরাহা করেছিলাম, যদিও তার দিক থেকে কিছুটা বুদ্ধি-পরামর্শ পেয়েছিলাম।

আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি তখন একটি ব্যাংকে কর্মরত। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল আমাদের ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশনে কিছু অনিয়ম ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল। ত্রুটিগুলো ছিল খুবই সামান্য বা ক্ষুদ্র, তবু বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং তাদের ব্যাপারে প্রতিবেদন পাঠানোর কথা বলেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শিগগিরই অবসরে যাবে এমন এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক এবং আরেকজন ছিলেন তরুণ নারী কর্মকর্তা, যার ওপর পুরো পরিবারই নির্ভরশীল। বিষয়টি সমাধানে আমি সাহস সঞ্চয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে চারজন তরুণ ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের (পরবর্তী সময়ে যাদের তিনজনই ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন) কাছে দেখা করেছিলাম, যাদের আমি ভালো করে জানতাম যে তত্কালীন জেনারেল ম্যানেজার কাজেমীর অনুকম্পা প্রার্থনায় সাহায্য করতে পারবেন। তারা ছিলেন খুবই সহযোগিতামূলক এবং আমার এখনো মনে পড়ে, আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তারা কাজেমীর কক্ষে গিয়েছিলেন। দেখতে কঠোর মনে হলেও তার (কাজেমী) মধ্যে একটি বোঝাপড়ার মন ছিল এবং তখন তিনি যথেষ্ট নমনীয় হয়ে ওই দুজন কর্মকর্তাকে দোষ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। আমাকে সতর্ক করেছিলেন এমন ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন আর না হয় এবং ভবিষ্যতে যেন তাদের আরো ভালোভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়। 

আল্লাহ মালিক কাজেমীর মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হতে পারাটা খুব বিরল। অবসর-উত্তর সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে নিজের পুরো জীবন সঁপে দিয়ে তিনি কাজের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি দেশের ব্যাংকিং জগতে প্রকৃত বাতিঘর, আলোকবর্তিকা ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি সর্বোচ্চ একাগ্রতা সততার প্রতিকৃতি ছিলেন; যে গুণটি আমাদের প্রত্যেকের অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং আত্মার শান্তি কামনা করি। 

 আনিস . খান: মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন