এটি খুবই জনপ্রিয় মানবিক উপলব্দি যে, যুদ্ধে কেউ জিতে না। কিন্তু কেউই কি জিতে না? পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলক্ষেত্রসমূহের উপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় জেতার যে কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে জর্জ বুশ ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন, বলা যায়, সেসব ব্যক্তিগত লক্ষ্যের প্রায় পুরোটাই সফল হয়েছিল। সে যুদ্ধে ইরাকের ২০ হাজার সৈন্য ও ১.৮২ লাখ বেসামরিক মানুষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৪ হাজার সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারালেও উল্লসিত হয়েছিলেন বুশ ও তার কট্টর সমর্থকেরা, যারা তাকে ২০০৪-এর নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। একইভাবে স্প্যানিস ফ্লু নামে পরিচিত ১৯১৮-এর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যুজনিত সঙ্কটের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪ কোটি মানুষের প্রাণ হারানোর রাজনৈতিক দায়। উপমহাদেশের ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও ঐ দু্র্ভিক্ষকে পুঁজি করেই রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল এ দেশের কতিপয় ধূর্ত-লোভী মানুষ। অতএব দেখাই যাচ্ছে যে, যুদ্ধ, মহামারি বা দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনায় মানবতা গুমরে কাঁদলেও এসব থেকেই যুগে যুগে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা লুটেছে স্বার্থান্বেষী মহল। আর চলতি করোনা ভাইরাসেও সে ধারা থেকে পৃথিবী ও বাংলাদেশ কেউই মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না।
আগামী ৩ নভেম্বর ৫৯তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। করোনা ভাইরাসকে 'চাইনিজ ভাইরাস' নাম দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার ভোটারদেরকে অনেকখানি মাতিয়ে তুলেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিরুদ্ধে চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে ডব্লিউএইচও-কে চাঁদা না দেয়ার ঘোষণায় সে উন্মত্ততা আরো চাঙ্গা হয়েছে বলেই জানা যায়। এরই মধ্যে তিনি আরো একটি নতুন ঘোষণা দিয়েছেন যে, করোনা ভাইরাস ছড়ানোর দায়ে চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হবে এবং মার্কিন গোয়েন্দারা তাদের কার্যক্রম তদন্ত করবে। ধারণা করা যায়, নির্বাচনের আগে ট্রাম্প হয়তো এ ধরনের স্ট্যান্ট আরো ছাড়বেন, যা অবধারিতভাবেই তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে তুলবে এবং করোনার হাত ধরেই হয়তো জিতে যাবেন আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈতরণীও।
ভারতের বহুল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী অ্যাক্ট ২০১৯ যখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলেছে, তখন করোনা ভাইরাসই তার জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে রক্ষাকবচ। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সারা ভারতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ধারায় হতাহতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছিল, তাতে করোনার প্রকোপ দেখা না দিলে তিনি সেটি কিভাবে সামাল দিতেন বা আদৌ দিতে পারতেন কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে এখনতো বুঝাই যাচ্ছে যে, সামনের দিনগুলোতে করোনা-হাতিয়ার ব্যবহার করে বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব সংশোধনী অ্যাক্ট তিনি বেশ কঠোরভাবেই প্রয়োগ করতে সমর্থ হবেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য গত ১০ মার্চ ঢাকায় আসার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদির। ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মোদি তখন বাংলাদেশে আসলে তা অবধারিতভাবেই এ দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতো এবং বাংলাদেশকেও এ নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো। এরূপ পরিস্থিতিতে দুপক্ষকেই রক্ষা করেছে করোনা ভাইরাস।
গত ২৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) বার্মার (আইসিজে তার রুলিংয়ে বার্মা নামটিই ব্যবহার করেছে) প্রতি জারিকৃত এক রুলিংয়ে সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে গণহত্যা থেকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। বার্মা আইসিজে'র এ নির্দেশনা অনুসরণে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও এটি যে তাদের উপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছিল, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই; এবং বলা যায়, সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সঙ্কটে বার্মার উপর এটিই ছিল এ পর্যন্ত সময়ে সৃষ্ট সবচেয়ে বড় চাপ। কিন্তু সে চাপ ঘনীভূত হবার আগেই করোনা এসে বিশ্বকে এমন ধাক্কাই দিল যে, বর্মী জান্তা রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা কমালো নাকি আরো বাড়িয়ে দিলো, সেসব কথা মানুষ বেমালুম ভুলেই গেল। অর্থাৎ বর্মী জান্তার জন্য করোনা বস্তুত এক আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছে। (এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো, করোনার এ দুঃসময়েও রোহিঙ্গা সঙ্কটের কূটনৈতিক তৎপরতায় যেন বড় ধরনের ঘাটতি দেখা না দেয়)।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতের জন্য সরকার ইতোমধ্যে বিরাট অঙ্কের প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, সরকারের শত সতর্কতা সত্ত্বেও এ তহবিলের একটি বড় অংশ এরূপ অনেকের হাতে চলে যাচ্ছে, পরিস্থিতির সার্বিক ও ন্যায়সঙ্গত বিবেচনায় যাদের তা না হলেও চলতো। এমনকি এখানেই এরা থেমে নেই। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার নতুন কোনো ফাঁক-ফোকর খুঁজে আরো বেশি পরিমাণ সম্পদ কিভাবে কুক্ষিগত করা যায়, সে চেষ্টাও অব্যাহত আছে। গত ১৮ মে'র সমকালের খবর, বেশকিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে যৌক্তিক পরিমাণের চেয়ে ৩ থেকে ৫ গুণেরও বেশি অর্থ দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেছেন, "এই দুর্যোগের সময় এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়"। আর করোনা প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেছেন, "এই দুর্যোগে সেবার পরিবর্তে তারা ব্যবসায়িক হিসাব কষে এগোচ্ছেন"। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীও এ ব্যাপারে তাঁর অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। করোনাকে ঘিরে আর্থিক ফায়দা লোটার চেষ্টার এটি একটি ঘটনা মাত্র। এর বাইরে এরূপ আরো নানা ঘটনার খবর প্রতিদিনই মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, দিন যত পার হবে, এ ধরনের ফায়দা লোটার ঘটনার খবর ততোই আরো বেশি করে জানা যাবে।
সরকার শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ইতোমধ্যে বিপুল অঙ্কের খাতভিত্তিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু তারপরও কতিপয় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী (সবাই নন। পত্রিকায় দেখলাম, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা সত্ত্বেও 'স্টার কাবাব' তার কর্মীদের করোনাকালীন পুরো সময়ের পুরো বেতন পরিশোধ করে দিয়েছে)। বিপরীতে আবার এমন অনেকে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী আছেন যারা এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি হারে মুনাফা লোটার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক দুরবস্থার নাম করে তারা যদি আরো বেশি করে শ্রমিক ঠকান, তাহলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। বরং সেটি ঘটবার সম্ভাবনাই অধিক। উদাহরণস্বরূপ বলি, করোনার কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে কোনো পোশাককারখানা বন্ধ ছিল না। কিন্তু তা সত্বেও বহু কারখানা করোনার অজুহাত দিয়ে সে সময়ের শ্রমিক-বেতন দীর্ঘদিন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি। অতএব বুঝাই যাচ্ছে, করোনা তাদের জন্য আবির্ভূত হয়েছে এক আশীর্বাদ হয়ে, যা কাজে লাগিয়ে এ সময়ে তাদের শ্রমশোষণ আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
করোনা সঙ্কট কেটে যাবার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসার পরও হয়তো এ থেকে সুবিধাবাদীদের ফায়দা লুটার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তারা তখন অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কথা বলে বাড়তি প্রণোদনা চাইবেন, পূর্বের নগদ প্রণোদনার হার আরো বাড়াতে বলবেন, বিনা সুদে ঋণ চাইবেন, খেলাপি ঋণের পুরোটাই মাফ চাইবেন, যানবাহন থেকে বাড়তি চাঁদা দাবি করবেন। এমনকি প্রয়োজনে করোনা ফিরে আসার জন্য মনে মনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করবেন, যাতে বাকি জীবনটাও প্রণোদনা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার উপর ভরসা করে কাটিয়ে দেয়া যায়। আর ট্রাম্পও হয়তো এ কথাই বলবেন যে, একমাত্র তার পক্ষেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ 'চীনা ভাইরাস' মুখের এক ধমকেই বিদায় করে দেয়া সম্ভব।
সব মিলিয়ে তাই বলতেই হয়, যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবনে চরম অভিশাপ হয়ে দেখা দিলেও এক শ্রেণির লোভী ও নষ্ট মানুষের কাছে যুগে যুগে দেশে দেশে এগুলোই হচ্ছে ক্ষমতা ও বিত্ত দখলের হীন কৌশল। করোনার আকস্মিক ছোবলে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন যখন আজ দিশেহারা, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ যখন ক্রমেই এক মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও শুনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির জন্য গোপনে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্র। আর দেশে হাড্ডিসার শ্রমিকের বুকের উপর দাঁড়িয়ে মুনাফার পরিমাণ কিভাবে আরো বাড়ানো যায়, তা নিয়ে ফন্দি আঁটে এক শ্রেণির লোভী উদ্যোক্তা। এরা কি আসলেই মানুষ? এরা নিজেরা না হোক, এদের পরিবারের কোনো সদস্যই কি টলস্টয়ের 'How Much Land Does a Man Need?' গল্পটি থেকে তাদেরকে পড়ে শোনায়নি যে, শেষ পর্যন্ত সমাধিস্থ হবার জন্য দরকারি জায়গাটুকু ছাড়া তার আর তেমন কিছুর প্রয়োজন নেই?
আবু তাহের খান
পরিচালক
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ