বিশেষ সংখ্যা

আজ থেকে ১৪১ বছর আগে ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৪-৯৮) সম্পাদিত ‘এডুকেশন গেজেট’ (১১ ডিসেম্বর ১৮৭৪) পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয় ‘এ দেশের মুসলমানেরাও বাঙ্গালী’ শিরোনামে। অনামা লেখকের এ নিবন্ধে বলা হয়: ‘কি আশ্চর্য্য, এ দেশের মুসলমানেরা প্রায়ই আপনাদিগকে বাঙ্গালী বলিয়া স্বীকার করিতে চাহে না। তাহারা এখানকার হিন্দুদিগকেই বাঙ্গালী বলিয়া জানে এবং বাঙ্গালী বলিয়া থাকে।... মুসলমানেরা আপনাদিগকে বিদেশী বলিয়া মনে মনে জানায়, এবং বাঙ্গালা প্রভৃতিকে আপনাদের দেশ-ভাষা নহে বলিয়া পরিচয় দেওয়ায়, ও তত্প্রতি অশ্রদ্ধা করায় এ দেশের পক্ষে অমঙ্গলের সমূহ সাধিত হইতেছে। মুসলমানেরা এক্ষণে এ দেশের জন-সমাজ-শরীরের একটী প্রধান অঙ্গ; তাঁহারা সংখ্যায় বহুল, এবং ক্ষমতাতেও বহুল। ঈদৃশ একটী অঙ্গ বিকল থাকায় এ শরীরের ভদ্রস্থতা নাই। ঐরূপ বিপরীত জ্ঞানে এ দেশীয় মুসলমানদের নিজেরও উন্নতি হইতেছে না, বরং অবনতি হইতেছে; এবং সমস্ত ভারতীয় সমাজেরও বহুল হানি করিতেছে। যত দিন এইরূপ বিরুদ্ধ ভাব থাকিবে, তত দিন হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সম্ভাবনা নাই, এবং তত দিন দেশের এইরূপ দুরবস্থা থাকিবে। মুসলমানেরা পাশ্চাত্ত্য আসীয় ভূমি হইতে এদেশে আসিয়াছেন সত্য, কিন্তু তাঁহারা এখানে অনেক পুরুষ বাস করিলেন, এক্ষণে এ দেশ তাঁহাদের স্বদেশ হইয়া গিয়াছে। তাঁহাদের সাধারণ চলিত ভাষাও আর পারস্য আরব্যাদি নাই। এ দেশের চলিত ভাষাই প্রায় তাঁহাদের চলিত ভাষা হইয়াছে; তবে আর আপনাদিগকে এখন বিদেশী ভাবা বা বিদেশীয় বলিয়া পরিচয় দিবার প্রয়োজন?...’— পত্রিকায় এসব কথা বলার উপলক্ষ ছিল মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) সম্পাদিত ‘আজীজন নেহার’ (১৮৭৪) পত্রিকায় প্রকাশিত ও তাঁরই রচিত অস্বাক্ষরিত একটি রচনা।
হুগলি থেকে ১৮৭৪-এ মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় ‘আজীজন নেহার’ নামে একটি পত্রিকা বের হয়। মশাররফ ছিলেন উদার মন ও মতের মানুষ, সম্প্রদায় সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী ও বিশুদ্ধ বাঙালিত্বের চেতনায় লালিত সমাজমনস্ক এক লেখক। বাঙালি মুসলমান যখন স্বদেশ, মাতৃভাষা ও জাতীয়তার প্রশ্নে বিভ্রান্ত ও সংশয়ী, এক অদ্ভুত টানাপড়েনে আক্রান্ত; সেই পিছুটানের মানসতার বিপক্ষে প্রথম দাঁড়িয়েছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর সম্পাদিত ‘আজীজন নেহার’ পত্রিকায় মশাররফ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায়, দৃঢ়ভঙ্গিতে ও গভীর প্রত্যয়ে জানিয়েছিলেন: ‘আমরা মুক্তকণ্ঠে সংবাদপত্রে স্বীকার করিয়াছি, আমরা বাঙ্গালী, বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা, আমরা কি আমাদের অবমাননা করিয়াছি? কোন দেশে পুরুষানুক্রমে বাস করিয়া তদ্দেশীয় বলিয়া পরিচয় দেওয়া দেশীয় ভাষা ব্যবহার করা অবমাননার বিষয় নহে; পরন্তু বীর্য্যবান দেশাদি মাতৃভূমি ভাণ করিয়া তাহাদের বিকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা ব্যবহার করা উপহাস-সঞ্চারক। ইহাও অল্প রহস্যের বিষয় নহে, প্রকৃত মাতৃভূমির প্রতি ঘৃণা করিয়া পশ্চিমদিক্বাসী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিলে গৌরব বিবেচনা করি।... যাহা হউক, আমরা বাঙ্গালী বলাতে আমাদের অবমাননা হয় নাই...।’ এ বক্তব্য বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার প্রশ্নে প্রচলিত ধারণা ও সংস্কারের বিপরীতে এক সাহসী ও নির্ভুল সিদ্ধান্তের স্মারক। বাঙালি মধ্যশ্রেণীর উন্মেষকালে উনিশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বে স্বদেশ-মাতৃভাষা-জাতীয়তার প্রশ্নে, স্বরূপ-অন্বেষার আকাঙ্ক্ষায়, শিকড়ের সন্ধানে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজে কারো কণ্ঠে এমন প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ কখনো শোনা যায়নি। এদিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মশাররফকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা বলে মান্য ও স্মরণ করতে হয়। উত্তরকালে মশাররফ তাঁর পরিচালিত পত্রিকা ‘হিতকরী’ (১৮৯০) এবং সাহিত্যচর্চায় দেশ, ভাষাপ্রীতি ও বাঙালিত্বের উপলব্ধির ক্ষেত্রে আরো প্রাজ্ঞ ও পরিণত হয়েছেন, বোধ-বিশ্বাস-চেতনায় আরো দৃঢ় হয়েছেন, তার কিছু নমুনা পেশ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে।
বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত উচ্চবর্গের বাঙালি মুসলমান চিরকালই নিজেদের বিদেশাগত অভিজাতশ্রেণী হিসেবে ভাবতে ভালোবাসতেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ এসেছিলেন সুদূর আরব-ইরাক-ইরান-তুরস্ক-মধ্য এশিয়া থেকে এবং সেখানেই তাঁদের মূল শিকড়— এ কথা গভীরভাবে তাঁদের অন্তরে গাঁথা ছিল এবং এভাবে বাঙালি সমাজের মূলধারার সঙ্গে ব্যবধান রচিত হয়। মীর মশাররফ হোসেনের বংশপুরাণ থেকে জানা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষও এসেছিলেন পুণ্যভূমি ইরাকের বাগদাদ থেকে। কিন্তু মশাররফ তাঁর সমগোত্রীয়দের মতো এ সংস্কারের দাসত্ব করেননি— তিনি স্পষ্টই বিশ্বাস করতেন, বংশপরম্পরায় এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের কারণে তিনি বাঙালি, বঙ্গদেশ তাঁর জন্মভূমি আর বাংলা তাঁর মাতৃভাষা। এ চেতনা থেকেই তিনি পরস্পর নিকট-পড়শি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চিন্তা করেছেন। মশাররফের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কামনার মূল্যবান দলিল তাঁর ‘গো-জীবন’ (১২৯৫) বই এবং সেই সঙ্গে আরো বেশকিছু রচনা। তিনি এ দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্য ও মানসিক একাত্মতা সম্পর্কে স্পষ্টই বলেছেন: ‘[হিন্দু-মুসলমান] পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্ম্মে এবং কর্ম্মে এক’ এবং তাই ‘কালে আমরা রাজাকে পরিত্যাগ করিতে পারি। রাজাও আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারেন। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারে না।— জগত যত দিন— সম্বন্ধও তত দিন’ (‘গো-জীবন’, প্রথম প্রস্তাব)। অবশ্য এ মনোভাবের জন্যে তাঁকে চরম মূল্যও দিতে হয়— তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই অর্জন করতে হয় নিন্দা-সমালোচনা-লাঞ্ছনা। তবু শুভবুদ্ধির মানুষ ও সচেতন বিবেকি লেখক মশাররফ আত্মসমর্পণ করেননি, মুক্তবুদ্ধির চেতনা থেকে বিচ্যুত হননি। বাঙালির সামাজিক ঐক্য একমাত্র হিন্দু-মুসলমানের মিলনের মধ্য দিয়েই রচিত হওয়া সম্ভব এবং জাতীয় উন্নতির কোনো বিকল্প এ মিলন প্রয়াস ভিন্ন সফল হতে পারে না— মশাররফ এ চিন্তায় দৃঢ় ও অবিচল ছিলেন।
মশাররফের রচনায় স্বদেশ, স্বাধীনতা, স্বরাজ— এ বিষয়গুলো নানা অনুষঙ্গে কখনো কখনো উঠে এসেছে। ভিন্ন আবহ ও প্রসঙ্গে এসব কথা উচ্চারণ হলেও অবচেতনে কিংবা পরোক্ষভাবে হলেও এতে যে মশাররফের মনের যোগ ও সায় ছিল, সে অনুমান তো করাই যেতে পারে।
মাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ সম্পর্কে মশাররফের উক্তি স্মরণ করতে হয়: ‘জন্মভূমি কাহার না আদরের?... জন্মভূমির জন্য কে না লালায়িত? বহুদিন পরে প্রবাসী দেশে আসিলে তার মনে কতই না সুখ! আনন্দ’ (‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, অষ্টাদশ তরঙ্গ)। মশাররফ বলেছেন, মানুষ তো বটেই ‘পশুপক্ষী কীটপতঙ্গগণও জন্মস্থানের মায়ামমতা বোঝে’, আবার স্বদেশের মূল্য ও গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে উদ্ধৃত করেছেন এই শাস্ত্রবাণী— ‘জন্মভূমি স্বর্গ হইতে গরীয়সী’। তাঁর উপলব্ধি থেকে বলেছেন, জন্মভূমি ‘প্রকৃত সুসন্তান পক্ষে স্বর্ণরজত অপেক্ষাও মূল্যবান’। কিন্তু পাশাপাশি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ উপলব্ধি ‘মাতৃদ্রোহী সন্তানের পক্ষে নহে, স্বদেশদ্রোহী কুলাঙ্গারের পক্ষে নহে, জন্মভূমিবৈরী নিষ্ঠুর পামরের পক্ষে নহে’ (‘এসলামের জয়’, তৃতীয় মুকুল)। জন্মভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ, প্রীতি ও আকর্ষণের পরিচয় মিলবে এ রচনায়: ‘আমরা বাঙ্গালী, আমাদের হোমকে আমরা কেবল পদতলেই দলিত করিতে শিখিয়াছি। কি প্রকারে পূজিতে হয় তাহা জানি না। এই হোমেই যে স্বর্গসুখ ভোগ করা যায়, তাহাও স্বীকার করি না। এই ঝাড়, জঙ্গল, জলে ডোবা, সেঁতসেঁতে, কুঁড়েঘর শোভিত হোমই যে পবিত্র স্বর্গ হইতে গরীয়সী, তাহাই বা কয়জনে মনে করি।... আমরা নিমকহারাম, আমরা কৃতঘ্ন, তাহাতেই এই দশা।’ এর পর আফসোসের সুরে আবেগি অনুভূতিতে মশাররফ স্বগতোক্তির মতো বলেছেন: ‘... আমি উদাসীন পথিক। মনের কথা বলিতেছি।— এ জগতে আমার কেহই নাই...। ...এ অবস্থাতেও পাঠক! হোমের জন্য পথিকের প্রাণ কাঁদে’ (‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, চতুর্দশ তরঙ্গ)। উেকন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানের ‘স্বদেশ’ সম্পর্কে ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি সংকট-সংশয়ের মানসতার বিপরীতে এ এক অভিনব স্বদেশ অন্বেষার আকুতি।
মশাররফ বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে সমকালে অতুলনীয় স্বীকৃতি ও সমাদর লাভ করেছিলেন। তাঁর মতো প্রাঞ্জল, সুললিত ও বিশুদ্ধ বাংলা অনেক বাঙালি হিন্দুও লিখতে পারেন না কিংবা তাঁর মতো বাংলা কোনো হিন্দু লিখতে পারলে তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করবেন— সমালোচকদের ঘন ঘন এ ধরনের উক্তি-মন্তব্য নিঃসন্দেহে মশাররফের স্বভাষার প্রতি অনুরাগ ও ভাষা সাফল্যের পরিচায়ক। অবশ্য এ মাতৃভাষাপ্রীতির জন্য মশাররফকে স্বসমাজের কাছ থেকে যথেষ্ট ধিক্কার ও বিরূপ-সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।
মাতৃভাষা সম্পর্কে মশাররফের চিন্তাচেতনার খানিক পরিচয় মেলে ‘আমাদের শিক্ষা’ নামীয় এক প্রবন্ধে। সেখানে তিনি বলেছেন: ‘বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা “বাঙ্গালা”। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে। বিশেষ সাংসারিক কাজকর্ম্মে মাতৃভাষারই সম্পূর্ণ অধিকার। মাতৃভাষায় অবহেলা করিয়া অন্য দুই ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হইলেও তাহার প্রতিপত্তি নাই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণের প্রাণ যে স্ত্রী, তাহার নিকটেও আদর নাই। অসুবিধাও বিস্তর। ইস্তক ঘরকন্নার কার্য্য নাগাদে রাজসংশ্রবী যাবতীয় কার্য্যে বঙ্গবাসী মুসলমানদের বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োজন’ (পাক্ষিক ‘হিতকরী’, ১৫ পৌষ ১২৯৭)।
মশাররফ প্রথম জীবন থেকেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। ভাষা ব্যবহারে তিনি যে উদার ও মুক্তমনের পরিচয় দিয়েছেন, তা যথার্থই যুগদুর্লভ। ‘বিষাদ-সিন্ধু’তে আরবি-ফারসি শব্দ যথাসম্ভব বর্জন করে সংস্কৃতজ বাংলা শব্দ ব্যবহার করার ফলে তিনি কম আক্রান্ত ও বিব্রত হননি। তিনি জানিয়েছেন, ‘পয়গম্বর এবং এমামদিগের নামের পূর্ব্বে বাঙ্গালা ভাষায় ব্যবহার্য্য শব্দে সম্বোধন’ করার কারণে ‘স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন’। মশাররফ ব্যথিত চিত্তে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘শাস্ত্রের খাতিরে’, ‘সমাজের কঠিন বন্ধন’ ও ‘দৃঢ় শাসনে’ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে ‘কল্পনা কুসুমে আজ মনোমত হার গাঁথিয়া পাঠক-পাঠিকাগণের পবিত্র গলায় দোলাইতে পারিলাম না’ (‘বিষাদ-সিন্ধু’)।
মশাররফের মাতৃভাষাপ্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের পরিচয় মেলে পুত্র-কন্যাদের ‘বাংলা’য় নামকরণে। মশাররফ প্রথম পত্নীর গর্ভের দুই পুত্রের ডাকনাম রেখেছিলেন শরত্ ও শিশির। দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভের পুত্র-কন্যাদের নাম রাখেন যথাক্রমে সতী, সাবিত্রী, সত্যবান, কুকী, সুনীতি, সুমতি, রণজিত্, সুধন্বা, ধর্মরাজ ও যুবরাজ। এ নামকরণ সম্পর্কে সেকালে তাঁর নিজ গ্রাম লাহিনীপাড়ায় তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। তাঁর সম্পর্কে কটূক্তি বা নিন্দা প্রচারে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা কোনো কার্পণ্য করেনি। কিন্তু দৃঢ়চিত্ত মশাররফ এসব অযৌক্তিক অনুদার মনোভাবকে তীব্রভাবে অগ্রাহ্য করেছেন। প্রথম পুত্রের নামকরণ-সম্পর্কিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিবরণ মেলে মশাররফ অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে : ‘...আকিকা হইল— নাম রাখিবার সময় উপস্থিত্। নাম রাখা হইল মফাজ্জ্বল হোসেন। ...পারস্যভাষায় নাম রাখা হইল। আমি সদা সর্ব্বদা ডাকার জন্য বাঙ্গালা ভাষায় নাম রাখিব। ...দুই একজন বলিলেন বাঙ্গালা নাম রাখিবেন রাখুন, তাই বলিয়া রাম, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, কালী নাম রাখা ভাল নয়। আমি বলিলাম— তাহাতে দোষ কি?... আপনারা এক চক্ষে দেখিবেন। কাযেই বাঙ্গালা ভাষাটা আপনাদের চক্ষেই ধরে না। অথচ বাঙ্গালার জল, বাঙ্গালার বাতাস, বাঙ্গালার আকাশ, বাঙ্গালার শস্য, বাঙ্গালার মাটী, বাঙ্গালার সকলই আপনার বলিতেছেন, ভাষাটার প্রতি এত ঘৃণার কারণ কি?... বাঙ্গালার মাটীতে জন্মগ্রহণ করিয়া প্রথম ডাক “মা” ডাকিতেছেন। কথা ফুটীয়ে বাঙ্গালা ভাষায় কথা কহিতেছেন, অথচ বাঙ্গালা হিন্দুর ভাষা কাফেরের ভাষা শিখিলে পড়িলেই মহাপাপ। তাহা যাহাই হউক আমার পুত্রের নাম আমি “শরত্” রাখিলাম।’ কোনো বিরোধিতা বা প্রতিক্রিয়াকেই মশাররফ আমল দেননি। বরং রক্ষণশীল ও অনুদার মনোভাবকে তুচ্ছ করে সাহসের সঙ্গে বলেছেন: ‘শরত্ নামেই আন্দোলন— মহা আন্দোলন, আমি তাহাতে কিছুমাত্র ভীত হইলাম না। দমিলাম না” (অপ্রকাশিত আত্মজীবনী)।
অন্যত্রও তিনি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন: ‘...সাবেক এস্লামি ভাষা পরিত্যাগ করিয়া বিসুদ্ধ [বিশুদ্ধ] বাঙ্গালা ভাষার সেবা মুসলমান সমাজে আমিই প্রথম করিলাম।... আমার মুখেই প্রথম “ঈশ্বর” শব্দ বাহির হইয়াছে।— এই প্রকার অনেক কথা— আমারই মুখে অগ্রে বাহির হইয়াছে, লিখা হইয়াছে— ছাপার অক্ষরে কেতাবে উঠিয়াছে। খোদা, এলাহি স্থানে জগদীশ-পরমেশ্বর, পানি স্থানে জল, নমাজ স্থানে উপাসনা,— এইরূপ শব্দ বাহির হওয়ায় মুসলমান [সমাজে] আমার নিন্দার চর্চ্চ্যা [চর্চা] হইতে লাগিল’ (অপ্রকাশিত আত্মজীবনী)।
বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত ভাষা-সম্পর্কিত মনোভাবের প্রেক্ষাপটে মশাররফের এ মাতৃভাষা চেতনা ব্যতিক্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার প্রশ্নে মশাররফ এখানে উদারপন্থী, মুক্তমন ও নির্দ্বন্দ্ব।
নিজের আন্তরিক বোধ ও বিশ্বাস এবং উদারনৈতিক চিন্তাধারার কাছে মশাররফ সবসময়ই বিশ্বস্ত ছিলেন। বাঙালি জাতিসত্তার আলোকেই তাঁর আত্মপরিচয় স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন। জন্মভূমির বিষয়ে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা বা ভ্রান্তি ছিল না। আর ভাষার প্রশ্নে মশাররফ যে উদার ও বাস্তববাদী ছিলেন, তার সাক্ষ্য সহজেই মেলে। উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের জাতি-স্বদেশ-মাতৃভাষা-সম্পর্কিত মানসিক দ্বিধা ও সংকট উপেক্ষা করে মীর মশাররফ হোসেন নিজেকে বিশুদ্ধ বাঙালি হিসেবে নির্ভুলভাবে উপস্থাপনে সক্ষম ও সফল হয়েছিলেন। ‘জগত্ পরাধীন, মন স্বাধীন’— মশাররফের এই ছিল জীবনোপলব্ধি। তাই পরাধীন জগতে স্বাধীন মন নিয়ে তিনি বাঙালিত্বের চেতনায় সগর্বে বলতে পেরেছেন: ‘আমরা বাঙ্গালী, বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা।’
পাঠকের মতামত