স্বাস্থ্যবিধি ও সুস্বাস্থ্য

রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি

হাইজিন শব্দটির বাংলা অর্থ স্বাস্থ্যবিধি। এ শব্দ দিয়ে মূলত ‌নিজেকে এবং আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা বোঝানো হয়।

হাইজিন শব্দটির বাংলা অর্থ স্বাস্থ্যবিধি। এ শব্দ দিয়ে মূলত ‌নিজেকে এবং আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা বোঝানো হয়। পরিচ্ছন্নতা এবং সুস্বাস্থ্য একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুস্থ থাকলেও যেমন কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, তেমনই স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন মেনে না চললে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে অনেক বেশি। তাই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।

ভালোমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা না হলে বেশকিছু সংক্রামক রোগের প্রবণতা বাড়ে। সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্বাস্থ্যবিধি। যদিও পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ওপেন লার্ন ক্রিয়েটের দেয়া তথ্যমতে, পরিচ্ছন্নতা শব্দটি দিয়ে সাধারণত শরীরের ওপরের অংশের ধুলা, ময়লা ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হয়, সেখানে ডিটারজেন্ট বা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে হাইজিন মেনে চলা হয় বেশকিছু রোগের সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে। যেমন ঘর পরিষ্কারের কথাই বলা যাক। ঝাড়ু, মপ ও ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘরে দৃশ্যমান ময়লা দূর করা হয়। এটি পরিচ্ছন্নতা। আর অন্যদিকে ক্লোরিন সলিউশন দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব ধ্বংস করা হয় যেন কোনো রোগ না ছড়ায়। এটাকে বলা হয় হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি।

হিউম্যানিটারিয়ান গ্লোবালের মতে, হাইজিন বলতে শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধিকেই বোঝায় না, এর বেশ কয়েকটি ধরন আছে। সেগুলো হলো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধি, ঘরোয়া স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বলতে শরীর ও পোশাকের পরিচ্ছন্নতাকে বোঝানো হয়। সঠিক জীবনযাত্রার অভ্যাস, স্বাস্থ্যকর খাবার, বিশ্রাম, ব্যায়াম দিয়ে শরীর ঠিক রাখা যায়। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে এগুলো। গোসল করা, কাপড় পরিষ্কার, সঠিকভাবে শৌচাগার ব্যবহার, দাঁত, নখ ও পায়ের যত্ন নেয়া, হাঁচি- কাশি দেয়ার সময়ে কিছু সতর্কতা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির অংশ। 

অন্যদিকে পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ডিসইনফেকশন কার্যক্রম, ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ, জীবাণুমুক্তকরণ এবং বিভিন্ন পেস্ট কন্ট্রোলের জন্য ধোঁয়া কার্যক্রম ইত্যাদি। পরিবেশে যদি ক্ষতিকর নানান বর্জ্য থাকে তাহলে সেগুলো সরিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করাও পরিবেশগত স্বাস্থ্যবিধির অংশ।

ঘরোয়া স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে রয়েছে সেসব কাজ যা দিয়ে ব্যক্তির কাপড়, বিছানাপত্র ও বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখা যায়। কাপড় ধোয়া, মেঝে পরিষ্কার করা, শৌচাগার পরিষ্কার করা এবং খাওয়ার পর বাসন-কোসন ধোয়ার বিষয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত। এসব ঠিকভাবে পালন না করা হলে পরজীবী, জীবাণু ও রোগ ছড়ানোর মতো প্রাণী জন্ম নিতে পারে। তাতে করে বাড়ির ভেতরে বসবাসকারীদের শরীরে ছড়াতে পারে অসুস্থতা।

দূষিত খাবারে রোগজীবাণু ছড়ায় সবচেয়ে বেশি। তাই এখানে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে সবচেয়ে বেশি। এতে যেমন কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে তেমন তা ছড়িয়ে পড়তেও পারে। মাছি, নোংরা হাত বা অপরিষ্কার পানির মাধ্যমে খাবার দূষিত হতে পারে। সেজন্য খাবার রান্না ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মানতে হবে খাবার স্বাস্থ্যবিধি। 

তবে স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে দুটো বিষয় থাকে উল্লেখ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, একটি থাকে এজেন্ট, আরেকটি থাকে হোস্ট। এজেন্টগুলো সাধারণত পরিবেশ থেকেই আসে। আর সেই এজেন্টের মাধ্যমে নানা ধরনের রোগজীবাণু বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল পদার্থগুলো পরিবেশ থেকে হোস্টের কাছে আসে। 

সাধারণত আমাদের সবখানে এমনকি শিশুদের বইতেও শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সংক্রামক ব্যাধিগুলো রোধ করার জন্যই এগুলোতে জোর দেয়া হয়েছে। ফুটিয়ে পানি খাও, হাত ধোও, অন্যান্য অভ্যাস স্বাস্থ্যসম্মত করো এমনটা বলা হয় বারবার। ডা. লিয়াকত আলীর মতে, হাইজিনের অংশ হিসেবে এর সঙ্গে এখন যুক্ত করা দরকার হাঁটাচলা বা কায়িক শ্রম। খাদ্যাভ্যাস যেমন কোমল পানীয়, ফাস্টফুড ওবেসিটির বড় কারণ। স্ক্রিন অ্যাডিকশন, স্মার্টফোন অ্যাডিকশনও ক্ষতি করে অনেক বেশি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এসব রোগের বীজ বপন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্যবিধির ধারণাটা রোগজীবাণু, ক্ষতিকর পদার্থ থেকে বেরিয়ে এসে এমন ব্যাপক ধারণার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। হাইজিন বলতে শুধু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নয় তার সঙ্গে বিশেষ করে কায়িক শ্রমের অভ্যাসটা রাখতে হবে। তা না হলে আমাদের ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে শরীরের ভেতরে ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হতে শুরু করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে আমাদের অভ্যাস, হাঁটাচলার অভ্যাস, স্ক্রিন অ্যাডিকশন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস নিতে হবে, খাদ্যাভ্যাসে পশ্চিমা অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কভিড দেখিয়েছে সংক্রামক ব্যাধি তাদেরই আঘাত করেছে বেশি যাদের অসংক্রামক রোগ আছে। অসংক্রামক রোগগুলোর কিন্তু অর্থনৈতিক প্রভাবও আছে। এসব রোগে একবার আক্রান্ত হলে সারা জীবন ভুগতে হয়। তাই এসব থেকে রক্ষা পেতে হাইজিনের ধারণাটা আরো ব্যাপক হারে চিন্তা করতে হবে। 

স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করাটা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। এমনকি এটি কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না উল্লেখ করে এ চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয় তা এখন ভাবতেই হবে। সব সেক্টরের নীতিতেই স্বাস্থ্য থাকতে হবে। যখন রাস্তা করছি সেখানে ফুটপাত না থাকলে হাঁটবে কোথায়? স্বাস্থ্যের বিষয়টা মাল্টিসেক্টরাল, সেটা নারী শিক্ষার সঙ্গে, কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সেজন্য মাল্টিসেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন আনতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার এখনই সময়, তা না হলে ভবিষ্যতে হাইজিন থেকে স্বাস্থ্যর যেসব জটিলতা দেখা দেয় তা বেড়ে যাবে। এটাকে এখন প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের মধ্যে আনা হচ্ছে, সেটা ঢেলে সাজানোর জন্য জেনেভায় ফ্রেমওয়ার্ক হয়েছে। দিল্লি থেকে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার কৌশলপত্র হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। স্বাস্থ্যবিধিতে আমরা মূল ফোকাস দিতে পারলে আমাদের প্রাপ্তিও বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নানা রোগ কম হবে। ফলে তারা খরচের মধ্যেও কম পড়বে, রাষ্ট্রেরও ব্যয় কমে যাবে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারলেই সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মন্তব্য করেন এ চিকিৎসক। তার মতে, আন্তর্জাতিকভাবে ও সরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়ার কারণেই মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। সেক্টর প্রোগ্রামগুলোতে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্পর্কযুক্ত রয়েছে। তবে আগে দেশে যে সুনাম অর্জন হয়েছে এখন প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের সে জায়গাটা কমে যাচ্ছে। হাইজিন মেইনটেইন করতে পারলেই সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্বের এখন স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। আর সেটা করতে হবে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ওরিয়েন্টেড।

আরও