সুস্থ-সবল সন্তান জন্মদানের প্রত্যাশা করেন হবু মা। অনেকেরই সেই স্বপ্ন সফলতা পায় না। গর্ভবতী মা ও তার পরিবারের সময় কাটে প্রবল দুশ্চিন্তা আর উত্কণ্ঠায়। সবার গর্ভকালীন সফরের পুরোটা হয়তো মসৃণ হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা দেয় জটিলতা। গর্ভকালীন বা প্রসবকালে মায়ের জটিলতা মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। দেখে নেয়া যাক গর্ভকালে মায়ের কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বারবার গর্ভপাত: সাধারণত গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। বারবার গর্ভপাতের ঘটনা নারীজীবনকে বিষময় ও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। এর ফলে একজন নারী দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগে ভুগতে পারে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: কোনো নারীর আগে ডায়াবেটিস না থাকলেও গর্ভকালে ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। সাধারণত গর্ভকালের মাঝামাঝি অর্থাৎ ২০ সপ্তাহ পর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। অধিক বয়সে গর্ভধারণ, অধিক ওজন, বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস, গর্ভে একের অধিক সন্তান ধারণের জন্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সঠিক সময়ে নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে গর্ভে সন্তানের মৃত্যু, বিকলাঙ্গ সন্তান, অসময়ে অপরিণত সন্তান প্রসব হতে পারে। অন্যদিকে অসময়ে গর্ভথলি থেকে পানি ভেঙে যাওয়া, প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, প্রসব-পরবর্তী প্রজননতন্ত্রে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে পরবর্তী সন্তান ধারণে অক্ষমতাসহ মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ: শতকরা ১ ভাগ ক্ষেত্রে জরায়ুর ভেতরে সঠিক জায়গায় গর্ভসঞ্চার না হয়ে জরায়ুর বাইরে সাধারণত এক ডিম্বনালিতে গর্ভসঞ্চার হয়ে থাকতে পারে। এটি গভবর্তী মায়ের জন্য মারাত্মক জীবন নাশের ঝুঁকি তৈরি করে।
ডিম্বনালির ভেতরে যেহেতু ভ্রুণ বেড়ে ওঠার জায়গা নেই তাই হঠাৎ করেই ডিম্বনালি ফেটে গিয়ে পেটের ভেতর ভীষণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। গর্ভাবস্থার পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের ভেতরেই সাধারণত এ ঘটনা ঘটে। প্রস্রাবে বা রক্তে গর্ভসঞ্চার দেখালেও আল্ট্রাসাউন্ডে জরায়ুর ভেতর ভ্রুণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তখনই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি সন্দেহ করা হয়। সাধারণত মায়েদের তীব্র পেট ব্যথা ও রক্তস্রাব এমনকি অজ্ঞান হয়েও হাসপাতালে আসতে হয়। দ্রুত অপারেশন বা ওষুধের মাধ্যমে অস্বাভাবিক স্থানে বেড়ে উঠতে থাকা ভ্রুণ অপসারণ না করলে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। প্রতিদিনই এ ধরনের গর্ভসঞ্চারণের কারণে কোনো না কোনো মায়ের মৃত্যু হয়।
উচ্চরক্তচাপ ও খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া: গর্ভকালে যেকোনো মায়ের উচ্চরক্তচাপ দেখা দিতে পারে। সাধারণত গর্ভকালের শেষ তিন মাসের দিকে এ সমস্যা দেখা দেয়। সঠিক সময়ে উচ্চরক্তচাপ নির্ণয় এবং চিকিৎসা না করা হলে রক্তচাপ মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। মায়ের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় আমিষ বা প্রোটিন প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। সারা শরীরে পানি জমে শরীর ফুলে যায়। একসময় হঠাৎ করেই খিঁচুনি শুরু হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। দেহের দরকারি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, হার্ট তাদের কার্যক্ষমতা হারায় এবং শেষ পর্যন্ত মা মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হলো একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি। মাতৃমৃত্যুর শতকরা ২৪ ভাগই হয়ে থাকে একলাম্পশিয়ার জন্য।
প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ: প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর প্রথম কারণ। শতকরা ৩১ ভাগ ক্ষেত্রেই মাতৃমৃত্যুর জন্য দায়ী এ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। প্রসবকালে ৫০০ মিলির বেশি রক্তক্ষরণ হলে তাকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। জরায়ুমুখের কাছে গর্ভফুলের অবস্থান, প্রসব-পরবর্তী সময়ে জরায়ুর সংকোচনে শিথিলতা, গর্ভে শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থান, একের অধিক সন্তান প্রসব, প্রসবের পর গর্ভফুল জরায়ুতে আটকে থাকা ইত্যাদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের প্রধান কারণ। অন্যদিকে অল্প বয়সে সন্তান ধারণ, ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপ আছে এমন মায়েদের প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকি আছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের দ্রুত চিকিৎসা না করলে মায়ের শরীরের দরকারি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মায়ের মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশের মাত্র ৩৬ শতাংশ মা গর্ভকালে চারবার চিকিৎসা কর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকেন। তাছাড়া চেকআপের গুণগত মানও উন্নত নয়। অন্যদিকে বেশির ভাগ মা গর্ভকালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন না। ফলে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের আলাদা করা যায় না। তাই তাদের প্রসবকালীন জটিলতা নিরসনে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া অর্ধেকেরও বেশি মায়ের সন্তান প্রসব করানো হয় বাড়িতে, কোনো রকম দক্ষ চিকিৎসা কর্মীর সহায়তা ছাড়াই। এতে করে প্রসবকালে যেকোনো জটিলতা তৈরি হলে তার চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। প্রসবকালীন বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়ের কোনো জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা, হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি করা এবং হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে দেরি হওয়ায় মায়ের মৃত্যুহার এখনো ঠেকানো যাচ্ছে না।
এখনো বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৭৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ১৪ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে, যা প্রতিরোধযোগ্য। এসডিজি ২০১৫-এ মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ১৪৩ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে এসডিজি ২০৩০-এ প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা এখনকার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। উন্নয়নশীল ডিজিটাল বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর উচ্চহার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লজ্জার বিষয়। শুধু তাই নয়, মাতৃমৃত্যুর হার কোনো দেশের নারীস্বাস্থ্যের প্রতি সরকার বা সমাজ কতটুকু গুরুত্ব দেয় তার পরিচায়ক।
পরিকল্পিত গর্ভধারণ, গর্ভকালে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান, প্রসব পরিকল্পনা, নারীবান্ধব সেবাকেন্দ্র, সেবাকেন্দ্রের জবাবদিহিতা, মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন, সরকারি বিশেষ বরাদ্দ ও গুরুত্ব মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনতে পারে। জন্মের জন্য মৃত্যু নয়—
সেটাই হওয়া উচিত আমাদের প্রত্যাশা।
ডা. রেজাউল করিম কাজল
সহযোগী অধ্যাপক, অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়