বাহক বাহিত রোগগুলোর মধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, কালাজ্বর অন্যতম। একসময় ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর গ্রামীণ জনপদের জন্য স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও তা আজ অনেকটা নির্মূলের পথে। সীমিত কিছু এলাকায় এগুলো এখন সীমাবদ্ধ। আশা করা যায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে কালাজ্বর নির্মূল ঘোষণা করা সম্ভব হবে।
করোনা অতিমারীর মধ্যে বাহক বাহিত রোগগুলোর মধ্যে যা এখন সবচেয়ে বেশি জনসমস্যা হিসেবে চিহ্নিত তা হলো ডেঙ্গু। একসময় শহুরে রোগ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ২০১৯ সাল থেকে এটি প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি কোনো কোনো অঞ্চল বা জেলায় বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
যে বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো ডেঙ্গু ক্রমেই গ্রামের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে। এডিস মশা মূলত শহরের মশা, যা এডিস ইজিপ্টি নামে পরিচিত। গ্রাম অঞ্চলে এ মশার জাতটি অ্যালবোপিকটাস নামে পরিচিত, যা ডেঙ্গু রোগের সেকেন্ডারি ভেক্টর। ডেঙ্গুর বিস্তারে এর ভূমিকা যৎসামান্য বলে মনে করা হয়।
এডিস ইজিপ্টি মশা মূলত পুরনো টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনের মেঝেতে জমান পানি, লিফটের গর্তে জমান পানি, মিটারের গর্তে জমান পানি, প্লাস্টিক ড্রাম, প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত পাত্র, দই পাত্রসহ অন্যান্য পরিত্যক্ত পাত্রে ডিম পাড়ে। এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা গাছের কোটর বা গর্ত, কলা ও মানকচু জাতীয় গাছের কাণ্ডের মাঝে জমানো পানিতে বা বাঁশের গোড়ার পরিত্যক্ত অংশের গর্তে, সিমেন্টের চারি ও মাটির মটকা বা কলসসহ অব্যবহূত পাত্রে জমানো পানিতে ডিম পেড়ে থাকে, যার সঠিক ব্যবস্থাপনা বেশ কঠিন।
মশার জাতগুলোর মধ্যে এডিসের বেশকিছু বিশেষত্ব রয়েছে। এডিস মশা পাত্রের গায়ে পানির উপরিভাগের আর্দ্রতাযুক্ত স্থানে ডিম পেড়ে দেহনিঃসৃত এক ধরনের আঠার মাধ্যমে তা আটকিয়ে রাখে। পাত্রের পানি শুকিয়ে গেলেও তা সুপ্ত অবস্থায় ছয় মাস এমনকি এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। পরবর্তী সময়ে যখন পানি ও উপযুক্ত পরিবেশ পায় তখন ডিম ফুটে লার্ভার জন্ম হয়। ওই ডিম যদি ভাইরাসবাহী হয়, ডিম থেকে যে সব লার্ভা ও পরিপক্ব মশা বের হয় তাও ভাইরাসবাহী হয়, যা পরবর্তী সময়ে ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ডেঙ্গু একটি আর্বোভাইরাল রোগ। ডেঙ্গু জ্বর ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে হয়। যার চারটি সেরোটাইপ রয়েছে—ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ডেনভি-৪ টাইপের আধিক্য দেখা দিয়েছে। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণে মারাত্মক রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) এক গবেষণায় দেখা গেছে, তিন-চার বছর ধরে ডেঙ্গুর চারটি টাইপের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মারাত্মক টাইপ ডেনভি-৩ ভাইরাস সংক্রমণ কমিউনিটিতে বিরাজমান। বিষয়টি বিসিএসআইআর জিনমিক সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ মুন্সি তার গবেষণায় তিন-চার বছর ধরেই ডেঙ্গুর সেরোটাইপ বিশ্লেষণে ডেনভি-৩-এর অস্তিত্ব কমিউনিটিতে পেয়েছেন। ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ডেনভি-১ ও ডেনভি-২ টাইপ সংক্রমিত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই এসব ধরনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলে এ দুটি ধরনের প্রতি অনেকাংশেই প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করেছে।
পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। বর্তমানে প্রতি বছর ১০ থেকে ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ রোগী (ব্রাজিলসহ পার্শ্ববর্তী দেশে) ট্রপিক্যাল ও সাব-ট্রপিক্যাল জলবায়ু সমৃদ্ধ এলাকার। সংক্রমিত রোগীদের শতকরা ৮০ ভাগের মধ্যে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ বছর ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৬৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এর আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে কম্বোডিয়ায় ৭ হাজার ২২৯, লাওস ২৪ হাজার ২৫৫ (২০২১-এর তুলনায় ২২ গুণ),
মালয়েশিয়া ৪২ হাজার ৮৪ (১১৭% বৃদ্ধি), ফিলিপাইন
১ লাখ ৬০ হাজার ৯৫৬ (১৮৩% বৃদ্ধি), সিঙ্গাপুর
২৭ হাজার ৭৬১ (৬৪৮% বৃদ্ধি), ভিয়েতনাম
২ লাখ ২৪ হাজার ৭৭১ (সাড়ে ৪ গুণ বৃদ্ধি) ও বাংলাদেশে ২৯ হাজার ১০৭ (৩২% বৃদ্ধি) রোগী শনাক্ত হয়েছে।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এডিস মশার ওপর জরিপ চালিয়ে আসছে। মাঝে কয়েক বছর ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ কম থাকায় এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০১৪ সাল থেকে পুনরায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় ওই জরিপকাজ নিয়মিতভাবে বছরে তিনবার পরিচালনা করা হচ্ছে। মৌসুম-পূর্ব, মৌসুম ও মৌসুম-উত্তর জরিপ কার্যক্রমের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিল্ডিংয়ের মেঝেতে জমানো পানি, প্লাস্টিকের বালতি, প্লাস্টিকের ড্রাম, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, মাটির পাত্র ও মিটারের গর্তে জমানো পানিতে সর্বাধিক পরিমাণ লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্মূল ও এডিস বাহিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণাধীন ভবন ও বহুতলবিশিষ্ট ভবনে সর্বাধিক পরিমাণে এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া যায়। ফলাফলে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবন ও বহুতল ভবনের মধ্যে পরিত্যক্ত কনটেইনার থাকায় সেগুলোয় এডিসের উপস্থিতি বেশি।
যেসব ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় তার মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন ও বহুতল ভবনের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগের বেশি। এসব ভবনে রক্ষিত ও পরিত্যক্ত প্রজননস্থলগুলোতে সর্বাধিক পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, যা কখনো কখনো ১০০ থেকে ১০০০ গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। মৌসুম ঋতুতে যেহেতু প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হয়, তাই ছোট ছোট প্রচুর পরিত্যক্ত পাত্রে জমানো পানিতে এডিস মশার লার্ভা উত্পন্ন হয়, যা বৃষ্টির সময় যথেষ্ট পরিমাণে লার্ভা উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এ মুহূর্তে যে বিষয়গুলো বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন তা হলো—
১. যেহেতু পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে পরিপক্ব ভাইরাসবাহী মশা রয়েছে যা তিন থেকে চার সপ্তাহ, কখনো ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভাইরাস সংক্রমণে ভূমিকা রাখে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিপক্ব মশা মেরে তার ঘনত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
২. পরিপক্ব মশা মারার পাশাপাশি পরিবেশে বিদ্যমান ডিম ও লার্ভা ধ্বংস করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু ওই ডিম ও লার্ভা ভাইরাসবাহী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. ঢাকা শহরের অনেক বড় বড় নালায় প্রচুর পরিমাণে পরিত্যক্ত পাত্র রয়েছে, যা বৃষ্টির মৌসুমে মশার প্রজনন উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব পরিত্যক্ত কনটেইনার দূরীকরণ ও যন্ত্রচালিত মেশিনের মাধ্যমে লম্বা হোস পাইপ ব্যবহারের সাহায্যে লার্ভিসাইড স্প্রে করে ওই সব এলাকায় লার্ভা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৪. প্রত্যেক নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিককে লার্ভিসাইড স্প্রের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে নির্মাণাধীন ভবন কর্তৃপক্ষের নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় প্রতি সপ্তাহে একবার লার্ভিসাইড স্প্রে করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
৫. প্রত্যেক মহল্লায় যেসব সোসাইটি রয়েছে, তাদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজনন স্থান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৌসুম শুরুর আগে এপ্রিল-মে মাসে এডিস মশার মূল প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মৌসুমের শুরুতেই এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করলে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মো. খলিলুর রহমান: সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সাবেক জাতীয় পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা