চলচ্চিত্র সংস্কার

রাষ্ট্রীয় অনুদানে ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, চাই প্রক্রিয়ার সংস্কার

সরকারিভাবে সিনেমায় অনুদান ও অনুদানের ছবি নির্মাণের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার কাজটি এফডিসির মাধ্যমে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় শুধু নীতিমালা তৈরির কাজ করবে। তার আগে এফডিসির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে।

জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানের পর রাষ্ট্র ও তার বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে জোর আওয়াজ উঠেছে। প্রতিষ্ঠান সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক খাতসমূহসহ গণমাধ্যমও এ প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র তার গৌরব হারালেও তা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য থেকেই এখন নানা প্ল্যাটফর্মে ও আলোচনায় এ দেশে চলচ্চিত্রের গোটা কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর নানা রকম প্রস্তাবনা দেয়া হচ্ছে। মাধ্যম হিসেবে সিনেমার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বতী সরকারের কাছে বাংলাদেশের সিনেমার খোলনলচে পালটে দেয়ার দাবি অযৌক্তিক মনে হতে পারে— তবু কিছু প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রথা আর ব্যবস্থাপনা সংস্কারের কাজ আশু ও মধ্যবর্তী করণীয় হিসেবে এই সরকারও করতে পারে। সে লক্ষ্যেই ধারাবাহিক এ লেখার অবতারণা। যেখানে চলচ্চিত্রের অনুদান প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে এফডিসি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার অব্যবস্থাপনা এবং সেন্সর প্রথার আপগ্রেডেশন নিয়ে আলাপ করা হবে।

চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য গঠিত কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অন্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন ঘটছে, বা ঘটে চলেছে— তারই ধারাবাহিকতায় সিনেমায় অনুদান প্রদান বিষয়ক কমিটিতেও পরিবর্তন এসেছে। মূলত তিন ধরনের মানুষ এ জাতীয় কমিটিগুলোয় থাকেন। তাদের একটা অংশ আমলা— পদবি অনুযায়ী যারা অনেকেই কমিটির সদস্য হয়ে থাকেন, আরেকটি অংশ— নির্দিষ্ট সেক্টরের মানুষ। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমলাদের সংখ্যা বা পদবি অনুযায়ী তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। খাত সংশ্লিষ্ট যারা, তারাও কমিটিতে বহাল তবিয়তে আছেন। এই মাধ্যমের নতুন কিছু মানুষ কেবল যুক্ত হয়েছেন কমিটিতে।

সিনেমায় সরকারি অনুদান প্রদান প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রায় সাড়ে চার দশক আগে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। এরপর থেকে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান হিসেবে অর্থ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ এই সময়ে নীতিমালা তৈরি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সরকারগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদান করেছে। গেল আওয়ামী সরকারের সময় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও এই তালিকায় যুক্ত হয়। এখন বছরে কমবেশি ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা এ বাবদ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। দুই ক্যাটাগরিতে কমবেশি ২০ থেকে ২২ জন নির্মাতা-প্রযোজক প্রতি বছর এ অনুদানের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকেন। কাগজে-কলমে নীতিমালা থাকলেও ঠিক কোন কোন যোগ্যতায় একজন নির্মাতা অনুদান পেয়ে থাকেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। চূড়ান্ত মনোনয়নের পর সরকার প্রত্যেক নির্মাতার সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ হয়। চূড়ান্ত বিচারে ছবিটি নির্মাণ করে একটি কপি সরকারের হাতে তুলে দেয়া ছাড়া উল্লেখ করার মতো কঠিন কোনো শর্ত চুক্তিপত্রে থাকে বলে জানা নেই।

একটা সময় ছিল, যখন অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতারা অনেকে ছবি নির্মাণ না করেও টাকা তুলে নিতেন, বা নেয়ার চেষ্টা করতেন। তবে সম্প্রতি অনুদানপ্রাপ্ত ছবির নির্মাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ সময়মতো ছবি নির্মাণ করতে না পারায় শোকজ ইত্যাদিরও মুখোমুখি হয়েছেন, সময়মতো কাজ না করায় অর্থ ফেরতও দিয়েছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি এক কবি কাম নির্মাতা তো সময়মতো ছবি নির্মাণ না করা এবং মন্ত্রণালয়ের শোকজের জবাব না দেয়ায় রীতিমতো এক রাত জেলও খেটে এসেছেন।

তবে গেল দেড় দশকের আওয়ামী শাসনামলে অনুদানের ফিল্মের পুরো প্রক্রিয়ায় রাজনীতির প্রভাব লক্ষ করা গেছে। স্বাধীন ধারার কয়েকজন নির্মাতা ছবি নির্মাণে অনুদান পেলেও— শোনা যায়, অনুদানপ্রাপ্তির গোটা প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, এমন মানুষেরাই। ফলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যেসব ছবিকে সরকারি অনুদান দেয়া হয়, তার অধিকাংশই একদিকে যেমন বাণিজ্যিক সাফল্য দেখাতে পারেনি, অন্যদিকে স্বাধীন ধারার নির্মাতাদের সাফল্যের মাপকাঠি যে বড় কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি মুক্তি, সেটাও খুব ঘটেনি। ব্যতিক্রম হিসেবে বাণিজ্যিক সাফল্যের ক্ষেত্রে ‘দেবী’ আর ‘গেরিলা’র কথাই কেবল বলা যায়। যদিও এক্ষেত্রে নির্মাতা-প্রযোজকদের উদ্যোগই এই ছবি দুটির সাফল্যে ভূমিকা রেখেছিল। অন্যদিকে অনুদানপ্রাপ্ত আর্ট হাউজ ছবির সাফল্যের তালিকায় কেবল ‘মেঘমল্লার’ আর ‘নোনা জলের কাব্য’-এর নাম করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত আর্ট হাউজ ফিল্ম হিসেবে বৈশ্বিক ফেস্টিভাল সার্কিটে এই ছবি দুটি জায়গা করে নেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—সিনেমা নির্মাণের জন্য সাড়ে চার দশকে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করে দেশের জন্য কী অর্জিত হলো? আর্ট বা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আমাদের অর্থনীতি কিংবা সংস্কৃতিতে সিনেমা কতখানি জায়গা করে নিতে পারল? এ জন্য কেবল অনুদান নয়, সামগ্রিকভাবে শিল্প অথবা আর্ট হিসেবে সিনেমার মতো একটা মাধ্যম নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবনা কতখানি, তা নিয়েই আলোচনার সময় এসেছে এখন।

যেকোনো দেশে একটা নির্দিষ্ট খাত বা শিল্পমাধ্যমকে দেশের উন্নয়নে সহায়তা করতে চাইতে পারে সে দেশের সরকার। বাংলাদেশেও এমন উদাহরণ দেখা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েকটি শিল্পমাধ্যম বা খাত এ জাতীয় সহায়তা পেয়েছে। যদিও ব্যবসা সংক্রান্ত খাতগুলোর তুলনায় শিল্পখাত বরাবরই সহায়তা কম পেয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিই মূল চালিকা শক্তি— এ ধরনের ভাবনাই হয়তো সরকার বা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের চালিত করেছে। তারপরও গেল প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকে চারুকলা, থিয়েটার ইত্যাদি মাধ্যমগুলো নানাভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই ভিজুয়াল আর্টের চর্চার জন্য খ্যাত। এ দেশে থিয়েটারের চর্চার কথাও জানেন অনেকে। কিন্তু সিনেমা নির্মাণ হয়, এমন দেশ হিসেবে বাইরের পৃথিবীতে জানাশোনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সম্প্রতি আমাদের নির্মাতাদের ছবির আন্তর্জাতিক পরিচিতি ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও তা খুব বেশিদিনের ঘটনা নয়, আর এক্ষেত্রে আমরা খুব ধারাবাহিকও নই। ফলে সিনেমা প্রডিউসিং ন্যাশন হিসেবে এখনো আমাদের তেমন বৈশ্বিক পরিচিতি নেই।

ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সিনেমা ও তার বৈশ্বিকীকরণের মাত্রায় এই প্রক্রিয়াকে যুক্ত করার প্রয়োজন আছে। সেই লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা এখানে দেয়া গেল—

এক. সরকারিভাবে সিনেমায় অনুদান ও অনুদানের ছবি নির্মাণের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার কাজটি এফডিসির মাধ্যমে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় শুধু নীতিমালা তৈরির কাজ করবে। তার আগে এফডিসির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে।

দুই. অনুদান প্রধানত স্বাধীন ধারার ফিল্মের জন্য হতে হবে। বাণিজ্যিক সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতা অন্যভাবে করা হতে পারে। ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া একটা ভালো উপায়। প্রযোজকরা এসএমই ক্যাটাগরিতে কীভাবে এই ঋণ পেতে পারেন— সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তিন. প্রকল্পে একজন সহপ্রযোজক থাকলে নির্মাতা বা প্রযোজক অনুদানপ্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন। এক্ষেত্রে বিদেশী কো প্রডিউসারদের যুক্ত করতে পারলে ছবির প্রকল্প প্রাধান্য পাবে। পাশাপাশি, অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতা/প্রযোজককে অনুদানপ্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক কো প্রডিউসার যুক্ত করতে হবে বা কো প্রোডাকশন মার্কেটে ছবির প্রজেক্ট পিচ করতে হবে।

চার. প্রথম বা দ্বিতীয় ছবি নির্মাণ করতে চলেছেন, এমন নির্মাতারা অনুদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। অন্তত ত্রিশ ভাগ অনুদান এ ধরনের নির্মাতাদের দিতে হবে।

পাঁচ. অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ নির্মাতারাও অগ্রাধিকার পেতে পারেন। তবে কোনো নির্মাতাই দুইবারের বেশি অনুদান পাবেন না।

ছয়. তরুণ ও নারী নির্মাতারাও অনুদানপ্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পেতে পারেন। ন্যূনতম বিশ ভাগ অনুদান এ ধরনের নির্মাতাদের দেয়া যেতে পারে।

সাত. পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ ক্যাটাগরিতে কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের পাশাপাশি নীরিক্ষাধর্মী ফিল্মকেও অনুদান দিতে হবে। ভিজুয়াল আর্টিস্ট বা অন্যান্য মাধ্যমের কেউ এ ক্যাটাগরিতে আবেদন করতে পারেন।

আট. অনুদান কমিটিতে সরকারি আমলার সংখ্যা হবে ন্যূনতম। সচিব বা উপদেষ্টা ছাড়া কেবল দাফতরিক কাজে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আমলারা থাকবেন। বাকি সদস্যরা বাইরে থেকে নির্বাচিত বা মনোনীত হবেন।

নয়. সরকার নিজ উদ্যোগে একটা ফিল্ম মার্কেটের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করতে পারে। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে এফডিসি। অনুদান পাওয়া স্থানীয় ছবির প্রজেক্টগুলো সেখানে প্রাধান্য পেতে পারে— যাতে করে এই প্রজেক্টের প্রযোজকরা আন্তঃদেশীয় সহপ্রযোজক খুঁজে নিতে পারেন।

দশ. অনুদানপ্রাপ্ত ছবির প্রকল্প নিয়ে কোনো নির্মাতা বা প্রযোজক বিদেশী ফিল্ম মার্কেটে অংশ নিতে চাইলে সরকার অবশ্যই সহায়তা করতে পারে।

এগার. অনুদানপ্রাপ্ত ছবির মুক্তি বা প্রিমিয়ারের জন্য পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় জাতীয়ভাবে ন্যশনাল ফিল্ম থিয়েটার করা দরকার। পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমির দেশব্যাপী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউটেও কোনো কোনো ফিল্মের প্রিমিয়ার বা প্রদর্শনী করা যেতে পারে।

আসলে সিনেমায় সরকারি অনুদানকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং দেশের স্বাধীন ধারার ছবির সামগ্রিক বিকাশের একটা উপায় হিসেবে দেখতে হবে। তবেই একটা সময় পর এই প্রক্রিয়ার সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে বসা যাবে। কেবল বিচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর কিছু ফিল্মকে সরকারি অনুদান দিয়ে লাভ নেই।

লেখক— নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সংগঠক

আরও