সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতির ধারা বদল হয়। একটা সময় গান ছিল রাজার স্তুতির জন্য, কবিতা ছিল রাজসভায় আবৃত্তির জন্য। তারপর অন্য এক সময় গান-কবিতা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে অধিকার আদায়ে। সে গানেরও আবার আছে ধরন। আমরা কখনো রণসংগীত শুনেছি, কখনো-বা রবীন্দ্রসংগীত শুনেছি এবং শুনছি। সহজে মনে হয় রণসংগীত মানুষকে উজ্জীবিত করে। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতও কখনো হতে পারে যুদ্ধের সময়ে যোদ্ধার মনের শক্তি বাড়ানোর উপাদান। এর মধ্যে এসে পড়ে নতুন ধারার গান, র্যাপ।
প্রচলিত ধারায় অনেকেই র্যাপকে চটুল, বস্তির ছেলেদের গান বলে হেয় করতেন। মূলত র্যাপারদের পোশাক ও স্টাইল থেকে শুরু করে তাদের গানের ভাষা নিয়েও ছিল সমালোচনা। এর অন্যতম কারণ র্যাপ ও র্যাপারদের নিয়ে ভুল ধারণা। একটা সময় দেখা গেল, তাদের গান রণসংগীতও হয়ে উঠতে পারে। সেটা না হলেও অন্তত প্রতিবাদ বা অধিকার আদায়ের ভাষাও হয়ে উঠতে পারে এ ধারার গান। সে বিষয়ই দেখিয়েছেন জয়া আখতার তার সিনেমা ‘গালি বয়’-এ।
মুম্বাইয়ের বিস্তৃত বস্তি অঞ্চল। ছোট ছোট ঘর টিনের চালের। সেখানে একসঙ্গে বহু লোকের বসত। না আছে জীবনের মৌলিক অধিকার, না আছে নতুন করে কিছু করার উদ্যম। এ জায়গা যে মুম্বাই হতে হবে এমনটা জরুরি নয়। হতে পারে দিল্লি কিংবা ঢাকাও। কিন্তু মূল বিষয় একই। সেটা হলো, একই রকম জীবন টেনে নিয়ে যাওয়া পুরুষের পর পুরুষ ধরে। কেননা এখানে স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই। একই ধারার ঘটনা আমরা দেখেছি কিছু দিন আগে। ঢাকায়ও শুরু হয়েছিল রÅাপের জনপ্রিয়তা। এখনো তা আছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে গ্রেফতার হয়েছেন হান্নান। ভাবটা এমন, এ সবই নিষিদ্ধ।
কিন্তু সে নিষিদ্ধ কাজই করতে চায় মুরাদ। বাবা পেশায় ড্রাইভার, মুরাদ আন্ডারগ্রাড স্টুডেন্ট এবং গলিঘুঁজির জীবনের মধ্যেও তার কাছে কোনোভাবে এসে ধরা দিয়েছে মিউজিক। কিন্তু সে মিউজিকের ধরন একটু আলাদা। মুরাদ পছন্দ করে ‘র্যাপ’। অথচ প্রচলিত ধারার মতো কিছু ইংরেজি শব্দ ঢেলে দিয়ে র্যাপ করায় সে ইচ্ছুক নয়। অর্থবহ র্যাপ গাইতে চায় সে।
মুরাদের এ ইচ্ছে জানে কেবল তার কিছু বন্ধু আর প্রেমিকা সাফিনা। সাফিনা এমন এক মেয়ে যাকে তার মা পাহারা দিয়ে কলেজে নিয়ে যায় নিয়ে আসে। এরই মধ্যে কোনোভাবে সে মুরাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ধরে রাখে শক্ত হাতে। শুধু তা-ই নয়, মুরাদকে জুগিয়ে যায় সাহস।
মুরাদ শব্দের অর্থ ‘অভিলাষ’ অর্থাৎ লালিত কোনো স্বপ্ন সফল করার ইচ্ছা। ‘সাফিনা’ অর্থ ‘তরণী’। জয়া আখতার তার ‘গালি বয়’ সিনেমার গল্পের সঙ্গে চমৎকারভাবে নামকরণ করেছেন দুই প্রধান চরিত্রের। স্বপ্ন নিয়ে তো বাঁচে কত মানুষ, কিন্তু বাধার সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মতো তরণী সবার থাকে না, যা পেয়েছিল মুরাদ।
মূলত জয়া আখতারের গালি বয় কেবল সিনেমার গল্পের জন্য কিংবা রণবীর-আলিয়ার অভিনয়ের জন্যই অনবদ্য হয়নি, বরং এ সিনেমায় ব্যবহৃত এমন নানা উপমা, তার সঙ্গে শহরের বা জীবনের এমন একটা চিত্র ফুটে উঠেছে যা আগে বলিউডের মূলধারার সিনেমায় এসেছে খুব কম।
এ সিনেমায় মুরাদের স্বপ্নের পাশাপাশি আমরা দেখি তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করা এবং সেখানে মুরাদসহ তার পরিবারের অসহায়তা। নিচুতলার মুসলিম একটি পরিবারের চিত্র চমৎকার ফুটে উঠেছে, যেখানে মুরাদ র্যাপ গাইতে চায় কিন্তু সে নামাজ পড়ে এবং মদ থেকে দূরে থাকে। আমরা দেখি, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সাফিনাকেও। পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও পর্দা ও কঠিন নজরদারি তার ওপর।
এসবের মধ্য দিয়েও কেবল তীব্র সহ্যক্ষমতা ও স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে যায় মুরাদ। সেজন্য কখনো তার ঘর ছাড়তে হয়, কখনো টাকার জন্য গাড়ি চুরি করতে হয়। নিচুতলার গল্পগুলো এমনই। সিনেমায় যেমন বলা হয়েছে একটি গানে, ‘খুব কাছে আমরা তবু খুব দূরে, এ কেমন অসহায়তা?’ অর্থাৎ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এমন অনেক স্বপ্ন আছে, যা আমরা জানি না কিংবা জানতেও পারি না। তীব্র জ্বালা নিয়ে চলা মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু করতে চায়। কিন্তু তাদের সব গল্প সবসময় জানা হয় না। এমন গল্প থাকে পাকিস্তানের স্টার শাহের গানেও।
মুরাদের গল্প হয়তো তুলে এনেছেন জয়া। সে গল্পে নিজের অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন রণবীর সিং। এমন সিনেমাগুলোয় আজকাল সাধারণত নায়িকা কেবল শোপিস হিসেবে থাকে, কিন্তু এ গল্পে আলিয়ার সাফিনা চরিত্রটি অনেক অর্থবহ। আলিয়াও করেছেন দারুণ। সেই সঙ্গে বার বার হেরে যাওয়া মানুষের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের ‘টু দ্য পয়েন্ট’ চিত্রায়ণ, সিনেমাটিকে দিয়েছে অনন্য এক মাত্রা। তাই এ সিনেমা দেখে সবারই মনে হবে, ‘আমাদেরও সময় আসবে’।