ভৌতিক গল্পের আড়ালে সমাজ বাস্তবতা

ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে হরর জনরা ইদানীং বেশ জনপ্রিয়। বহুদিন থেকেই তারা নির্মাণ করছে হরর সিনেমা।

ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে হরর জনরা ইদানীং বেশ জনপ্রিয়। বহুদিন থেকেই তারা নির্মাণ করছে হরর সিনেমা। তবে বলিউডের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে হরর কমেডি। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় অমর কৌশিক পরিচালিত ‘স্ত্রী’। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন শ্রদ্ধা কাপুর, রাজকুমার রাও, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, অপরশক্তি খুরানা, বিজয় রাজ, অভিষেক ব্যানার্জি প্রমুখ। এ সিনেমারই সিকুয়াল নিয়ে অমর কৌশিক হাজির হলেন ছয় বছর পর। নির্মাণ করেছেন ‘স্ত্রী টু’। সিনেমাটি গত ১৫ আগস্ট মুক্তি পেয়ে ভারতের বক্স অফিসে রীতিমতো রেকর্ড করে। সিনেমার এমন জনপ্রিয়তার বেশকিছু কারণ আছে। স্ত্রী টু মূলত ভৌতিক গল্পের আড়ালে সমাজ বাস্তবতা নিয়ে এসেছে। কমেডির আড়ালে সে বার্তা ও অবস্থার সঙ্গে দর্শক নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন।

সিনেমাটি শুরু হয় একটি মেয়েকে অপহরণের মধ্য দিয়ে। বাড়ির গলিতে ধূমপান করার সময় তাকে তুলে নিয়ে যায় ভূত বা ভৌতিক কোনো শক্তি। সিনেমার গল্প আমাদের এর পর জানায়, এলাকা থেকে এমন আরো নারী গায়েব হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে গল্প এগোলে জানা যায়, স্কন্ধকাটা তাদের অপহরণ করছে এবং তাদের রক্ষা করতে বা অন্য কোনো কারণে ফিরে আসে স্ত্রী।

স্ত্রী সিনেমায় স্ত্রী বা নাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রদ্ধা কাপুর। প্রথম সিনেমাটির ক্লাইম্যাক্সে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দুনিয়ায় বা হারিয়ে গিয়েছিলেন। ছয় বছর পরও ভিকি (রাজকুমার রাও) তার অপেক্ষায় আছে। এদিকে বিট্টু নতুন নতুন প্রেম করে যাচ্ছে। রুদ্র ভাইয়া (পঙ্কজ ত্রিপাঠি) এখনো তার ভূত গবেষণা ও বই নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ছোট শহরটির তেমন কিছু বদলায়নি, কিন্তু এরই মধ্যে নতুন করে ভূতের উপদ্রব তাদের চিন্তিত করে ফেলে। সেখান থেকেই আমরা দেখি সমাজ বাস্তবতা।

আমাদের সমাজে (ভারতীয় উপমহাদেশে কিছু বিষয় সাধারণ পরিচিত) নারীসংক্রান্ত কোনো বিষয় উঠলে নারীদেরই দোষারোপ করা হয়। স্ত্রী টুতে আমরা দেখি স্বন্ধকাটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে আধুনিকমনস্ক নারীদের। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। বিট্টুর প্রেমিকাকে তুলে নেয়ার পর সবার টনক নড়ে। কিন্তু এরপর সেখানকার বয়স্করা বলতে শুরু করে, ‘সারকাটা (স্কন্ধকাটা) তো আমাদের ধরে নিচ্ছে না। আধুনিক মেয়েদের নিচ্ছে।’ অর্থাৎ এ নিয়ে তাদের তেমন কোনো খারাপ লাগা নেই। ধর্ষণ, ইভ টিজিং নিয়েও আমাদের সমাজে এমন সব কথা প্রতিনিয়তই শোনা যায়। হ্যারাসমেন্টের জন্য দোষারোপ করা হয় নারীদেরই।

স্ত্রী ফিরে আসে, কিন্তু দেখা যায় তার শক্তি সারকাটার তুলনায় কম। তবু ভিকি ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্ত্রী এর একটা প্রতিবিধান করতে চায়। পুরনো গল্পের সূত্র ধরে অমর কৌশিক জানান, স্ত্রী ও সারকাটা তৈরি হয়েছিল নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে। স্ত্রী যে সত্তা, তিনি স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করায় সে সময়কার প্রভাবশালী পুরুষ তাকে হত্যা করে। এর পর থেকে স্ত্রী হয়ে সে তুলে নিয়ে যেত পুরুষদের। এখন বহুকাল আগের সে ক্ষমতাবান পুরুষ আধুনিকমনস্ক নারীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

গল্পের মধ্যেই মূলত সিনেমাটিকে দর্শকের পছন্দ করার নানা উপাদান আছে। এর বাইরে সিনেমা হিসেবে স্ত্রী টু খুবই সাধারণ মানের। বলিউডের আর ১০টা সিনেমার মতোই এর গতিবিধি। দর্শক টানার জন্য আনা হয়েছে আইটেম সং। সেখানে পারফর্ম করেন তামান্না ভাটিয়া। তবে গল্পের সঙ্গে এর মিল রাখা হয়েছে। কেননা দেখা যায়, নাচ গান করার কারণে শামার (তামান্না) প্রতিও সারকাটার ক্রোধ কম নয়। 

চিত্রনাট্য ভালো ও বেশ গতিশীল। কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফি সাধারণ। সারকাটার গ্রাফিক উপস্থাপনা আরো ভালো হতে পারত। সিনেমাটি হরর কমেডি, তাই ভয় উৎপাদন করার খুব বেশি দরকার ছিল না। তার পরও দর্শককে আরেকটু ভয় পাওয়ানোর প্রয়োজন ছিল। এ জায়গায় খুবই সাদামাটা হয়ে গেছে।

অভিনেতাদের মধ্যে ভালো করেছেন রাজকুমার রাও। কমিক টাইমিংয়ে তিনি অনেক কমেডি অভিনেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। ‘দিল সে রে’ বলে শাহরুখ খানের মতো অভিব্যক্তি দেয়ার চেষ্টা ও বিট্টুকে বিদ্রূপ করা থেকে স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম, সবক’টি জায়গায় তিনি দারুণ। অপরশক্তি খুরানা মোটামুটি ভালো করেছেন। তবে বেশকিছু দৃশ্যে নজর কাড়েন অভিষেক ব্যানার্জি। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থা, ভূতের ভয় থেকে বোকাসোকা ভাব, সব সিনেই তিনি ভালো করেছেন। রুদ্র চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠি এখানে অনেকটাই ম্রিয়মাণ। তাকে এমন রাখা হয়েছে কিংবা পঙ্কজের কাছ থেকে চাহিদা আরো বেশি ছিল। তবে হতাশ হতে হয় নাম চরিত্রের অভিনয়ে। শ্রদ্ধা এ সিনেমায় শোপিস। এর দায় অবশ্য নির্মাতাদের। কেননা তার চরিত্রকে সময়, সুযোগ ও গল্প দেয়া হয়নি। নাম চরিত্রের গুরুত্ব না রাখা এ সিনেমার সবচেয়ে নেগেটিভ দিক। অক্ষয় কুমারের ক্যামিও খুব একটা রুচিকর ছিল না। তবে ‘ভেড়িয়া’র সঙ্গে ইউনিভার্স করা ও বরুণ ধাওয়ানের সংযুক্তি মোটামুটি ভালো লাগার।

তবু সিনেমা উতরে গেছে। কেননা অ্যাকশন দেখতে দেখতে দর্শক হয়তো রুচি বদলাতে চেয়েছিলেন। আরো বোঝা যায়, তারা আসলে এখনো কৃত্রিম আগুন আর ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ পছন্দ করেন।

আরও