কলকাতার রাস্তায় ১৫০ বছর ধরে চলেছে ট্রাম। বাহনটি কলকাতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। এ নিয়ে রচিত হয়েছে গান, কবিতা, গল্প। পুরনো দিনের কথা বাদ, কলকাতার সিনেমার একালের পুরোধা সৃজিত মুখার্জির সিনেমা অটোগ্রাফে শ্রেয়া ঘোষাল গেয়েছিলেন—চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন। আর মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’য়ে রঞ্জিত মল্লিককে দেখা যায় ট্রামের পাশে পাশে হাঁটতে, ট্রামে চড়তে। কলকাতার এমন কত সিনেমায় ট্রাম আছে তা হয়তো হিসাব করে বলা যাবে না। সে যা-ই হোক, একদিকে যেমন ঐতিহ্যবাহী ট্রাম বন্ধ হচ্ছে, কলকাতায় আবার নতুন করে সিনেমাঘরে আনা হয়েছে মহানগর। নতুন করে সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার কথা জানা গেল গত সপ্তাহেই।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প অবতরণিকা (১৯৪৯ সালে প্রকাশিত)। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক নারী। স্বামীর চাকরি চলে গেলে শ্বশুরবাড়ির রক্ষণশীল প্রবণতা ডিঙিয়ে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন। সিনেমাটি আমাদের দেখিয়েছিল (এবং এখনো দেখায়) পঞ্চাশের দশকের কলকাতার বেকারত্ব, চাকরিহীনতা, সংসার চালানোর সংগ্রাম আর কলকাতার মতো মহানগরে মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকা। সোজাকথা, একটা মহানগরে মানুষের বেঁচে থাকা ও একটু ভালো থাকার গল্প সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’। মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। আরতি মজুমদার তার নাম। স্বামী সুব্রত মজুমদারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। আর ডি বনশল প্রযোজিত সিনেমাটি নতুন করে মুক্তি দেয়া হলো আর তার আগে অবশ্যই সিনেমাটি গেছে কিছু সংস্কারের মধ্য দিয়ে। টু-কে রেজল্যুশনে মুক্তি দেয়া হয়েছে সিনেমাটিকে।
কিছুদিন আগেই সংস্কার করা হয়েছে কন্নড় নির্মাতা গিরিশ কাসারাবল্লির ‘ঘটশ্রদ্ধা’। সিনেমাটি পুনরুদ্ধার করেছে ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। একই প্রতিষ্ঠানে গত বছর সংস্কার করা হয়েছিল আরিবাম শ্যাম শর্মার ‘ইশানোউ’। তবে মহানগর সংস্কারের পেছনে এরা নয়, আছে পিক্সিয়ন স্টুডিওস ও ক্যামিও মিডিয়া ল্যাবস। সিনেমাটি কেবল কলকাতা নয়—মুম্বাই, দিল্লি ও বেঙ্গালুরুর মতো মহানগরেও মুক্তি দেয়া হয়েছে।
আর ডি বনশলের উত্তরাধিকার এখন তার নাতনি বর্ষা বনশলের কাছে। তিনি এ মহানগর নিয়ে উৎসুক ছিলেন, কেননা সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সিনেমাটি তার বিশেষ পছন্দ। তিনি বলেন, ‘মহানগর খুব সুন্দর একটি সিনেমা এবং আজও প্রাসঙ্গিক। এখন অনেক সিনেমাই নতুন করে মুক্তি দেয়া হচ্ছে, তবে ব্যবসাসফল সিনেমার পাশাপাশি ক্ল্যাসিক সিনেমাও নতুন করে মুক্তি দেয়া উচিত।’
সত্যজিৎ রায় কলকাতাকে দেখেছিলেন স্পষ্ট করে, তবে নিজের মতো। মৃণাল, ঋত্বিক ও সত্যজিতের কলকাতা দেখানোর ধরন আলাদা হলেও কলকাতাকে তাদের সিনেমায় পাওয়া যায়। সত্যজিৎ ধরেছিলেন সময়ের রূপ হিসেবে। সত্যজিৎ রায় ও তার সিনেমা নিয়ে লিখতে গিয়ে অ্যান্ড্রু রবিনসন মহানগরের কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘এ সিনেমায় এক মধ্যবিত্ত নারীর গল্প বলা হয়েছে। তাকে সমাজের নিয়মানুসারে চলতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু আদতে এর মধ্য দিয়ে তার প্রতিভাকে নষ্টই করা হয় কেবল।’
একালের সিনেমায় এসে নারী স্বাধীনতার, স্বনির্ভরতার কথা বলা হয়। অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’, ‘গয়নার বাক্সো’, মৈনাক ভৌমিকের ‘মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর’, ‘আমি ও আমার গার্লফ্রেন্ডস’-এর তুলনায় মহানগর নারীর স্বাবলম্বিতার গল্প বলায় বহু এগিয়ে। ষাট থেকে এ দশকেও কলকাতায় নারীকে নিয়ে নির্মিত সিনেমায় হয়তো নারীপ্রধান চরিত্র হয়েছে, কিন্তু স্বাবলম্বী ততটা নয়।
ঋতুপর্ণ ঘোষের (উনিশে এপ্রিল, বাড়িওয়ালি, দহন) দর্শন একরকম, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর (উত্তরা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান) আরেক রকম, কিন্তু মহানগরে নারীর সংগ্রাম সত্যজিতের এ সিনেমার মতো কোথাও আসেনি। ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় ছিল, কিন্তু নীতা মহানগরের মেয়ে না। তাই মহানগর অনন্য। সেনেগালের নির্মাতা ওসমান সেমবেনের ‘ব্ল্যাক গার্ল’ তাই মহানগরকে অনুসরণ করে। তাই পশ্চিমবঙ্গের একালের নির্মাতাদের সিনেমায় যেখানে নারী আর ট্রাম কেবল অ্যাস্থেটিক এলিমেন্ট, সত্যজিতের মহানগরে আজও মাধবী ট্রামলাইন ধরে হাঁটেন আত্মমর্যাদায়।