জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গেল ৫৪ বছরে যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ঘুণে ধরে গেছে, সেগুলো সংস্কারের দাবিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লেখাবাহুল্য— এই তালিকায় শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমা থাকবে কিনা, সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, গেল ৫৪ বছরে আর্ট বা ইন্ডাস্ট্রির কোনো জায়গাতেই এ মাধ্যমটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি দায় আছে এই মাধ্যমসংশ্লিষ্ট সকলের। ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলায় এখন এই মাধ্যমে কর্মরত অনেকেই রুটি-রুজির প্রয়োজনে ঝুঁকে পড়েছেন বিজ্ঞাপন নির্মাণে। ইউটিউব বা টেলিভিশন নাটক নির্মাণ বা সম্প্রতি ওয়েবসিরিজে কাজ করা অনেকের পেশা হয়ে উঠেছে। সিনেমা যে একেবারে নির্মিত হচ্ছে না, তা নয়। তবে গেল এক দশকে বছরে দশটি সিনেমাও ব্যবসাসফল হতে পেরেছে কিনা, সে নিয়ে সন্দেহ আছে সবারই। আর্ট হাউস সিনেমার দশা আরো করুণ। হাতে গোনা কয়েকটি নামই ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতা হিসেবে বৈশ্বিক সিনেমা সার্কিটে পরিচিতি পেয়েছে, তার বাইরে নতুন মুখ দেখা যায় কালেভদ্রে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথা বাদ দেই, কারণ বলিউড আর দক্ষিণী সিনেমার বাইরে এখন সেদেশে নানা ধারার সিনেমা তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, পাকিস্তানও আমাদের চাইতে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথাটি এ প্রসঙ্গে এসেই যায়। কারণ চলচ্চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোই কিন্তু এখন বৈশ্বিক সিনেমার পরিসর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এশিয়ায় ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা তো অবশ্যই বলতে হয়।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যোগাযোগের মুল কারণই হলো, সিনেমার ক্রাফট ও আর্টের সঙ্গে সিনেমা শিল্পকে যুক্ত করা। পাশাপাশি নতুন ট্যালেন্ট আবিষ্কার এবং তার পরিচর্যাও প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। ভারতে দুটো রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে বহুকাল ধরেই উঁচুমানের ক্রাফটসম্যানরা বলিউড বা দক্ষিণী সিনেমার কারিগরি বিভাগগুলো সমৃদ্ধ করেছেন, এখনো করে চলেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে, এ দুই প্রতিষ্ঠানের একটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে কর্মরত এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, কীভাবে স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যেই জওহরলাল নেহেরুর পরিকল্পনায় একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) এবং পুনেতে অবস্থিত ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (এফটিআইআই) প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়েছিল। তার ফলশ্রুতিতে আজ একদিকে যেমন সিলিকন ভ্যালির টেক জায়ান্টদের মূল কর্মযজ্ঞ ভারতীয়দের হাতে রয়েছে, তেমনি, বলিউড ও দক্ষিণি সিনেমার পাশাপাশি এই অঞ্চলে নানা ধরনের আর্ট হাউস সিনেমার সুতিকাগার হয়ে উঠেছে ভারত।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কিন্তু উলটো। এদেশে সিনেমার অ্যাকাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে অনেক বছর ধরেই ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের মানুষেরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবু দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলচ্চিত্র শিক্ষার কাজ শুরু হতে প্রায় চার দশক লেগে গেছে। এক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগে উদ্যোগ নিলেও জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনেমা বিষয়ক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের বয়স এক দশকের বেশি নয়। যতটুকু জানা যায়, তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় পর্যায়ের ফিল্ম ইন্সটিটিউট এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগসমূহ মিলিয়ে রাজধানী এবং এর আশপাশেই আনুমানিক দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতি বছর সিনেমার নানা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি হলেও তারা কি শিখছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
কয়েকদিন আগে চলচ্চিত্র নিয়ে সংস্কার বিষয়ক এমন এক আলোচনায় যেতে হয়েছিল বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টিভি ইন্সটিটিউটে। জাতীয় পর্যায়ের এই চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরাও অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো দেশে জুলাই বিপ্লবের পর ইন্সটিটিউটের অবস্থা পরিবর্তনে সরব হয়েছেন। কিন্তু সেদিনের আলোচনায় মনে হলো, গোটা আলোচনাটাই যেন হচ্ছে, কী করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে আমলাতান্ত্রিকতা মুক্ত করা যায় তা নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনায় কিন্তু ইন্সটিটিউটের সিলেবাস, কারিকুলাম নিয়ে আলাপ হলোই না বলা চলে।
কারণ, আলোচনা শুরু করলেন যে শিক্ষকরা, তারা প্রথমত, সাড়ে তিন দশকের বেশি আগে বিদেশ থেকে চলচ্চিত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে এসেছেন। তাদের কেউই দীর্ঘকাল শিক্ষকতায় যুক্ত নেই, এমনকি দেশে বা বিদেশে দীর্ঘ সময় ব্যাপী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজেও জড়িত নন মোটেই। এই অবস্থা যে কেবল জাতীয় চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউটের, তা কিন্তু নয়, সিনেমা বিষয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলে যে কয়টি পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, সবগুলোর অবস্থাই কম-বেশি এক রকম।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে অন্যান্য গুণাবলির পাশাপাশি পুনের (পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট) ডিগ্রিপ্রাপ্তরা যেন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হন। দীর্ঘকাল আগে এই ডিগ্রি নিয়ে এলেও কিংবা এই সুদীর্ঘ সময় সিনেমা মাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ততা না থাকলেও অসুবিধা নেই। কারণ, একই ডিগ্রিপ্রাপ্ত বন্ধু বা অগ্রজরা তাদের খুঁজে নেবেনই। ফলে বাংলাদেশে সিনেমার অ্যাকাডেমিক শিক্ষা ভারতীয় এই ফিল্ম ইন্সটিটিউটের শিক্ষার একটা সম্প্রসারণ হয়েছে কিনা, সেটা ভাবার সময় এসেছে। ব্যাতিক্রম যে এক্ষেত্রে নেই, তা কিন্তু নয়।
শিক্ষার ধরন কেবল নয়, সিলেবাস বা কারিকুলাম তৈরিতেও সেই একই ধারার প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। প্রায় সবকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয় পাঠদানের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে, তাতেও ভারতীয় একাধিক চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রমের প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়। ফলে, গতানুগতিক বিষয়সমূহই প্রাধান্য পাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের ফিল্ম ইন্সটিটিউট কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগে শিল্প নির্দেশনা, প্রযোজনা, অ্যানিমেশনের মতো বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। পাশাপাশি, ফিল্ম থিওরি, ক্রিটিসিজম বা ফিল্ম স্টাডিজের মতো বিষয় তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পাঠের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এমনকি এখনকার সময়ে বৈশ্বিক সিনেমার জগতে প্রামাণ্যচিত্র একটা গুরত্বপূর্ণ জনরা হিসেবে স্বীকৃত হলেও কেবল খণ্ডকালীন দুয়েকটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনেই যেন জাতীয় চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট বা একটা পাবলিক ইউনিভার্সিটি দায় সারছে।
আরো পড়ুন— এফডিসি সংস্কার করে ফিল্ম কাউন্সিলে রূপান্তর নয় কেন?
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে এই সংশ্লিষ্ট বিভাগে শিক্ষক সংকটই এখন মূল বিষয়। এক্ষেত্রে পুনের ডিগ্রিধারীরা যে প্রাধান্য পাচ্ছেন, তা আগেই বলেছি। সহযোগী হিসেবে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে এসেছেন যারা, তাদেরও ক্লাস নিতে দেখা যায়। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক খুঁজে পাওয়া। এক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ বলা চলে। কারণ, পুরো বিভাগটিই চলছে মাত্র চারজন শিক্ষক দিয়ে। যার একজন এরই মধ্যে নীপিড়নের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে আছেন, আরেকজন উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে। ফলে পুরো ডিপার্টমেন্টে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে। অথচ প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে আন্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ে।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির নামেই গলদ। শুরুতে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও কিছুদিন পর ফটোগ্রাফিও এ বিভাগের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতির বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এই বিভাগটি তার ইচ্ছেমতোই চলেছে। বিভাগের স্থায়ী শিক্ষকদের বেশিরভাগ সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে এসেছেন। যদিও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাতা বা সিনেমায় অ্যাকাডেমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কেউ কেউও এই বিভাগে কোর্স পড়িয়ে থাকেন। জাতীয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগটি অপেক্ষাকৃত নবীন। বিভাগের শিক্ষক মাত্র চার-পাঁচ জন। তাদের বেশিরভাগ সাংবাদিকতা বা থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এই বিভাগের শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বিস্তারিত বললাম না, যদিও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম অত পোক্ত না হলেও কারো কারো শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক নানা ধরনের পাঠ সহায়ক কার্যক্রম বেশ আকর্ষণীয়। বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টসের কথা বলতেই হয়। তবে অ্যাকাডেমিক প্রক্রিয়ায় এ জাতীয় কার্যক্রম কতখানি কাজে লাগে, জানা নেই।
এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, এখন আসি বাংলাদেশে সিনেমার মূল প্রশিক্ষণালয় বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের কথায়। প্রতিষ্ঠানটি যাত্রার শুরু থেকে এটি সরকারের কোন মন্ত্রণালয়ভুক্ত হবে, তা নিয়ে দোলাচল ছিল। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে যেতে পারত। ফলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একটা পূর্ণকালীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেই তা যাত্রা শুরু করে এ পর্যন্ত চালিয়ে এসেছে।
আরো পড়ুন— রাষ্ট্রীয় অনুদানে ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, চাই প্রক্রিয়ার সংস্কার
ফলে, আমলা বনাম শিক্ষক— গেল দশ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে স্পষ্টত দুটি পক্ষ হয়ে উঠেছে। আপাতত এই দ্বন্দ্বে আমলারা কূটকৌশল করে পদবি, বেতন-ভাতা, নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ঠেকিয়ে দিয়েছেন। আর এই দ্বন্দ্বের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা। গেল এক দশকে এভাবেই চলছে বাংলাদেশ সিনেমা শিক্ষার এই ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার এই অদ্ভুতুড়ে ব্যবস্থাপনাকে সামনে রেখেই এই অবস্থার পরিবর্তনে কিছু সংস্কার প্রস্তাবনা দেয়া গেল—
এক. উচ্চশিক্ষার এতগুলো প্রতিষ্ঠানে সিনেমার পাঠদানের প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ, প্রায় একই ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে জাতীয় চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশ্ববিদ্যলয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো শিক্ষক সংকটেও ভুগছে যতদুর জানি। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন ব্যাংক মার্জারের আলাপ করছে, তেমনি ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ জাতীয় বিভাগ একত্রীকরণের উদ্যোগ নিতে পারে।
দুই. চলচ্চিত্র শিক্ষায় যারা সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন, তাদেরকে শিক্ষকতায় প্রাধান্য দেয়া দরকার। ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়াসহ নানা দেশ থেকে তরুণ মেধাবীরা সিনেমার নানা বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে আসছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার। বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক নানা ধরন, পরিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে এরাই ধারণা দিতে পারবেন।
তিন. সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র অডিও ভিজুয়াল ইন্ডাস্ট্রির সংযোগ জরুরি। সিনেমা নির্মাতা নয় কেবল, যারা বিজ্ঞাপন, ওয়েব সিরিজ, বা নাটক নির্মানে জড়িত— প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাদের কাজে লাগানো দরকার। এক্ষেত্রে জনপ্রিয়দের নির্মাতা বা কুশলীদের ইন্সটিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সেশন নিতে সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
চার. নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের পাশাপাশি ফিল্ম স্টাডিজ, চলচ্চিত্র সমালোচনা, শিল্প নির্দেশনা, প্রযোজনা, অ্যানিমেশন ইত্যাদিকেও সম্পূরক কোর্স হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে— বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে।
পাঁচ. বৈশ্বিক নানা প্রথম সারির চলচ্চিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন স্কুল, অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ফিল্ম স্কুল, আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট ইত্যাদির সঙ্গে স্মারক সই করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্রেডিট ট্রান্সফারের ব্যবস্থা হতে পারে। কোলাবোরেশনের মাধ্যমে এ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে শিক্ষকও আনা যেতে পারে।
ছয়. অডিও ভিজুয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুযোগ তৈরিতে অফিসিয়াল ইন্টার্নশিপ চালু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বা ন্যাশনাল সিনেমা ইন্সটিটিউট উদ্যোগী হয়ে বড় প্রোডাকশন হাউস, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান, ওয়েব সিরিজ নির্মাতা বা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্মারক সই করতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ শেখার সুযোগ পান।
সাত. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা কাজ জরুরি একটা বিষয়। সিনেমার আর্ট, ক্র্যাফট বা টেকনোলজির নানা দিক নিয়ে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফেলোশিপ প্রদানের উদ্যোগ নিতে পারে।
আট. স্কুলের উঁচু ক্লাসে বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভিজুয়াল লিটারেসির একটা সম্পূরক কোর্স চালু করা যেতে পারে। ইউনিসেফ পরিচালিত এক মিনিটের মোবাইল ফোনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ একটা উদাহরণ হতে পারে এক্ষেত্রে।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাত তো বটেই, যে সব শিল্পখাত মূলধারার শিল্প বা সেবা খাত হিসেবে অবদান রাখছে, সেই খাতের উদ্যোক্তারা দেশে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না বলে প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। এক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষা না থাকা বা শিক্ষার কারিকুলাম শিল্পখাতগুলোর উপযোগী নয়, এ অভিযোগও তারা করে থাকেন। চলচ্চিত্রের মতো একটা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনানির্ভর মাধ্যম যদি শিল্প হয়, তবে এই খাতের শিক্ষার কী অবস্থা এদেশে, তা ওপরের আলোচনায় খানিকটা উঠে এসেছে। চলচ্চিত্র শিক্ষাকে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিতে, একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাল্টাতে হবে, তেমনি তিন দশক আগের অ্যাকাডেমিক শিক্ষাপ্রাপ্তদের দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালালে হবে না।
আমাদের সামগ্রিক চলচ্চিত্র শিক্ষাকে বৈশ্বিক অডিও ভিজুয়াল ইন্ডাস্ট্রির উপযোগী করে তুলতে করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ওপরের প্রস্তাবনাগুলোতে। এখনকার সময়ে যারার এ মাধ্যমের নীতি নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাদের কাছে এ প্রস্তাবনাগুলো ভেবে দেখার অনুরোধ থাকল।