দীর্ঘদিন নির্মাতা ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের সামনে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল সেন্সর বোর্ড। এ কারণে সেন্সর প্রথা বাতিল করে সার্টিফিকেশন বা গ্রেডিংয়ের দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। বিগত সরকারের আমলে সার্টিফিকেশনসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হলেও প্রয়োগ করা হয়নি। সার্টিফিকেশন আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে চলচ্চিত্র কর্মীদের জোরালো আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আইনটি করেছিল বিগত সরকার। তা অজ্ঞাত কারণে আটকে রাখা হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর নতুন উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সার্টিফিকেশন বোর্ড। গেল মাসে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয় বোর্ডের ১৫ সদস্যের নাম। সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সেন্সর বোর্ডের অবসান ঘটে।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘দ্য সেন্সরশিপ ফিল্মস অ্যাক্ট’ ১৯৬৩-এর বেশির ভাগ ধারাই সার্টিফিকেশন আইনে রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে কেবল নামেই। এ আইন সংশোধন না করা হলে সেন্সরের খড়্গ থেকে ঢাকার চলচ্চিত্রের মুক্তি মিলবে না।
‘দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্ম অ্যাক্ট’ ১৯৬৩ এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই আইনের কোনো কোনো ধারায় প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। আবার সার্টিফিকেশন আইনের কোনো ধারা সেন্সর আইনের চেয়েও বেশি দমনমূলক।
সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান কে হবেন, এর সদস্য সংখ্যা কত হবে, সার্টিফিকেশন বোর্ডের কার্যাবলি, সার্টিফিকেশন স্থগিত বা বাতিল কিংবা আইন লঙ্ঘনের শাস্তির ধারাগুলো নেয়া হয়েছে প্রায় হুবহু সেন্সর আইন থেকেই।
এদিকে সম্প্রতি চারটি সিনেমা দেখার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে নবগঠিত সার্টিফিকেশন বোর্ড। যেহেতু ‘দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্ম অ্যাক্ট’ ১৯৬৩ বাতিল করা হয়েছে, তাই এ মুহূর্তে আটকে থাকা সিনেমাগুলো কীভাবে মুক্তি দেয়া হবে এবং সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩-এর সংস্কার বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন নবগঠিত সার্টিফিকেশন বোর্ডের কয়েকজন সদস্য।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক তাসমিয়া আফরিন মৌ বলেন, ‘আমাদের কাজটা কেবল শুরু হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ সংশোধন করা হবে। তথ্য উপদেষ্টা ও আইন সচিব সংস্কারের বিষয়ে কথা বলেছেন। সংস্কারকাজ দ্রুতই হবে আশা করছি।’
এরই মধ্যে চারটি সিনেমা নতুন সার্টিফিকেশন বোর্ড দেখেছে। ‘ভয়াল’ নামে একটি সিনেমা এ গ্রেডে মুক্তি দেয়া হবে বলে জানা যাচ্ছে। এটা কতটুকু সত্যি, এমন প্রশ্নের জবাবে তাসমিয়া বলেন, ‘এ গ্রেডে কোন সিনেমা মুক্তি দেয়া হবে, এ বিষয়ে আমি জানি না। এ মুহূর্তে সার্টিফিকেশন অ্যাক্ট ২০২৩ যেটা আছে, যেখানে গ্রেডিং সিস্টেমের কথা বলা হচ্ছে, সেটা বিধিমালা অনুযায়ী আসবে। বিধিমালা এখনো প্রণয়ন হয়নি। ফলে এ গ্রেড, বি গ্রেড কীভাবে আসবে। একটা সিনেমা কোন ধরনের দর্শক দেখবেন। ১৫ বছরের নিচে, ১৮ বছরের ওপরে, ২১ বছরের ওপরে, গ্রেডিংটা সে অনুযায়ী হয়। যে ভঙ্গিতে সারা বিশ্বে কাজগুলো হয়। সেভাবেই হয়তো সংস্কার হবে। যেহেতু এখনো বিধিমালা হয়নি, ফলে গ্রেডিং বা রেটিং পদ্ধতিতে যাওয়া যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা অপেক্ষা করছি, যত দ্রুত সম্ভব বিধিমালা প্রণয়ন হবে।’
আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু সার্টিফিকেট দেয়ার ইস্যু আছে, ফলে সার্টিফিকেট দিয়েই আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়া হবে। যে সিনেমাগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, সে সিনেমাগুলি সার্টিফিকেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী আপাতত মুক্তি দিতে পারে। তবে এ মুহূর্তে যেহেতু অফিশিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি, তাই সিদ্ধান্ত পেলে বলা যাবে সিনেমাগুলো কীভাবে ছাড়া হচ্ছে। যেহেতু কার্যপ্রণালি এখনো শেষ হয়নি, তাই সিনেমাগুলো আপাতত ঠিক কীভাবে মুক্তি দেয়া হবে তা স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। যারা অনেক দিন ধরে সিনেমাগুলো রিলিজের অপেক্ষায় আছেন, তাদের দাবির কারণেই এখন সিনেমাগুলো দেখা শুরু হয়েছে। আমরা সিনেমাগুলো দেখছি এবং আশাবাদী কোনো ঝামেলা ছাড়াই আইন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রথাগত যে অবস্থার মধ্যে আছি, সেটার মধ্য দিয়ে যাতে সিনেমাগুলো মুক্তি পায়।’
এ নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক খিজির হায়াত খান বলেন, ‘সার্টিফিকেশন আইনটা গত সরকার রেখে গেছে, কিন্তু এর বিধিমালা এখনো হয়নি। যেহেতু বিধিমালা হয়নি, সেহেতু আমরা আইন প্রয়োগ করতে পারছি না। আইনটাকে সংস্কার করা হবে। আমরা ১৯৬৩ সালের আইন ও বিগত সরকারের ২০২৩ সালের করা সার্টিফিকেশন আইন পর্যবেক্ষণের মধ্যে আছি। আমরা যদি এ মুহূর্তে ১৯৬৩ সালের আইন প্রয়োগ করি, তাহলে সেটা আবার সেন্সর আইন হয়ে যায়। ২০২৩ সালের সার্টিফিকেশন আইনেরও বিধিমালা প্রণীত হয়নি। এগুলো নিয়ে আমরা একটা জটিলতার মধ্যে আছি। বিষয়টা নিয়ে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলছি। একটু সময় লাগবে।’
আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ১৯৬৩ সালের সেন্সর আইন ও ২০২৩ সালের সার্টিফিকেশন আইনকে পর্যালোচনা করে আমরা একটা সাময়িক সিদ্ধান্ত নেব, যাতে আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা যারা নিয়োগপ্রাপ্ত, তাদের কাজ হচ্ছে আটকে থাকা সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়া, কারণ সিনেমা আটকে থাকলে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে, আর সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলে অনেক মানুষ তাদের রুটি-রুজি হারাবে। সিনেমাগুলোর মুক্তির ব্যবস্থার পাশাপাশি সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ কীভাবে সংশোধন করা যায়, সেটার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ বিষয়ে একই কমিটির সদস্য প্রযোজক ও পরিচালক রফিকুল আনোয়ার রাসেল বলেন, ‘এ মুহূর্তে রেটিংয়ের কোনো বিধিমালা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি। সেক্ষেত্রে যে সিনেমাগুলো দেখা হচ্ছে, সেগুলো একটা প্রাথমিক রেটিংয়ে রাখছি, কারণ সেন্সর বাতিল হয়েছে। আমাদের রেটিং সিস্টেমেই সিনেমা দেখতে হবে। কোন সিনেমা কোন রেটিংয়ে যাবে, সেটার একটা প্রাথমিক প্রস্তাব আমরা দিয়ে রাখছি। গ্রেডিং নিয়ে যে নিউজটা হয়েছে, এটা আসলে একটা আংশিক নিউজ। এটা একটা প্রচারণামূলক খবর মনে হয়েছে। এখানে এ ক্যাটাগরি বলতে বোঝানো হয়েছে অ্যাডাল্ট ক্যাটাগরি। আসলে আমাদের এখনো বিধিমালাই তৈরি হয়নি। আমরা এখনো জানি না বলিউড বা হলিউড যেভাবে রেটিং করে, আমাদের রেটিং সিস্টেমটাও সে রকম হবে কিনা।’
আটকে থাকা সিনেমা বা নতুন সিনেমা মুক্তি দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৩ সালের অধীনে দুটি বিধি ১৯৮৫ ও ১৯৭৭। ১৯৭৭ বিধির ক্যাটাগরি আছে দুটি। একটি হলো রেস্টিকটেড আরেকটি আনরেস্টিকটেড। একটি সর্বসাধারণের জন্য ছাড়া যাবে, অন্যটি যাবে না। এ বিধির ওপরেই সেন্সর বোর্ড চলে। আমাদের কাছে ২০২৩-এর আইন অনুযায়ী যে রেটিং সিস্টেম আইন বিদ্যমান, তার কোনো বিধিমালা নেই। আমরা এ মুহূর্তে আইন অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের সেন্সর আইনের ১৯৭৭ বিধিটাকে অনুসরণ করতে পারি। সেক্ষেত্রে সিনেমাগুলো দেখে পর্যালোচনা করে ইউনিভার্সাল রেটিংয়ে ছাড়া যাবে। আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি, দ্রুত যেন রেটিং নির্দেশনা দেয়া হয়।’