ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় দেশভাগ

রাজনৈতিক কারণে নানা সময় বিভিন্ন দেশে ভাঙন লেগেছে। কোথাও দেয়াল উঠেছে, কোথাও পড়েছে কাঁটাতার।

রাজনৈতিক কারণে নানা সময় বিভিন্ন দেশে ভাঙন লেগেছে। কোথাও দেয়াল উঠেছে, কোথাও পড়েছে কাঁটাতার। তবে দেশভাগ নিয়ে বাংলা ও পাঞ্জাব যতটা দগ্ধ হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসেও তা বিরল। র‍্যাডক্লিফের আঁকা রেখায় হয়তো কোনো বাড়ির ওপর দিয়েই গেছে কাঁটাতার। এক পাশে পড়েছে হেঁশেল, অন্য পাশে উঠান। দাঙ্গার কথা বাদই রইল। মানুষের পাশাপাশি ভাগ হয়েছে অনেক কিছু। তাই দেশভাগ এখনো এক দগদগে ঘাঁ হয়ে আছে কাঁটাতারের দুপাশেই। দেশভাগ এসেছে সাহিত্যে, দেশভাগ এসেছে সিনেমায়। তবে ঋত্বিক ঘটকের মতো করে দেশভাগকে কেউ দেখাননি।

দেশভাগের বলি হয়ে পূর্ব বাংলা থেকে অনেক পরিবারই পশ্চিমবঙ্গে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময় তারা পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সাহিত্য ও সিনেমায় আমরা দেশভাগের নানা আলাপ পাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে আমরা দেশভাগের ছা্প পাই। সিনেমায় দেশভাগের নানা প্রভাব, উপাদান, স্মৃতি দেখিয়েছেন তরুণ মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনরা। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক তার সিনেমার মতো এখানেও আলাদা। তার সিনেমায় কখনো কখনো দেশভাগই হয়ে উঠেছে মূল বিষয়। মূলত দেশভাগ তাকে ভাবিয়েছে। দেশভাগ তার মধ্যে এমন একটা ক্ষত তৈরি করেছিল, যার যন্ত্রণা থেকে কোনোদিন মুক্তি পাননি ঋত্বিক।

আলাপের শুরুটা ঋত্বিকের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা দিয়েই করা যাক—মেঘে ঢাকা তারা। এ সিনেমায় আমরা যে পরিবারকে দেখি, তারা দেশভাগেরই বলি। বিজন ভট্টাচার্য অভিনীত তারন চরিত্রটিকে দেখলেই বোঝা যায়, নিজ দেশে সম্মানিত এক ব্যক্তি পরদেশে এসে দরমার বেড়া দেয়া ঘরে বসে পরিবারের আব্রু সামলাতে লাচার। আর নীতা সে পুরনো ‘গ্রেট মাদার আর্কিটাইপ’ যে সর্বংসহা হয়ে সংসার ধরে রাখে। সিনেমাটা মূলত সামাজিক-অর্থনৈতিক, কিন্তু এর পেছনে কাজ করেছে দেশভাগ। তারনের কথায় তার পূর্বনিবাসের কথা শোনা যায়। বোঝা যায় সে দেশ ছেড়ে এসেছে, নতুন দেশে তার ঘর হয়নি।

ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় দেশভাগ নিয়ে দেয়া অনেক বক্তব্যই যেন ঋত্বিকের নিজের কণ্ঠ থেকে এসেছে। নিজের সিনেমায় দেশভাগ প্রসঙ্গ নিয়ে ঋত্বিক বলেছেন, ‘আমি যে ক’টি ছবিই শেষের দিকে করেছি, কল্পনায় ও ভাবে বাংলাভাগ বিষয় থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমার সবচেয়ে যেটা জরুরি বলে বোধ হয়েছে সেটা এ বিভক্ত বাংলার জরাজীর্ণ চেহারাটাকে লোকচক্ষে উপস্থিত করা, বাঙালিকে নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন করে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা।’

ঋত্বিক কশাঘাত করতেন। সিনেমায় তিনি কখনো দেশভাগের পরের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখিয়েছেন, আবার কখনো দেখিয়েছেন দেশভাগের যন্ত্রণা। পূর্ববঙ্গ থেকে যাদের কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই এসেছিলেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু সে সময় রাজনীতি তাদের কখনো কখনো রঙের লোভ দেখিয়েছে। সে লোভে মজেছেও অনেকে। ঋত্বিক ঘটক তার ‘কোমলগান্ধার’ সিনেমায় এ নিয়ে একটা কশাঘাত করেছেন। সিনেমায় মঞ্চনাটক করে ভৃগু। তার একটি নাটক থাকে এ দেশভাগ নিয়ে। সেখানে দেখা যায়, এক বুড়োকে তার মেয়ে কলকাতায় যাওয়ার ব্যাপারে বলছে। কেননা সেটি সুন্দর শহর। দেশ পার করে যাওয়া মানুষকে সে শহরে নতুন নাম দেয়া হয়েছে—বাস্তুহারা শরণার্থী।

নাটকে দেখানো মেয়েটি জানেই না বাস্তুহারা শরণার্থী কাকে বলে। তবে কঠিন দুই শব্দে দেয়া নামটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হয়েছিল। সে কেবল কলকাতার আলো আর রোশনাইয়ের কথাই মাথায় রেখেছে। তা দেখেই বুড়ো লোকটি গুমরে মরে। পদ্মাপাড়ের মানুষ সে। নদী ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারে না। সে নদী ছেড়ে যখন যেতে হচ্ছে, নিজেকে তার অভাগা মনে হয়। লোকটি বলে ওঠে, ‘‌আমি একটা কপালপোড়া। আমার চৌদ্দ পুরুষ কপালপোড়া। যতগুলারে জন্ম দিছি সব কপালপোড়া। নাইলে আমি এ পদ্মার পাড়ে জন্মাইলাম কেন!’

মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমলগান্ধার (১৯৬১) ও সুবর্ণরেখা (১৯৬২); ঋত্বিকের এ তিন সিনেমা দেশভাগের কথা সরাসরি বলে। তিনটি সিনেমার প্রতিটিতেই স্পষ্ট করে দেশভাগের কথা বলা হয়েছে। কোমলগান্ধারে ভৃগু আর অনসূয়া যখন রেল লাইন পার করে গিয়ে কথা বলে, সেখানে দেশভাগের ছাপ রয়েছে। নাটকের দলের ভেতরকার টানাপড়েনের মধ্যেও কি নেই? কিংবা দেশভাগ তো কেবল দাঙ্গার মধ্যে থাকে না। সুবর্ণরেখার বাগদি বৌয়ের মৃত্যুর মধ্যে থাকে। শেষ মুহূর্তে অভিরাম যখন তার মাকে খুঁজে পায় মায়ের মৃত্যুশয্যায়, সে ঘটনার মধ্যে থাকে দেশভাগের ট্র্যাজেডি।

ঋত্বিক ঘটক কেবল তিনটি সিনেমায় দেশভাগের কথা বলেছেন এ কথা ভাবলে ভুল হবে। ঋত্বিকের সিনেমায় বরাবরই কলোনি, রিফিউজি সংকটের বিষয়গুলো এসেছে। এর পেছনে ছিল দেশভাগ। ১৯৫২ সালে নির্মিত নাগরিক মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৭ সালে। সে সিনেমার ভায়োলিন বাদকের চরিত্রটিও উদ্বাস্তু। তার ভায়োলিনের সুরও বারবার মনে করিয়ে দেয় যে দেশ হারিয়েছে সুর। ভায়োলিনের তার ছিঁড়ে যাওয়াকে কী বলা যায় তা পাঠক-দর্শকের হাতেই থাকল। তবে এটা বলাই যায়, নাগরিকের পুরো গল্পে আমরা দেখি মানুষের উচ্ছেদ, উৎখাত হওয়ার আখ্যান।

পার্টিশন নিয়ে বলিউডের সিনেমায় আমরা দেখি দাঙ্গা। বিশেষত এসব সিনেমায় পাঞ্জাবের কথা বেশি এসেছে। কিন্তু দেশভাগ মানে কেবল দাঙ্গাই নয়। উদ্বাস্তুদের জীবনের মধ্যেও আছে দেশভাগ। ঋত্বিক তার সিনেমায় সে জীবন দেখিয়েছেন। নীতার পরিবারে আমরা সে জীবন দেখি, ভৃগুর নাটকেও দেখি। সুবর্ণরেখায় কলোনির জীবন এসেছে মেঘে ঢাকা তারার চেয়ে স্পষ্ট করে।

এ সিনেমাগুলোয় দেশভাগের কথা তো আছেই, আরো স্পষ্ট করে আছে ঋত্বিকের আত্মজৈবনিক ‘‌যুক্তি তক্কো আর গপ্প’ সিনেমায়। দেশভাগের যন্ত্রণা ঋত্বিককে পোড়াত, এ সিনেমা থেকেই সে কথা প্রমাণ করা যায়। যুক্তি তক্কো আর গপ্প সিনেমায় ঋত্বিক নিজে অভিনয় করেছেন আর সেখানে নিজের কথা বলেছেন আরো স্পষ্ট করে। এ সিনেমায় শাঁওলী মিত্রের চরিত্রটির নামই বঙ্গবালা। এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঋত্বিক ঘটক মূলত শ্যামল বাংলাকে নারী রূপে প্রকাশ করেছেন। তাকে বাংলাদেশের আত্মা বলেই সম্বোধন করেছেন। তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও মনে হয়েছে ঋত্বিক বাংলাদেশকেই খোঁজার চেষ্টা করছেন।

ঋত্বিক রাজনীতি সচেতন ছিলেন। রাজনীতির মানুষ ছিলেন। পার্টি পলিটিকস থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তার বক্তব্য যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট ছিল দেশভাগ নিয়ে। পাশাপাশি সে বেদনা তার নিজের ভেতরে থাকায় সিনেমায় ফিরে এসেছিল বারবার।

আরও