জহির রায়হানের শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ততদিনে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই বাংলায় আইয়ুব খানের পতন ঘটে গেছে— নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের সেন্সর বোর্ড প্রাথমিকভাবে ছবিটি আটকে দেয়ার চেষ্টা করে। তবে পরিস্থিতি অন্যদিকে যেতে পারে ভেবে ছবিটি তৎকালীন সেন্সর বোর্ড সদস্যরা দেখেন এবং নির্মাতা ও প্রযোজককে বিনা কর্তনে সেন্সর করার সিদ্ধান্ত জানান। সেন্সর বোর্ড নামক অচলায়তনের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার এই দ্বৈরথের মধ্য দিয়েই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু হয়। অবিভক্ত পাকিস্তানে ‘জীবন থেকে নেয়া’-ই সম্ভবত ছিল সেন্সর নামের জগদ্দলের সঙ্গে লড়াই করা শেষ ছবি।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকে সেন্সর নিয়ে ফিল্মমেকারদের ঝামেলা বিষয়ে খুব একটা জানা যায় না। যদিও এ সময় ফিল্ম ক্লাব রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট (১৯৮০) প্রণয়নের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কার্যক্রমকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল সরকার। এই আইনের ফলে কোনো ছবি ফিল্ম সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কার্যক্রম চালাতে পারত না। তার চেয়েও বড় কথা, যেকোনো ছবি প্রদর্শনের আগে সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এমনকি ভারতের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ, ঋত্বিক বা মৃণাল সেনের ছবির বেলাতেও একই ধরনের অনুমোদন নিতে হতো। যতদূর জানি, ফিল্ম সোসাইটিগুলো সেন্সর ছাড়া এমন বিদেশী ছবি প্রদর্শন করে, যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে, এটাই ছিল সরকারি মহলে প্রচারণা। সেন্সরের এই বাধা নিয়ে কী করে ফিল্ম সোসাইটির কর্মীরা বিভিন্ন দূতাবাস আর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহযোগিতায় ৩৫ অথবা ১৬ মিমি. তে এসব ক্লাসিক ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন, আজকের তরুণ প্রজন্ম তা ভাবতেও পারবে না। সেন্সর বোর্ডের এসব বিধি-নিষেধ মাথায় নিয়েই তারকোভস্কি, গদার, ত্রুফো, ফেলিনি, আন্তোনিওনি থেকে অজু, কুরোশাওয়া, আদুর গোপাল কৃষ্ণান, অরবিন্দনসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতাদের ক্লাসিক সব ছবি আমাদের যৌবনে দেখা হয়েছে।
এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে ফিল্ম সেন্সর নিয়ে সরকারের ঝামেলা শুরু হলো, যখন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের তখনকার তরুণ কর্মী মোরশেদুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে ‘আগামী’ নামে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নিজের উদ্যোগে নির্মাণ করে ফেললেন। তখনকার সেন্সর বোর্ডের কাছে ‘রাজাকার’ ‘হানাদার’ এই শব্দগুলো আপত্তিকর মনে হওয়ায় ছবিটি আটকে দেয় সেন্সর বোর্ড। যদিও পরে তা ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর গোটা এরশাদের শাসনামল জুড়েই স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে সেন্সর বোর্ডের নানা ঝামেলা চলতে থাকে।
‘৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিএনপি সরকারের সময়ও ব্যতিক্রমী কিছু হয়নি। বরং এ সময় তৎকালীন সরকারের কোপানলে পড়ে ‘একাত্তরের যীশু’, ‘নদীর নাম মধুমতী’ এমনকি ‘মুক্তির গান’ এর মতো ছবিও সেন্সরে আটকে যায়। নির্মাতারা নানা হয়রানির শিকার হন। কেউ কেউ ছবি মুক্তির জন্য আদালতেও দৌড়াতে বাধ্য হন। সেন্সর জটিলতায় পড়ে কোন কোন ছবি বছরের পর বছর মুক্তির অপেক্ষায় আটকে থেকেছে সে সময়। নির্মাতাকে কখনো সেন্সর বোর্ডে, কখনো মন্ত্রণালয়ে আবার কখনো আদালতেও সময় কাটাতে হয়েছে ছবি মুক্তির জন্য।
আরো পড়ুন— জাতীয় ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও প্রাতিষ্ঠানিক সিনেমা শিক্ষার অবস্থা
সে সময় একদিকে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেছেন নিয়ম করে; আবার একই সেন্সর বোর্ডের আইন কানুনের ফাঁক গলেই নব্বই দশকের শেষ দিকে বাণিজ্যিক ছবিতে কাটপিস প্রবেশ করে। সিনেমা হলে তখন নিয়মিতই প্রদর্শিত হতো এসব কাটপিস। যেকোনো ছবির মাঝখানে বা কোনো দৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত এসব অশ্লীল দৃশ্যাবলি। দেশের মূলধারার গোটা সিনেমা জগতের এই হাল দেখার ও নজরদারির বা তা বন্ধ করার ক্ষমতা সে সময় সেন্সর বোর্ডের ছিল না। এখনো যে খুব একটা আছে, তা কিন্তু নয়। কারণ, যে নগণ্য সংখ্যক পরিদর্শক এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান, তাদের পক্ষে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই নজরদারি করা সম্ভব নয়।
সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এই দ্বন্দ্ব একবিংশ শতকেও অব্যাহত থাকে। ২০০৮ সালে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এনামুল করিম নির্ঝরের ছবি ‘নমুনা’ গেল ১৫ বছর আটকে আছে সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়ায়।
আরো পড়ুন— এফডিসি সংস্কার করে ফিল্ম কাউন্সিলে রূপান্তর নয় কেন?
এরপর, আওয়ামী লীগের পনের বছরে তো অবস্থা আরো করুণ হয়েছে। এ সময় সেন্সর ছাড়পত্র না পাওয়া কয়েকটি ছবির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত ‘শনিবার বিকেল’ আটকে আছে ২০১৭ থেকে। আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা অং রাখাইনের ছবি ‘মাই বাইসাইকেল’ ২০১৫ সালে সেন্সরের জন্য জমা দিলেও ছাড়পত্র মেলেনি এখনো। এছাড়া সম্প্রতি রায়হান রাফি নির্মিত ওয়েব ফিল্ম ‘অমীমাংসিত’ প্রদর্শন উপযোগী নয়— এই যুক্তি দেখিয়ে আটকে দেয় সেন্সর বোর্ড । এ ছাড়া আরো একাধিক ছবি সেন্সর ছাড়পত্র না মেলায় এখনো প্রদর্শিত হতে পারছে না।
কেবল এই ছবিগুলোই নয়, আমার জানা মতে আরো একাধিক নির্মাতা তাদের ছবি নিয়ে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছেন। নানা কারণ দেখিয়ে তাদের ছবি আটকে দেয়া হয়েছে,পরে দীর্ঘ সময় দেন দরবার করে নিজেদের ছবি ছাড় করেছেন এসব নির্মাতারা।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সেন্সর সংক্রান্ত এ জাতীয় ইস্যুতে অতীতে নানা সময়ে নানা সংগঠনের উদ্যোগে আন্দোলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেয়ার মতো কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ জাতীয় কর্মসূচি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নানা সংগঠন পালন করে রহস্যজনক নীরবতা। তাদের অবস্থা যেন ছিল অনেকটা রস খেয়ে বশ হয়ে থাকার মতো। নিকেতন, শাহবাগ বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত এই সংগঠনগুলো। শোনা যায়, কোন নির্মাতা কোন দলের লোক, বা পাড়ার— সে নিয়ে তর্কে মেতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেন্সর নিয়ে বলিষ্ঠ কোনো প্রতিবাদ জানাতে তারা ব্যর্থ হন।
আরো পড়ুন— রাষ্ট্রীয় অনুদানে ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, চাই প্রক্রিয়ার সংস্কার
ফলে, গেল ১৫ বছরে সামরিক-বেসামরিক নানা ধরনের আমলাতন্ত্র সিনেমার সেন্সর ব্যবস্থায় সামনে বা পেছন থেকে কল কাঠি নেড়েছে। কোনো ছবি পছন্দ না হলেই বা ছবিতে ভিন্ন কিছু দেখলেই নিজেদের ইচ্ছেমতো সার্বভৌমত্ব, জন-নিরাপত্তা ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে আটকে দেয়া হয়েছে এসব ছবি। উল্লিখিত ছবিগুলো আটকে থাকার এটাই প্রধান কারণ।
রাষ্ট্রের এই ঔপনিবেশিক জাল ছিন্ন করে সিনেমার সেন্সর ব্যবস্থাকে আরো নির্মাতাবান্ধব করে তোলার সময় এসেছে এখন। সেই লক্ষ্যেই বাংলাদেশে সিনেমার সেন্সর ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কিছু সুপারিশ করা গেল—
এক. সিনেমায় সেন্সরের মূল ভাবনাটি হতে হবে— শৈল্পিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
দুই. সেন্সর ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য অবিলম্বে আইনের মাধ্যমে গ্রেডেশন সিস্টেম চালু করা; পাশাপাশি এই আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার, ২০২৩ সালে প্রণীত গ্রেডেশন আইনটি ত্রুটিপূর্ণ এবং আরেকটি আমলা শাসিত সেন্সর ব্যবস্থা তৈরির প্রয়াস। তা অবশ্যই বাদ দিয়ে মাধ্যম সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় নতুন গ্রেডেশন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
তিন. গ্রেডেশন প্রদানের জন্য কমিটি করে তাতে আমলার সংখ্যা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হবে এবং একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র নির্মাতা বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে এই কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনীত করতে হবে। কমিটির অধিকাংশ সদস্যই চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকে নিতে হবে।
চার. যেকোনো চলচ্চিত্র সেন্সরের বিষয়ে সদস্যদের মতভিন্নতা তৈরি হলে তা আপিল কমিটিতে পাঠানো যেতে পারে। আপিল কমিটির সদস্য সংখ্যাও তিনজনের বেশি হওয়া উচিত নয়।
পাঁচ. বাণিজ্যিক ও স্বাধীন ধারার ছবির গ্রেডেশন যেমন ভিন্ন ভিন্ন হবে, তেমনি, সেন্সর ফিও ভিন্ন হবে। প্রামাণ্য এবং নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রও স্বাধীন ধারার মতোই হবে। এক্ষেত্রে স্বাধীন ধারার ছবির জন্য ফি ন্যূনতম কত হতে পারে, তা এ জাতীয় সংগঠন বা স্বনাম খ্যাত নির্মাতাদের সঙ্গে আলাপ করে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে; আর বর্তমানে প্রচলিত স্ক্রিনিং ফি অবশ্যই বাদ দিতে হবে।
ছয়. সেন্সর ব্যবস্থায় স্বাধীন চলচ্চির নির্মাতাদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে নজরদারি বৃদ্ধি করতে নতুন প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়োগ দিতে হবে।
সাত. দেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা এ জাতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনকে অবাণিজ্যিক ঘোষণা করে, এ ধরনের আয়োজনে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রসমূহকে সেন্সর ব্যবস্থার বাইরে রাখতে হবে।
এ কথা বলতেই হবে যে, রাষ্ট্রের সঙ্গে ফিল্মমেকার শুধু নয়, যেকোনো শিল্পীরই লড়াই চিরন্তন। ইরানসহ আরো কিছু দেশে চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিগৃহীত হন, এটা অনেক কাল ধরেই হচ্ছে, অনেকে এমন ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু যে পশ্চিমা দুনিয়া শিল্পীর স্বাধীনতার এত বড়াই করে থাকে, তারাই এখন বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে নিজেদের মতের বিরুদ্ধে কিছু হলে, তা বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। ইসরাইলের সমালোচনা করা বা প্যালেস্টাইনের পক্ষ নেয়া যে কেউ এ জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যান্টি সেমেটিক আখ্যায়িত হচ্ছেন ইদানিং। এসব দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারাও সামনের দিনে যে সেন্সর জটিলতায় পড়বেন না, সে কথা কেউ বলতে পারে না। তাই আমাদের পথ আমাদের খুঁজে নিতে হবে। আর শিল্পীদের স্বাধীনতাকে মূল প্রতিপাদ্য ধরে তবেই ফিল্মের সেন্সর কাঠামোর কথা ভাবতে হবে। রাষ্ট্রের বেড়াজালে তথাকথিত নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদির কথা বলে একজন নির্মাতাকে আটকানো যাবে না। কারণ, শিল্পী নয়, যুদ্ধ আর মারণাস্ত্র ব্যবসার চূড়ান্ত রমরমার এই যুগে রাষ্ট্রই সব স্বাধীনতা কেড়ে নেবার আয়োজন করেছে। পশ্চিম থেকে দক্ষিণ— দুনিয়ার সব দেশে আজ একই অবস্থা।