একটা প্রচলিত বিতর্ক আছে, শিল্প কেবল শিল্পের জন্য নাকি সমাজ ও মানুষের প্রতি শিল্প ও শিল্পীর দায় আছে? এ বিতর্ক চলছে বহু আগে থেকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সমাজের চলতি নানা সংকট এমনকি সামাজিক পরিস্থিতিতে শিল্পীরা দায়িত্বশীল আচরণ করেন। যেমন সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতেই দেখা গেল অভিনেতা-অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পীরা এগিয়ে গেছেন বন্যার্তদের সাহায্যে। কেউ নিজে গেছেন ত্রাণ নিয়ে, কেউ তহবিল সংগ্রহ করেছেন, কেউ সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বিপরীত চিত্রও আছে। ভাইরাল হওয়া হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চ্যাটে দেখা গেল, গণ-আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রদের ওপর গরম পানি ঢালতে বলা হচ্ছে, তাদের মারতে বলা হচ্ছে। এ সবই বলেছেন ‘শিল্পী’রা।
প্রশ্ন হলো শিল্প বা শিল্পীর আদৌ এসব ক্ষেত্রে কোনো দায় আছে কি? সহজ করে বা একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, শিল্পের কোনো দায় নেই। কেননা শিল্প নিজে থেকে কিছু করে না। শিল্প বিমূর্ত, তাকে মূর্ত করেন শিল্পী। শিল্পের মাধ্যমে শিল্পী হয়ে ওঠেন সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সমাজের মানুষই তাকে নতুন পরিচয় দেয়, তাকে তুলে ধরে। ফলে স্বাভাবিকভাগেই সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি তাদের দায় থাকে। সে দায় থেকেই শিল্পীরা নানা সময় সমাজ ও মানুষের জন্য কথা বলেন। মূলত সমাজ যখন তাকে স্বীকৃতি দেয়, সমাজের প্রতি তার এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। কেউ সেটা পালন করে, কেউ করে না।
ভারতে কিছুদিন আগে আরজি কর হাসপাতালে একজন ডাক্তারকে ধর্ষণের পর হত্যা করার ঘটনায় পুরো পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়েছিল, আছে এখনো। এ ঘটনার পর টালিগঞ্জের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখা গেছে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া। কেউ সরাসরি এর প্রতিবাদ করেছেন, কেউ আরজি কর, ধর্ষণ, বিচারের দাবি উল্লেখ না করে আকারে ইঙ্গিতে কিছু বলেছেন আবার কেউ একদমই বলেননি। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। এখানে প্রশ্ন, শিল্পীদের এ নীরবতা বা এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কী?
মমতা ব্যানার্জি ও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে প্রায় সবই ক্ষমতার চর্চা। অভিনেতারা অভিনয়ের চেয়ে বেশি মনোযোগী রাজনীতিতে। তাদের বহু জনপ্রিয় শিল্পী গত কয়েক বছরে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। কেউ হয়েছেন এমএলএ। ফলে সরকার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ তাদের নেই। ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে চান তারা। ক্ষমতার চর্চা করতে চান। ফলে ক্ষমতার বিরাগভাজন হতে চান না।
বাংলাদেশেও ঘটেছে একই ঘটনা। আলোচ্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কাণ্ডের মূল কারণ ক্ষমতার সুবিধাভোগী হওয়া ও হওয়ার চেষ্টা করা। গরম পানি ঢালতে বলা অরুণা কিংবা গ্রুপে থাকা অন্য সবাই ছিলেন সরকারের সুবিধাভোগী। ছিলেন সরকারের সবচেয়ে নতুন এমপি, অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ। তারা চেয়েছিলেন আন্দোলনের বিপক্ষে, সরকারের পক্ষে থেকে নিজেদের লাভালাভ নিশ্চিত করা।
কিন্তু শিল্পীদের চরিত্র এমন ছিল না। বিশেষত এ অঞ্চলের শিল্পীদের। প্রথমেই নাম করা যাক জহির রায়হানের। প্রতিবাদের কী অসাধারণ নিদর্শন তিনি রেখেছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’তে। মানুষের কথা লিখে রাখতে নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। আমজাদ হোসেনও ছিলেন সময়ের কণ্ঠস্বর। এ সময় আশফাক নিপুন রাষ্ট্রের বিধিনিষেধের মধ্যেও নির্মাণ করেছেন ‘মহানগর’, ‘সাবরিনা’র মতো সিরিজ। চলতি ইস্যুকে নির্দেশ করে নাটক, সিরিজ নির্মাণ করেছেন আরো অনেকে। ফুল, পাখি, লতা, পাতায় আটকে থাকেননি তারা। বরং সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশই করোনার পর বেশি রাজনীতি সচেতন কনটেন্ট নির্মাণ করেছে।
শিল্পের কোনো দায় নেই। কিন্তু শিল্পী যখন গুরুত্বপূর্ণ ও শিল্প একটা বড় মাধ্যম হয় মানুষকে প্রভাবিত করার, তখন শিল্পও দায়বদ্ধ হয়। কখনো শিল্পীরাই করেন। কেননা সিনেমার মধ্য দিয়ে সিস্টেমকে কষাঘাত করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এমনকি সত্যজিৎ রায়। মৃণাল স্পষ্টই বলেছেন, সিনেমাকে তিনি করেছেন হাতিয়ার। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিছু গানের ভূমিকা ছিল আরো বেশি। বলশেভিক বিপ্লবে কৃষকের গান থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান নিয়ে এখনো আলোচনা হয়। এমনকি চব্বিশের আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকায় এসেছিল রÅvপ। কারারুদ্ধ হয়েছিলেন রÅvপার হাসান আলী। সেসব বাধা ডিঙিয়ে প্রতিদিন কার্টুন এঁকেছেন, কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন শিল্পীরা।
রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান সবসময়ই খড়্গহস্ত। শিল্পীকে সবসময় দাঁড়াতে হয় তার বিরুদ্ধে। তিনি যদি কেবল আনন্দ দেয়ার জন্য শিল্প করেন তাতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু ক্ষমতা, বিশেষত গণহত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি তোষণ শিল্পীর কাজ নয়। অবশ্য নানা সময় পৃথিবীর বহু শিল্পী ফ্যাসিজম, যুদ্ধ ও হত্যার পক্ষে ছিলেন। পিটার হান্ডকেকে নিয়ে কিছুদিন আগেও হয়েছিল বিতর্ক।
বিক্ষুব্ধ সময়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন একজন শিল্পী, কিন্তু হত্যা ও দমনের প্ররোচনা দিলে তিনি সমালোচিত হবেনই। তবে এ কথা নিশ্চিত, তারা মনে করেন না তাদের কোনো দায় আছে সমাজের প্রতি। কেননা তারা নিজেদের করেছেন ক্ষমতার দোসর, তাদের শিল্পও মানুষের জন্য নয়।