গোয়েন্দা: বাংলা সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে

সাহিত্যের নানা ঘরানার মাঝে ‘গোয়েন্দা গল্প’ নতুন কিছু নয়। এর ইতিহাস বহু প্রাচীন। জিকে চ্যাস্টারটন বা তারও আগে এডগার অ্যালান পো লিখেছিলেন গোয়েন্দা গল্প।

বাংলা সাহিত্যে বহু গোয়েন্দা চরিত্র আছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নিয়ে সিনেমা, সিরিজ তৈরি করছেন নির্মাতারা। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশে জনপ্রিয়ও হচ্ছে খুব। বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের বইয়ের পাতা থেকে চলচ্চিত্রে আসা এবং সেসব চলচ্চিত্র চরিত্রদের নিয়ে আয়োজন প্রকাশ হবে পাঁচ পর্বে। আজ প্রথম পর্ব

সাহিত্যের নানা ঘরানার মাঝেগোয়েন্দা গল্প নতুন কিছু নয়। এর ইতিহাস বহু প্রাচীন। জিকে চ্যাস্টারটন বা তারও আগে এডগার অ্যালান পো লিখেছিলেন গোয়েন্দা গল্প। আসলে এদের আগেও রহস্য গল্প লেখা হতো। কিন্তু বর্তমানে যা গোয়েন্দা গল্প বলে প্রচলিত, এসব গল্প তেমন ছিল না। একটা সময় সে রহস্য সমাধান নিয়ে যখন গল্প লেখার কথা চিন্তায় আসে, তখনই গোয়েন্দা গল্প সৃষ্টি হয়। আর গোয়েন্দা গল্পের আধুনিক যে ধারণা, সে অনুসারে বিচার করলে অ্যালান পো হলেন প্রথম সার্থক গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। এরপর স্বাভাবিকভাবেই তা আসে সিনেমায়। তবে সিনেমার আগে একটু বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের দিকে তাকানো প্রয়োজন।

পশ্চিমের সাহিত্যের হাওয়া পুবে এসে ঝাপটা দিতে বেশি সময় লাগেনি। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনেও গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছিল, তবে তা নিজেদের মতো করে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গল্প লেখা হলেও তা আজকের দিনেরগোয়েন্দা গল্প সঙ্গে মিলবে না। বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ গল্প বা গোয়েন্দা সাহিত্য শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এর মধ্যে মোটামুটিভাবে সার্থক গোয়েন্দা গল্পকার বলা যায় প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ১৮৯২ সালে প্রকাশ করেন তদন্তভিত্তিক বইদারোগার দপ্তর যদিও বরকতউল্লাহ্ খাঁ নামে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার স্মৃতি থেকে লেখা নিজের তদন্তভিত্তিক বইবাঁকাউল্লাহ্ দপ্তরকে অনেকে প্রিয়নাথেরদারোগার দপ্তর-এর পূর্বে প্রকাশিত বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বইটির প্রকাশকাল সম্পর্কে কিছু ধোঁয়াশা রয়ে যাওয়ায় সেটিকেপ্রথম বলা যায়নি।

পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দা বা রহস্য সমাধানমূলক গল্প বা সাহিত্যের ধারায় স্রোত জুগিয়েছেন পাঁচকড়ি দে। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় সাহিত্য মান তুলনামূলক কম ছিল। সে পিছিয়ে থাকা জায়গা ভরাট করেন পাঁচকড়ি। তাকেই বাংলা মৌলিক গোয়েন্দা গল্পের প্রথম লেখক ধরা হয়। মজার ব্যাপার হলো তার দুই গোয়েন্দা চরিত্র অরিন্দম বসু আর দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র ছিলেন দাদাশ্বশুর-নাতজামাই। উল্লেখ্য, পাঁচকড়ি দের গল্পগুলো অনেকটাই পশ্চিমা রহস্য গল্পের আদলে লেখা। এছাড়া প্রিয়নাথ পাঁচকড়ি উভয়ের গল্পগুলোয় কিছু অতি নাটকীয়তার ছাপও বিদ্যমান। কিন্তু সময় গোয়েন্দা গল্পের চাহিদা এত বেড়ে যায় যে অনেকেই লিখতে শুরু করেন এবং তৎকালীন মাসিক, সাময়িক পত্রিকা প্রচুর পরিমাণে গোয়েন্দা গল্প ছাপতে শুরু করে।

সেদিন যে স্রোত তৈরি হয়েছিল সে স্রোতে একে একে লেখা হয়েছে অনেক গল্প। তৈরি হয়েছে অনেক চরিত্র। কাগজে ছাপা অক্ষর থেকে সেসব এসেছে কমিক বইয়ে, তারপর সিনেমায়। এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা হিসেবে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন সত্যজিৎ রায়েরফেলুদা আট থেকে আশি সবাই উপভোগ করে সত্যজিৎ রায়ের গল্পগুলো। এর অন্যতম কারণ সত্যজিৎ ফেলুদাকে এঁকেছেন এমন করে যে ফেলুদাকে আমাদের ঠিক একজন আদর্শ বড় ভাই মনে হয়। সে যেন আমাদের অনেক আপন। তা বাদ দিয়ে সত্যজিতের তৈরি গল্পগুলোর বড় গুণ এতে কোনোফাঁক (প্লট হোল) নেই বা থাকলেও কম। গল্প, চরিত্র, রহস্য সব ক্ষেত্রেই তারডিটেইলিং চমৎকার। বাংলা সিনেমায়ও তিনি অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা। অন্তত যত দিন না শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়েরব্যোমকেশকে নতুন করে চিনেছে সবাই।

সত্যজিতের আগে-পরে আরো অনেকে গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। হেমেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন প্রচুর। তারবিমল-কুমার, ‘জয়ন্ত-মানিক, ‘সুন্দরবাবু, ‘হেমন্ত-রবিন, ‘ইন্সপেক্টর সতীশ-হেমেন বাবুর মতো এত গোয়েন্দা চরিত্র কেউ সৃষ্টি করেননি। শিব্রামের আছে কল্কেকাশি। একসময় রবিন হুডের আদলে তৈরি চরিত্রদস্যু মোহন নিয়ে লিখেছেন শশধর দত্ত। একই রকম লিখেছেন আমাদের দেশে রোমেনা আফাজদস্যু বনহুর নাম নিতে শুরু করলে অনেক নামই চলে আসবে। তবে সুনীলেরকাকাবাবু, সমরেশেরঅর্জুন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজেরকর্নেল নীলাদ্রি সরকার, সমরেশ বসুরগোগোল অশোক ঠাকুর পরিচিত।

তুলনামূলক অপরিচিত বা কম পঠিত গোয়েন্দা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রর পরাশর বর্মা। নিজে প্রেমেন্দ্র কবি, তিনি তার গোয়েন্দা পরাশরকেও প্রথমত কবি হিসেবে দেখিয়েছেন। কবিদের গোয়েন্দা কাহিনী লেখার বিষয়টা কিছু হলেও অদ্ভুত। কেননা কবিতা নরম মনের মানুষ হবেন বলেই মনে হয়। কিন্তু খুন জখমের গল্প তাদের কীভাবে আসে? সেখানে প্রেমেন্দ্র এনেছেন পরাশর বর্মাকে আর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন ভাদুড়ী মশাইকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে। অন্যদিকে আরেক অদ্ভুত গোয়েন্দা হলেন কিকিরা। কিংকর কিশোর রায় নামের গোয়েন্দা নিজেকে ম্যাজিশিয়ান দাবি করে। চরিত্রের স্রষ্টা বিমল কর।

নারী গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রথমে আসে কিংবা সবচেয়ে সার্থক বলা চলে মিতিন মাসীকে। প্রজ্ঞা পারমিতা ভালো নামের মিতিন কাজ করে তার বোনঝি টুপুরকে সঙ্গে নিয়ে। নারী স্বাধীনতা, নারীবাদ নয়, বরং নারী যে ঘর সামলেও বনের মোষ তাড়াতে পারে এমনকি করতে পারে ঝানু অপরাধীদের শায়েস্তা, তা দেখিয়েছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। প্রভাবতী দেবীর কৃষ্ণাও একজন নারী গোয়েন্দা, তবে বর্তমানে স্বল্প পঠিত। মনোজ সেন লিখেছেন দময়ন্তীকে নিয়ে।

এতক্ষণ যদিও যেসব চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি, তা পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক। আমাদের দেশেও গোয়েন্দা চরিত্র কম নেই। হুমায়ূন আহমেদেরমিসির আলি, ফরিদুর রেজা সাগরেরছোটকাকু, কাজী আনোয়ার হোসেনেররানা আর রকিব হাসানেরতিন গোয়েন্দা সবচেয়ে জনপ্রিয়। বাতিঘর প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হওয়ার পর থ্রিলারের যে জোয়ার এসেছিল আমাদের দেশে, সেখান থেকে তৈরি হয়েছে বেশকিছু চরিত্র। এর মধ্যে নাজিম উদ্দিনেরবেগ-বাস্টার্ড সিরিজ জনপ্রিয়।

লেখার পর্যন্ত যতজন গোয়েন্দা, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, সত্যান্বেষী বা ডিটেকটিভের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অনেককে নিয়েই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্র বলতে কেবল ফিটার ফিল্ম নয়, টেলিভিশন নাটক, টেলিফিল্ম, টিভি সিরিজ ওয়েব সিরিজকেও ধর্তব্যে নেয়া হয়েছে। গত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে চলচ্চিত্রে গোয়েন্দাদের, বিশেষত সাহিত্যের আগমন। শতকের শুরু দ্বিতীয় দশকে রুপালি পর্দা থেকে তারা এসেছেন ওটিটিতেও। নির্মাণ হয়েছে বহু সিনেমা, সিরিজ এবং পাইপলাইনে আছে আরো।

আরও