সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখে সবাই

মানুষের ইতিহাস সংগ্রামের। তারা প্রতিদিন নিজেদের অবস্থা উন্নত করার সংগ্রাম করে। সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হতো না, কিন্তু প্রয়োজনের কারণ তারা শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাত ধরে।

মানুষের ইতিহাস সংগ্রামের। তারা প্রতিদিন নিজেদের অবস্থা উন্নত করার সংগ্রাম করে। সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হতো না, কিন্তু প্রয়োজনের কারণ তারা শোষিত হয় ক্ষমতাবানদের হাত ধরে। আমাদের দেশে এ শোষণের ইতিহাস পুরনো। সে সামন্তরাজাদের আমল থেকেই শোষিত হয়েছে প্রান্তিক মানুষ। তা আমাদের ইতিহাসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সেন রাজা, সুলতানি আমল, মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান—কখন শোষিত হয়নি মানুষ? তবে শোষণ কেবল বঙ্গীয় ব-দ্বীপেই হয়েছে এমন নয়। হয়েছে আফ্রিকায়, আমেরিকায়, ইউরোপেও। সিনেমাও হয়েছে সেসব নিয়ে। ‘লা মিজারেবল’, ‘লিংকন’, ‘টুয়েলভ ইয়ারস আ স্লেভ’-এ সেসবের প্রমাণ আছে। ভারতের ইন্ডাস্ট্রিতেও এমন সিনেমা নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন পা রঞ্জিতের ‘থাঙ্গালান’।

সিনেমার সময়কাল উনিশ শতক। আরো স্পষ্ট করে বললে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ। স্থান উত্তর আর্কটের গ্রাম ভেপুর। সেখানকার মানুষ থাঙ্গালান একজন সাধারণ চাষী। স্ত্রী, সন্তান আর দাদিকে নিয়ে তার সংসার। স্বাভাবিকভাবেই প্রান্তিক এসব মানুষ শোষিত। তারা যে কাজ করে তার সঠিক মজুরি পায় না। বসবাস কুঁড়েঘরে। পোশাকের ক্ষেত্রেও তারা অনেক পিছিয়ে। পুরুষরা পরে লেঙ্গট আর নারীরা কোনোমতে একটা দশহাতি মতো কাপড় জড়ায় শরীরে। শিক্ষা তো দূরের কথা। এ গ্রামের প্রধান আর দশজন শোষক জমিদারের মতো। নানা অজুহাতে সে দখল করে কৃষকের জমি। সিনেমায় দেখা যায়, থাঙ্গালানের জমির ফসলে আগুন লাগায় প্রধানের পাইকরা। তার পরই বকেয়ার অজুহাতে দখল করে জমি। ‌এখানেই শেষ নয়, পরিবারসহ তাকে গোলাম করে নেয়া হয়।

কিন্তু থাঙ্গালানের ইতিহাস অন্য রকম। সে গল্প বলতে পছন্দ করে, পূর্বপুরুষের গল্প। তার পরদাদা কাড়িয়া পোনার নদী থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করতে পারত। শুধু তাই নয়, দূরের পাহাড় থেকে এক মায়াবী জাদুকরের সঙ্গে লড়াই করে রাজার জন্য স্বর্ণখনি উন্মোচন করেছিল সে। থাঙ্গালান এ গল্প বলে চলে তার সন্তানদের। মজার ব্যাপার, একদিন এক ব্রিটিশ এসে তাদের কাছেই দাবি করে স্বর্ণ উত্তোলনে সাহায্য করার। অন্য কেউ রাজি না হলেও থাঙ্গালান তাদের সঙ্গে যায়। কেননা সে বিশ্বাস করে পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারে। সেই সঙ্গে থাঙ্গা জানে, তার উত্তরপুরুষের উন্নতির জন্য স্বর্ণ প্রয়োজন।

পা রঞ্জিত তার সিনেমার নিজস্ব ধারার জন্য বিখ্যাত। তামিলে পরিচালিত থাঙ্গালানের আগে নির্মাণ করেছেন সাতটি ফিচার ফিল্ম। এর মধ্যে ‘মাদ্রাজ’, ‘কালা’, ‘কাবালি’ ও ‘সারপাট্টা পারাম্বারাই’ বক্স অফিসে ভালো করেছে। কিন্তু থাঙ্গালান পারেনি। ১৫০ কোটি রুপিতে নির্মিত সিনেমাটি প্রায় ৫০ কোটি রুপি ক্ষতির মুখে আছে। সিনেমা হিসেবে এতেও পা রঞ্জিতের সিগনেচার উপস্থিত। তবে তিনি এ সিনেমায় একটি জনপদ ও জাতির ইতিহাসের পাশাপাশি তাদের লড়াকু মনোভাবের কথা তুলে ধরেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরাণ, জাদু ও জাদুবাস্তবতা।

কাড়িয়ার সঙ্গে পুরনো রাজার স্বর্ণ সন্ধানের অংশে আমরা দেখি স্বর্ণের ঢিবি পাহারা দেয় আরতি নামের এক জাদুকরী। তিনি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। স্বর্ণ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। কিন্তু কাড়িয়া তার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে। আরতির রক্তে রঞ্জিত পুরো ভূমিই স্বর্ণে পরিণত হয়।

উনিশ শতকে থাঙ্গালান যখন স্বর্ণের খোঁজে যায়, তার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটে। পা রঞ্জিত তার সিনেমায় দেখান মানুষের বিশ্বাসের রূপ। থাঙ্গালানের স্ত্রী গেনগামাল বিশ্বাস করে না যে আসলেও স্বর্ণ আছে। কিন্তু বিশ্বাস করে তা তুলতে গেলে অশরীরী কিংবা নিয়তির অভিশাপে পড়বে তারা। অভিযান বা ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে সে গোলামি করে পেটেভাতে থাকতেই ভালোবাসে। এ চরিত্র প্রান্তিক মানুষের বহুকালের। তা থাঙ্গালান ভাঙতে চায়।

সিনেমায় বিক্রম অভিনয় করেছেন নাম চরিত্রে। তিনিই থাঙ্গালান। ড্যাশিং এ অভিনেতা নিজের ওজন কমিয়েছেন, জটা আর দাঁড়িতে অভিনয় করেছেন লেঙ্গট পরে। পার্বতী থিরুবথু গেনগামাল চরিত্রে। তাকে পার্বতী বলে চেনাই যায়নি। মনে হয়েছে সত্যিই তিনি আর্কটের গ্রামের এক প্রান্তিক নারী। এ সিনেমায় সাপোর্টিং কাস্টের খুব একটা কাজ ছিল না। তবে থাঙ্গালানের ছেলের চরিত্রে যে অভিনেতা, তিনি জাদুর প্রভাবে থাকা অংশটি দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া আরতি চরিত্রে মালবিকা মোহনও দুর্দান্ত। মনসা কিংবা ধ্বংসের যেকোনো দেবীকে স্মরণ করান তিনি।

‘থাঙ্গালান’-এর শাব্দিক অর্থ ‘স্বর্ণের সন্তান’। কিন্তু এমন নাম কেন, তারও জবাব আছে সিনেমার শেষে। থাঙ্গালান স্বর্ণেরই সন্তান। সে বা তার পূর্বপুরুষই কেন স্বর্ণের কাছে যেতে পারে, তার জবাব পা রঞ্জিত দেন ক্লাইম্যাক্সে। সেখানে আবার আসে পুরাণ কিংবা মানুষের ইতিহাসের অতি পুরনো অধ্যায়। পশুর চামড়া পরা মানুষকেও তিনি নিয়ে আসেন। 

গল্পটা সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু বিক্রমের বেশ, আরতির রোষ আর নাগা জাতির আলাপ যেভাবে এনেছেন রঞ্জিত, তা সব দর্শকের পছন্দ হয়নি। কিন্তু সিনেমাটি মন দিয়ে দেখলে গল্প ও অভিনয়ের জন্য ভালো লাগতে পারে অনেকেরই। একটু ভিন্ন ধারার গল্প রেখে গেলেন রঞ্জিত। সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখালেন।

আরও