যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের এক মরুভূমিতে পারমাণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটল। তারিখ ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে। ১৯৪২-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কঠোর গোপনীয়তায় পরিচালিত ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ থেকে আবিষ্কৃত হলো পারমাণবিক বোমা। এর জনক হিসেবে পরিচিতি পেলেন পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। ওপেনহাইমার স্রেফ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার খাতিরেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেশায় মেতেছিলেন, পরবর্তী ধ্বংসাত্মক ঘটনাক্রম সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই। কিংবা হয়তো তিনি জানতেন, কিন্তু আমলে নেননি। বাস্তবে মানবজাতির ওপর ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে তিনি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। চরম অনুশোচনা গ্রাস করে তাকে। তখন তার অবস্থা হয় গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের মতো, অবিনশ্বর দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনে নশ্বর মনুষ্যজাতিকে উপহার দেয়ার অপরাধে যিনি শাস্তি ভোগ করছেন; ভোগ করে যাবেন অনন্তকাল। ওপেনহাইমারকেও আমৃত্যু তার এ অনুশোচনার ভার বহন করতে হয়েছে। তার তৈরি যে আগুনে মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের বীভৎসতম তাণ্ডবলীলা, সে আগুনে প্রতিনিয়ত নিজের ভেতরে নিজে পুড়ে ছারখার হয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন প্রমিথিউসের সার্থক রূপক। আর তাই প্রমিথিউসের গল্পটি বলার মাধ্যমেই শুরু হয় ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি। বিজ্ঞান ও মানবিকতার টানাপড়েনের জায়গাটি এ সিনেমায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন হলিউডের অন্যতম সেরা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। কাই বার্ড ও মার্টিন শেরউইন রচিত রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবনী ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’-এর ভিত্তিতে নোলান নিজেই সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন।
ওপেনহাইমার সিনেমার গল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হলেও সমসাময়িক ঘটনাবলি এখানে গৌণ। সিনেমার গল্প আবর্তিত হয়েছে মূলত পরমাণু বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমারকে ঘিরেই। এখানে তিনিই প্রধান ভরকেন্দ্র। রবার্ট ওপেনহাইমারের ট্র্যাজিক সফর দুটি স্তরে এগিয়েছে। একটি একেবারেই তার নিজের মধ্যে, নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্ব, যার কথা আমরা এর মধ্যেই জেনেছি। আরেকটি স্তর হলো সমসাময়িক রাজনীতির আবর্তে পড়ে নিজ দেশেই নায়ক থেকে খলনায়কে রূপান্তরিত হয়ে যান ওপেনহাইমার। কঠোর গোপনীয়তা সত্ত্বেও ম্যানহাটন প্রজেক্ট থেকে কেমন করে যেন বের হয়ে গেল পারমাণবিক বোমার ফর্মুলা। পৌঁছে গেল রাশিয়ার হাতে। সন্দেহের তীর তাক করা হয় ওপেনহাইমারের দিকে। এ রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ওপেনহাইমারের সংযোগ। বিশ্বাসঘাতকতার তকমা লাগে তার গায়ে। এ দ্বিমুখী জটিলতায় ওপেনহাইমারের ট্র্যাজেডি চূড়ান্ত রূপ নেয়। এ সিনেমা দেখতে দেখতে বিজ্ঞান ও মানবিকতার দ্বন্দ্বে ওপেনহাইমারকে কখনো হিরো, কখনো ভিলেন মনে হবে। কিন্তু সবশেষে তার জন্য করুণার উদ্রেক হবে দর্শকের মনে।
প্লটের দিক থেকে ওপেনহাইমার সিনেমায় কোনো ঘাটতি নেই। আর সে গল্প দারুণ দক্ষতায় পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন ক্রিস্টোফার নোলান। তথাকথিত কোনো অ্যাকশন দৃশ্য না থাকা সত্ত্বেও কেবল গল্প ও সংলাপ দিয়ে টানা ৩ ঘণ্টা দর্শকদের মনোজগতে টান টান উত্তেজনার সঞ্চার করতে পেরেছেন তিনি। নোলানের সিনেমা এমনিতেই দর্শকদের কাছ থেকে বেশি মনোযোগ দাবি করে। ওপেনহাইমারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সিনেমাটির আরেকটি অভিনব ব্যাপার হলো, এখানে সিজিআইয়ের কোনো ব্যবহার করেননি নোলান। ম্যানহাটন প্রজেক্টের ‘ট্রিনিটি’ পরীক্ষার দৃশ্যটি বাস্তবেই তৈরি করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে পরিচালকের সিজিআই ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা ও পারফেকশনের প্রমাণ দেয়। এ সিনেমার চিত্রগ্রহণের জন্য সিনেমাটোগ্রাফার হোয়টে ভ্যান হোয়টেমা অস্কার পুরস্কারের দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকবেন।
ওপেনহাইমার সিনেমার আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো এর আবহসংগীত। সম্পূর্ণ সিনেমায় যেন দর্শকদের হাতে ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আর জেনিফার লেমের সম্পাদনায় ওপেনহাইমার হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর।
সিনেমার প্লট যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যদি অভিনয়টা ঠিকঠাক না হয়, তাহলে ভালো গল্পও মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ দর্শক শুধু গল্পই জানতে চান না। অভিনয়টাও তারা দেখেন। এক্ষেত্রেও শতভাগ উতরে গেছে ‘ওপেনহাইমার’।
প্রধান চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করতে চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি কিলিয়ান মারফি। ওপেনহাইমারের মতো শারীরিক আদল তৈরি করতে দিনের পর দিন কেবল বাদাম খেয়েই পার করেছেন তিনি। পর্দায় তাকে দেখে রবার্ট ওপেনহাইমারই মনে হবে। আর আছেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। লুইস স্ট্রসের ভূমিকায় তার অনবদ্য অভিনয় দেখে দর্শকের চোখ প্রশান্ত হবে। অন্যান্য চরিত্রে ম্যাট ডেমন, কেসি অ্যাফ্লেক, রামি মালিক, গ্যারি ওল্ডম্যানের মতো তারকারা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। পর্দায় স্বল্প উপস্থিতিতেই নিজের জাত চিনিয়েছেন এমিলি ব্লান্ট।
গল্প, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসংগীত, সম্পাদনা সবকিছুর সার্থক মিশেলে একটি সিনেমা কতটা অনন্য হতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ ওপেনহাইমার। দর্শকদের জন্য তো বটেই, সিনেমাসংশ্লিষ্ট সবার জন্য সিনেমাটি অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে।