এতটাই নিখুঁত ও আদর্শ যে জগৎ, সেখানেও হানা দেয় জরা, মৃত্যুচিন্তা। আর সে চিন্তায় টালমাটাল বারবির মনোজগৎ। অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে থাকে সে।
পুতুলের জগৎ বারবিল্যান্ড। আমাদের এ চিরচেনা জগতের সমান্তরালে একটি জগৎ হয়তো। আ প্যারালাল ইউনিভার্স। সেখানে কোনো খুঁত নেই, নেই কোনো দুঃখ। বারবিল্যান্ডের সবার প্রিয় সিনেমার মূল বারবি। অন্য বারবিদের সঙ্গে হেসে-খেলে কাটে তার জীবন। আর আছে তার প্রেমিক কেন। বারবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব। কেনের টিকে থাকা বারবির স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এক সকালে আচমকা সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। চোখ খোলার পরই মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তার মন। বারবি অবাক হয়ে দেখে তার পায়ের পাতা সমতল হয়ে গেছে! বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে যায় তার মন। অন্য বারবিরা তার ব্যথা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কেউই সমস্যার উৎস চিহ্নিত করতে পারে না। বারবি নিজেও কি জানে তার এ বেদনার গোড়া কোথায়? কিন্তু একজন জানে। তাকে সবাই চেনে উইয়ার্ড বারবি হিসেবে। সব বারবি তাই পরামর্শ করে মূল বারবিকে তার কাছে পাঠায়। হতাশ করে না উইয়ার্ড বারবি। ঠিকই ধরতে পারে রোগের কারণ। সমস্যা বাস্তব জগতে। সেখানে যে শিশুটি তাকে নিয়ে খেলা করছে, তার দুঃখ ও অক্ষমতা সঞ্চার হয়েছে বারবির মধ্যে। উইয়ার্ড বারবি মূল বারবিকে বাস্তব জগতে গিয়ে শিশুটিকে খুঁজে বের করতে পরামর্শ দেয়। জানায় শিশুটির সুস্থতা ও আনন্দের মাঝেই নিহিত আছে বারবির সুখ। উইয়ার্ড বারবির পরামর্শ মেনে বারবি বাস্তব জগতের উদ্দেশে তার সফর শুরু করে। সে যাত্রায় সঙ্গী হয় কেন। তারা দেখে বাস্তব জগৎ তাদের কল্পনার চেয়ে বেশ ব্যতিক্রম। এ সফরে তারা যেমন জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়, তেমনি নতুন কিছু বন্ধুও জুটে যায়। আর পরিচয় ঘটে গ্লোরিয়ার সঙ্গে। সে বারবি পুতুলের নির্মাতা কোম্পানি ম্যাটেলে কাজ করে। সেও অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। কর্মক্ষেত্রে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছে গ্লোরিয়া। তার এ মানসিক জটিলতার সঙ্গে লড়াইয়ে সমানভাবে জড়িয়ে পড়েছে তার মেয়ে সাশা। বাস্তব জগতে সাশার পুতুলটিই হচ্ছে আমাদের মূল বারবি।
বাস্তব জগতে বারবি আর তার প্রেমিক কেনের সফর নিয়ে আবর্তিত হয়েছে বারবি সিনেমার গল্প। এ সফরের মধ্য দিয়ে বহুমুখী বিষয় পর্দায় উপস্থাপন করেছেন বারবির লেখক ও পরিচালক গ্রেটা গারউইগ। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পিতৃতন্ত্র থেকে আত্মপরিচয় এবং ভোগবাদ থেকে পুঁজিবাদের বয়ান হাজির করেছেন গ্রেটা। নারীবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ সিনেমাকে বিশ্লেষণের ধারাটিই এখন পর্যন্ত রিভিউ লেখকদের মধ্যে প্রধানত দেখা যাচ্ছে। নারীর মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা যে জগৎ, তারই সার্থক প্রতিচ্ছবি যেন বারবিল্যান্ড। তবে সেখানেও আছে দ্বন্দ্ব। সুযোগ বুঝে বারবিদের মগজ ধোলাই করে বারবিল্যান্ডকে পিতৃতান্ত্রিক কেনল্যান্ডে পরিণত করতে চায় কেন। বারবিল্যান্ডে আবার শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তখন প্রয়োজন হয় একটি গোলাপি বিপ্লব!
মূলত নারীবাদী প্রচারণার অংশ হিসেবে গ্রেটা গারউইগ বারবি তৈরি করলেও লিঙ্গ নিরপেক্ষ জায়গা থেকেও সিনেমাটিকে বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। বারবিকে দেখা যায় একজন আত্মvনুসন্ধানী মানুষের প্রতীক হিসেবে। জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত মানুষের তেমন কোনো চিন্তা থাকে না। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে মানুষের চারপাশের জগৎ থাকে রঙিন। ফেনিল বুদবুদে বুঁদ হয়ে থাকে সে। মানুষের জীবনের এ পর্যায়টিই তার বারবিল্যান্ড। স্বাভাবিক নিয়মে একসময় তার মধ্যে মানসিক জটিলতার সংক্রমণ ঘটে। তখন বাধ্য হয়ে রঙিন জগতের ঘেরাটোপ থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়। উদ্ভূত সংকট সমাধানে তাকে রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। মোকাবেলা করতে হয়। এখানে তার সফরটা মূলত সেখানে পৌঁছনোর, যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ আনন্দঘন যে বারবিল্যান্ড থেকে সে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে, সে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে তার কাছে আবার সেখানে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। প্রতিনিয়ত সে খুঁজে ফেরে তার হারানো বারবিল্যান্ডকে। এ যেন বারবিল্যান্ড থেকে বারবিল্যান্ডের দিকে যাত্রা!
বারবি আমাদের আরো অনেক কিছুই বলে। জানায়, মানুষের সামাজিক জীবন অবিচ্ছিন্ন নয়। নিকটবর্তী তো বটেই, অনেক দূরবর্তী কোনো কিছুর প্রভাবেও বদলে যেতে পারে আমাদের জীবন। তবে এতসব জটিল চিন্তার মধ্যে না গিয়ে হাস্যরস, কৌতুক ও চমৎকার সব গানে ভরপুর একটি সিনেমা হিসেবেও বারবিকে দেখে পয়সা উসুল করতে পারে দর্শক। ছুটির দিনে আপনার সন্ধ্যাটা অন্তত মাটি হবে না।
বারবি সিনেমার কস্টিউম ডিজাইন ও প্রডাকশন ডিজাইন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। এ দুই ক্ষেত্রে যথাক্রমে দুবারের অস্কারবিজয়ী জ্যাকলিন দুরান ও ছয়বারের অস্কারবিজয়ী সারাহ গ্রিনউড বরাবরের মতোই দক্ষতা দেখিয়েছেন। মূল বারবি ও কেন চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন যথাক্রমে মার্গো রবি ও রায়ান গসলিং। গল্প, অভিনয়, কারিগরি দিক সব মিলিয়ে বারবি একটি সার্থক সিনেমার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে যেন।