বলিউড নানা ধরনের সিনেমা নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে জনরা বা সিনেমার ধারা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করেছে সময়ের ওপর। যেমন নব্বইয়ের দশকে বলিউডের নিজস্ব ধারার অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণ হতো, ২০০০ সালের পর কিছুদিন চলেছে ফ্যামিলি ড্রামা ও নিউ জেনারেশন রোমান্টিক স্টোরি। তবে রোমান্টিক ও ফ্যামিলি ড্রামা সবসময়ই জনপ্রিয় ছিল। প্রতিটি ধারায় নির্দিষ্ট নির্মাতার আবার আছে নির্দিষ্ট ধারা। বলা যায়, সিগনেচার স্টাইল। আবার কেউ কেউ সময় ও ধারা থেকে সরে গিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন। ‘পহেলি’ও তেমন। জীবন বাস্তবতার কঠিন দিক, অপ্রাপ্তির মাঝেও একটা মিষ্টি গল্প।
শাহরুখ খান, রানী মুখার্জি, অনুপম খের অভিনীত পহেলি পরিচালনা করেছেন অমল পালেকর। হৃষিকেশ মুখার্জির সিনেমার সে আলাভোলা চরিত্র হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। অভিনেতা হিসেবে বলিউডে পরিচিত, কিন্তু তিনি সিনেমাও নির্মাণ করেছেন প্রায় কুড়িটি। তারই মধ্যে পহেলি অন্যতম। যে সিনেমার গল্প ছিল সময়োপযোগী, খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল বেশকিছু বিষয়। কিন্তু বিজয়ধন ধেতার ‘দুবিধা’ গল্প থেকে নির্মিত সিনেমার পুরো বক্তব্য দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয়নি।
গল্পটা এই সময় থেকে বহু বছর আগের, রাজস্থানের। রাজস্থানের কিছু অঞ্চল নানা কারণে আজও ভারতের অনগ্রসর অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। আর বহু বছর আগে কী ছিল ভেবেই নেয়া যায়। সেখানে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের বিষয়টা কেউ বুঝতই না। সে সময় এক কৃপণ ব্যবসায়ী বনওয়ারলালের (অনুপম খের) পুত্রবধূ হয়ে আসে লাচ্ছি (রানী মুখার্জি)। অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে আসা লাচ্ছি মনে মনে ভাবে, স্বামীর সঙ্গে প্রেম হবে তার। আলাভোলা কৃষ্ণও (শাহরুখ খান) মনে করে লাচ্ছির সঙ্গে প্রেম হবে, মিষ্টি সম্পর্ক হবে। কিন্তু কীসের কী! বিয়ে হতে না হতে কৃষ্ণকে ব্যবসার কাজে বাইরে পাঠায় তার বাবা।
রাজস্থানে নানা লোকগল্প প্রচলিত। সে গল্পকে আধার করে এখানে একটা ভৌতিক চরিত্র আনা হয়। কৃষ্ণ যখন ব্যবসার কাজে দূরে, তখন এক ভূত বাবাজি কৃষ্ণর রূপ ধরে আসে লাচ্ছির কাছে। তারপর লাচ্ছির সঙ্গে সে ভূতই প্রেম করে। বাবার ভয়ে ভীত মেরুদণ্ডহীন কৃষ্ণ যে প্রেম দিতে পারে না, আমাদের এ ভালো ভূত সে প্রেম দেয়। এমনকি একটা সময় লাচ্ছির কাছে সে নিজের পরিচয়ও প্রকাশ করে।
বিদেশী হরর, প্যারানরমাল সিনেমা দেখা দর্শকের কথা বাদ দিলাম। আজকে ‘বুলবুল’, ‘স্ত্রী’ দেখা লোকেরাও হয়তো পহেলির গল্প শুনে বলে, ‘এইটা কিছু হইল?’। কিন্তু আসলে এটা ‘অনেক কিছুই হইল’। প্রথমত, ২০০৫ সালে শাহরুখ যেখানে ‘বীরজারা’, ‘ম্যায় হু না’র মতো বক্স অফিসে ব্যবসাসফল সিনেমা দিচ্ছিলেন সে সময় শাহরুখ এ রকম নিরীক্ষাধর্মী কাজও করে গেছেন। সিনেমায় তার নায়কোচিত উপস্থিতি অর্ধেকটায় নেই। আবার আছে। এ গেল শাহরুখের কথা।
সিনেমা প্রসঙ্গে বলতে হয়, বুলবুল কিংবা স্ত্রীর মূল বিবেচ্য বিষয় ‘ভূত’ নয়, বরং নারীর চাওয়া-পাওয়ার কাছাকাছি যাওয়া। এখন থেকে প্রায় ১৯ বছর আগে শাহরুখ খানেরই প্রযোজনায় (জুহী চাওলা, নির্মাতা আজিজ মীর্জাও সম্ভবত ছিলেন সঙ্গে) প্রডাকশনে সে কাজই হয়েছিল। প্রথমেই বলা হয়েছে, রাজস্থান আজও অনেকাংশে অনগ্রসর। সে অনগ্রসর অঞ্চলে বহু আগের সামাজিক অবস্থার একটা চিত্র এ সিনেমায় ফুটে ওঠে এবং সেক্ষেত্রে বলতে হয় পোশাক, আচার, রীতি থেকে শুরু করে রাজস্থানকে চমৎকার তুলে ধরেছিল এ সিনেমা। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নববিবাহিত লাচ্ছির মানসিক টানাপড়েন। স্বামী থেকে দূরে শ্বশুরঘরে তার যাপিত জীবনের কড়চা ও মনের গভীরে লালন করা স্বপ্ন এ সিনেমার মূল ‘ফোকাস’।
শাহরুখ, রানী, জুহী, অনুপম খেরের মতো জাত অভিনেতাদের কাজ নিয়ে কিছু বলার নেই। পালেকারের পরিচালনাও দারুণ। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো গল্প বলার ধরন। গল্পটা বলে মূলত পুতুল খেলার দুটো পুতুল (সুজিত সরকার ২০২০ সালে তার ‘গুলাবো সিতাবো’ সিনেমায় পুতুল ও পুতুল নাচকে আরো সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে পারতেন, পহেলি যা করেছিল ১৫ বছর আগে, সুজিত পারেননি)। নাসিরুদ্দিন শাহ্ ও রত্না পাঠক শাহর গলায় পুতুলের এ ন্যারেশনে গল্পটা শুনতে চমৎকার লাগে। আর শেষটায় আসে অমিতাভ বচ্চনের ক্যামিও! ৩-৪ মিনিটে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করেন তিনি।
শাহরুখ প্রসঙ্গে এখানে একটা কথা বলতে হয়। এ সিনেমায় শাহরুখ মূল চরিত্র নয়। সে অনেকটা থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছে। লাচ্ছিকে সামনে আনা, আবার কৃষ্ণকে সামনে আনা এ দুয়ের মধ্যে পরিচালক এমন একটা বিভ্রম রেখে দেন যে এখানে আমরা স্টার শাহরুখকে পাই না। একদিকে এটা যেমন শাহরুখের কৃতিত্ব, তেমনই পালেকরের কৃতিত্ব। সংগীতে গুলজারের লিরিক আর এমএম কিরাবানির কম্পোজিশনও অসাধারণ।
বুলবুল বা স্ত্রী দেখতে গিয়ে নারীর পিছিয়ে থাকার চেয়ে ‘উইমেনস লিব’ বা স্বাবলম্বিতার কথা প্রথমে মাথায় আসে। কিন্তু পহেলি মনে করায় নারীর বলতে না পারা কথা। তার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আর সমাজ বাস্তবতা।