নড়াইলের চিত্রাপাড়ের মানুষ লাল মিয়া। সবাই তাকে চেনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান নামে। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম মেছের আলী। মা মাজু বিবি। এ বছর চিত্রাপাড়ের এস এম সুলতানের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নড়াইল জেলা প্রশাসন। এ উপলক্ষে বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শিল্পীর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, আর্ট ক্যাম্প, শিশুদের নিয়ে নৌকা ভ্রমণ, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী। এসব কর্মসূচিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি উপস্থিত থাকবেন ।
নড়াইলের সঙ্গে সুলতানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ১৯২৮ সালে তিনি নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শুরু। ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। ১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনটি স্কুল।
অকৃতদার গুণী এ শিল্পী মৃত্যুকালে রেখে গিয়েছিলেন পালিত ছেলে দুলাল চন্দ্র দে ও মেয়ে নিহার বালা। সুলতানের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সুলতানের বাড়িতে বসবাস করতেন তারা। ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর ৮৩ বছর বয়সে মারা যান সুলতান কন্যা নিহার বালা। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর গুণী এ শিল্পীর মৃত্যুর পর তার বাসভবন, শিশুস্বর্গ ও সমাধিস্থল ঘিরে ৫৪ শতক জমির ওপর ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুলতানের এ আবাসভূমি দেখার জন্য দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করেন। ‘সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’য় তার নিজের হাতের আঁকা ছবি দেখতে পান দর্শনার্থীরা। বিভিন্ন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও স্মৃতি সংগ্রহশালার পূর্ণতা পায়নি আজও।
২০০৩ সালে ‘সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’র নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৬ সালের অক্টোবরে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। তবে এর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হচ্ছে না।
তিনতলাবিশিষ্ট ভবনে সংগ্রহশালায় রাখা সুলতানের ছবি নষ্ট হতে চলেছে। আজও নির্মাণ করা হয়নি বিশ্বমানের গ্যালারি। ফলে সুলতানের নিজ হাতে আঁকা দামি ছবিগুলো যথাযথভাবে রাখা হচ্ছে না। তার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র এ তিনতলা ভবনের পুরাতন কয়েকটি আলমারিতে রাখা আছে। নড়াইল সদর উপজেলার মহিষখোলা গ্রামের সুলতানভক্ত পান্থ বিশ্বাস জানান, দূর দূরান্ত থেকে অনেক দর্শক এখানে এলেও তাদের জন্য বিশ্রামের কোনো স্থান নেই এখানে।
আর এক সুলতান ভক্ত সজিব মিয়া বলেন, ‘সুলতানের নিজ হাতে আঁকা ছবি যে গ্যালারিতে রাখা হয়েছে সে গ্যালারি বিশ্বমানের নয়। ছোট ভবনে ছবিগুলো রাখার ফলে ছবির মান দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বিশ্বমানের গ্যালারি নির্মাণসহ পূর্ণাঙ্গ সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হোক।’
সুলতানের স্বপ্নের ‘শিশুস্বর্গ’ (বজরা) আর ভাসে না চিত্রায়
বোহেমিয়ান সুলতান শিখেছিলেন প্রকৃতির কাছে। তার চিন্তা, ধ্যান সবই ছিল বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষকে নিয়ে। জীবজন্তু আর গাছপালায় ঘেরা ছিল তার মাছিমদিয়ার ছোট্ট আবাসভূমি। নিজে না খেয়ে তার পোষা কুকুর, বিড়াল আর বানরকে খাইয়েছেন। খ্যাতির শিখরে উঠেও তিনি নড়াইল আর চিত্রা নদী ছেড়ে নগর জীবনে যাননি।
সুলতান সবসময় শিশুদের নিয়ে ভাবতেন। তার স্বপ্ন ছিল শিশুরা যেন প্রকৃতির কাছ থেকে শিখে পরিপূর্ণভাবে মানুষ হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য সুলতানের আশা ছিল চিত্রা নদীতে একটি বজরায় করে তিনি শিশুদের নিয়ে ভেসে বেড়াবেন। আর শিশুরা মনের আনন্দে ছবি আঁকবে। এ বজরা নিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি সুন্দরবন পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
সুলতানের এ স্বপ্নের কথা জানতে পেরে তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার জেভিসের সহায়তায় ১৯৯২ সালে শিশুদের জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সুলতান নিজে তদারকি করে বানিয়েছিলেন স্বপ্নের ‘শিশুস্বর্গ’। ৬০ ফিট লম্বা ও ১৫ ফিট চওড়া ভ্রাম্যমাণ ‘শিশুস্বর্গ’ বজরা নৌকাটির ভেতরে রান্না-খাবার ব্যবস্থাসহ শিশুদের নিরাপদে প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে ছবি আঁকাআঁকির সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিশুদের নিয়ে বজরায় করে চিত্রা নদীতে ভেসে ছবি আঁকতেন।
১৯৯৪ সালে সুলতানের মৃত্যুর পর ২-৩ বছর পানিতে ভেসে থাকলেও অবহেলার একপর্যায়ে বজরাটি চিত্রা নদীতে তলিয়ে যায়। জেলা প্রশাসন নড়াইল সুলতানের ঘাটে একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহায়তায় নদীর তলদেশ থেকে বজরাটি ডাঙায় তুলে সুলতান সংগ্রহশালার পাশে নদী তীরে সংরক্ষণ করে।
সুলতান শিশুদের নিয়ে বজরায় করে চিত্রা নদীতে ভেসে ছবি এঁকে বেড়াতেন, বড়দের কাছে সে গল্প শুনে শিশুরা দারুণ আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে, কবে তারা সুলতান দাদুর বজরায় চড়ে চিত্রা নদীতে ভেসে ভেসে প্রকৃতির কাছে গিয়ে ছবি আঁকতে পারবে।
এস এম সুলতান গবেষক ও লোহাগড়া সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তারেক আলম জানান, লোক দেখানো সুলতানপ্রেম না দেখিয়ে সুলতানের ঘাটটি নির্মাণ করে সেখানে ভ্রাম্যমাণ ‘শিশুস্বর্গ’র আদলে আরেকটি নৌকা তৈরি করে চিত্রা নদীতে ভাসিয়ে শিল্পীর ইচ্ছের মর্যাদা দেয়া উচিত। আর সে নৌকা করে চিত্রায় ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতি দেখবে আর ছবি আঁকবে কোমলমতি শিশুরা।
সুলতানের স্বপ্নের শিশুস্বর্গ সে বজরা (ভাসমান নৌকা) আবারো চিত্রায় ভাসবে এবং নদীতে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি দেখবে আর ছবি আঁকবে, সে অপেক্ষায় চিত্রাপাড়ের লাল মিয়ার উত্তরসূরি হাজারো শিশু-কিশোর।