রাইখেনবাক থেকে হুগলী নদী

শার্লক হোমসকে নিয়ে মরিয়ার্টি পড়েছিলেন রাইখেনবাক ফলসে। তারপর শার্লক ফিরেও এসেছিলেন পাঠকের আন্দোলনের মুখে।

শার্লক হোমসকে নিয়ে মরিয়ার্টি পড়েছিলেন রাইখেনবাক ফলসে। তারপর শার্লক ফিরেও এসেছিলেন পাঠকের আন্দোলনের মুখে। চলচ্চিত্র আসার পর দর্শক শার্লককে চেয়েছে বহুবার আর নির্মাতারা তাকে উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে। সে ধারায় নতুন সংযোজন ‘শেখর হোম’। সিরিজটি নির্মাণ করেছেন অনিরুদ্ধ গুহ, রোহান সিপ্পি ও সৃজিত মুখার্জি। অভিনেতা কে কে মেনন এ সিরিজের নতুন শার্লক হোমস। নির্মাতারা তাকে নিয়ে ফেঁদেছেন বিচিত্র সব গল্প।

গল্প শুরু হয় জন ওয়াটসনের দিক থেকে। এখানে জন অবশ্য জয়ব্রত। তিনি আর্মির ডাক্তার। মনের শান্তি খুঁজতে আসেন লোনপুরে। ইচ্ছা, তিনি একটি আশ্রমে সময় কাটাবেন। এসেই প্রথমে মিসেস এইচ (হাডসনের নতুন সংস্করণ) পরিচালিত ক্যাফে কাম রেস্ট হাউজে ওঠেন। জয়ব্রতের (রণবীর শোরে) থাকার কথা শেখরের সঙ্গে। কিন্তু দেখা গেল সে অনুপস্থিত। তাকে খুঁজতে রিকশা নিয়ে বের হলে একসময় জানা যায় রিকশা চালাচ্ছিল শেখর। গাঙ্গুলীর চুরি যাওয়া ছাগল ধরে দেয় সে। তখন প্রথম দেখায়ই জানায় জয়ব্রত আর্মির ডাক্তার। কেমন করে? ডিডাকশনও জানায় তখনই।

এটুকু দেখে পাঠকের যা-ই মনে হোক, দর্শকের মনে পড়বে বিবিসির শার্লক সিরিজের প্রথম পর্বের কথা। জন রূপী মার্টিন ফ্রিম্যানকে শার্লক কাম্বারব্যাচ বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান নাকি ইরাক?’ এর পরই শার্লক বলে দেন, কেমন করে জনের পরিচয় তিনি জানলেন। ‘আ স্টাডি ইন পিংক’ নাম ছিল সিরিজের প্রথম এপিসোডের। সেটির আদলেই তৈরি হয়েছে প্রথম পর্ব, যেখানে অ্যাম্বুলেন্স চালক দেবু একের পর এক মার্ডার করে দুটো ক্যাপসুল দেখিয়ে।

কিন্তু বিবিসির সিরিজ থেকে একেবারে ঝেঁপে দেননি (নকল করা) নির্মাতারা। সেখান থেকে কিছুটা বা অনেকটাই আলাদা করেছেন। যেমন শেখর হোম সিরিজের শেখর একজন কেমিস্ট্রি প্রফেসর। শুরু থেকেই কেমিস্ট্রি নিয়ে তার পছন্দের বিষয়টি বোঝা গেলেও তার পেশাগত পরিচয় পাওয়া যায় সিরিজের শেষ পর্বে। ততক্ষণে গল্প নিয়েছে এক জটিল মোড়।

এ সিরিজের একটা মজার বা ভালো ব্যাপার হলো প্রতিটি এপিসোড আলাদা করে করা হলেও ছয়টি এপিসোড মিলিয়ে আবার একটা বড় গল্প আছে। প্রথম এপিসোডে সিরিয়াল কিলারের খোঁজ মিললেও এরপর ঘটে আরো নানা বিষয়। সৃজিত মুখার্জি থাকার কারণেই হয়তো এতে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলার বেশকিছু ছাপ। এই যেমন একটি পুরো এপিসোড আছে স্কন্ধকাটা নিয়ে। অবশ্যই স্কন্ধকাটা একটি মিথ। শেখর হোমের গল্পে তার প্রমাণও রেখেছেন নির্মাতা। কিন্তু স্কন্ধকাটা নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাস ও তার মিথ ভাঙার কাজটি করেছেন সিরিজের নির্মাতারা। দেখা গেল, এর পেছনে ছিল বনেদি পরিবারের সম্মান রক্ষার মতো কিছু ঠুনকো কিন্তু বহুদিনের লালিত বিষয়।

শেখর হোম চরিত্রে অভিনয় করেছেন কে কে মেনন। তার ভাইয়ের নাম মৃণ্ময়। শেখর হোম নাম নিয়ে সে মিসেস এইচের (শেরনাজ প্যাটেল) রেস্ট হাউজে পালিয়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। পালানোর কারণ এম। সে কয়েকজন বিজ্ঞানীকে দিয়ে একটি বিষ বানিয়েছে, তা কোথায় আছে তার সূত্র আছে কেবল শেখরের কাছে। আর একটা সময় এম পৌঁছে যায় শেখরের নতুন ঠিকানায়। শার্লক থেকে শেখর। আসল নাম স্নেহাশীষ। মাইক্রফটকে বদলে করা হয়েছে মৃণ্ময়। এখানে কৌশিক সেন মাইক্রফটের মতো অলস ও মোটা নন, তবে তিনি কিছুটা মাথামোটা। অবশ্য কাজ করেন ইন্টেলিজেন্সে। লেসট্রেডকে করা হয়েছে লাহা, অভিনয় করেছেন রুদ্রনীল। আইরিন হয়েছেন ইরাবতী আর অভিনয় করেছেন রাসিকা দুগাল। মুমতাজ বা এম চরিত্রে কৃতি কুলহারী। তবে দেখা যায়, মুমতাজ আসলে সত্যিকার মরিয়ার্টি না। মরিয়ার্টি অন্য কেউ। 

বাঙালি ভাব রাখতে নির্মাতারা এনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। শেষ এপিসোডে রহস্য সমাধান হয় বাঙালি গোয়েন্দাদের সেই জনপ্রিয় হেঁয়ালির সমাধান দিয়ে। সেই সঙ্গে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ, আসে কফি হাউজও। ১৯৯৫ সালের পটভূমিতে নির্মিত সিরিজে প্রযুক্তির কোনো ব্যবহার নেই। তাই শেখর হোম শার্লক ও ফেলুদাকে মনে করিয়ে দেয়। ক্ল্যাসিক করতে ভায়োলিনের জায়গা নিয়েছে রবার। আর রবারের মিউজিক ভায়োলিনের চেয়ে কম মুগ্ধ করেনি।

মূল চরিত্রে কে কে মেনন শার্লকের মতোই দুবলা পাতলা, কিছুটা রোগা। জন চরিত্রে রণবীর শোরে, তবে তিনি কিছুটা ভিন্ন রূপে ধরা দেন। অভিনয় ও সিরিজ ডিজাইন নিয়ে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। নির্মাতারা জানতেন, তারা কী নির্মাণ করছেন। শেষটায় হাওড়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে কেসের সমাধান। সেখানে গ্র্যাফিকসের কাজ খুব বেশি কাঁচা। না হলে শার্লকের হাত ধরে মরিয়ার্টির পড়ে যাওয়ার সেই ক্ল্যাসিক দৃশ্য (হাওড়া ব্রিজ থেকে) দেখার সময় হুগলী নদীকে রাইখেনবাক মনে করে নিতে আপত্তি ছিল না।

আরও