১৯৫৭ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে একটা আইন পাসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এফডিসি। যদিও তার আগের বছরই ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ছবি নির্মাণ শুরু হয়। তবে এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানের এই অংশে আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমার নির্মাণ যাত্রা শুরু হয়।
এর কয়েক বছরের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প-সাহিত্যের নানা মাধ্যমের মানুষ নতুন এই মাধ্যমটিতে তাদের হাত মকশো করতে শুরু করেন। অগ্রনায়ক হিসেবে জহির রায়হান তো ছিলেনই, সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দিন, সাদেক খান কিংবা এসএম পারভেজ থেকে শুরু করে শিল্পী মর্তুজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরীরাও সিনেমার নানা কাজে জড়িত হয়ে যান। নির্মিত হয়, জাগো হুয়া সাভেরা, আছিয়া, নদী ও নারী, কাচের দেয়াল-এর মতো ছবি। ছবি নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়া এ সময় হতো এফডিসিকে কেন্দ্র করেই। ফলে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের সিনেমা শিল্পের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
শুরুতে কয়েক বছর শিল্পসমৃদ্ধ ছবি নির্মাণ হলেও অচিরেই এসব প্রচেষ্টা বাণিজ্যিক খাতে ধাবিত হয়। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতের ছবি আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে তার বিকল্প হিসেবে ফোক ফ্যান্টাসি ধারার ছবিসহ উর্দু ছবিও নির্মাণ শুরু হয়। এ সময় এফডিসি হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে সিনেমা নির্মাণ বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। এর সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের মালিক থেকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর পরিবেশকরাও জড়িত হয়ে যান।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্পখাত বিকাশের চেষ্টা অব্যাহত থাকে মুক্তিযুদ্ধের পরও। বরং এ সময় ভারত থেকে সিনেমা আমদানির মাধ্যমে প্রদর্শক আর পরিবশেকদের জন্য যে ভিন্ন একটা প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্রের জিকিরে হারিয়ে যায়। ফলে প্রতিযোগিতাহীন একটা আবদ্ধ অবস্থায়ই বাংলাদেশের সিনেমার বাণিজ্য বড় হতে থাকে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান এফডিসি হয়ে ওঠে এর প্রাণভোমরা।
আশির দশক পর্যন্ত এভাবেই চলছিল। এই প্রক্রিয়ায় একজন প্রযোজক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ এফডিসিতে জমা করে প্রযোজক হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করতেন। এরপর এই প্রতিষ্ঠান থেকে চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, ডাবিং, সাউন্ড ডিজাইন, রেকর্ডিংসহ ফাইনাল কপি প্রিন্ট করিয়ে নিতে পারতেন। কেবল শিল্পীদের সম্মানীর অর্থ তাকে সরাসরি তাদের হাতে দিতে হতো। এরপর পরিবেশক, প্রদর্শক ইত্যাদির চক্কর পার হয়ে ছবিটি মুক্তি পেত। নব্বই দশকের গোড়া পর্যন্ত দেশে প্রায় দেড় হাজার সিনেমা হল ছিল। ফলে বাণিজ্যিকভাবে সফল হলে দ্রুতই ছবির টাকা উলটো পথে ফেরত আসত— অর্থাৎ প্রদর্শক থেকে পরিবেশক হয়ে প্রযোজক পর্যন্ত। এই প্রক্রিয়ায় প্রযোজকরা অনেকে এফডিসির বকেয়া পরিশোধ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বকেয়া প্রযোজকদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে এফডিসিকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হতো। এটি অনেকটা ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়ার মতো ঘটনা। তবে সিনেমার লোকেরা যেমন গেল ১৫ বছরে নানাভাবে আনুকুল্য পেয়েছেন, তেমনি অতীতেও সামরিক-অসামরিক, গণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী— নানা ধরনের সরকারের সঙ্গে নানা কায়দায় লেপ্টে ছিলেন। ফলে ছবি প্রযোজনায় এফডিসির বকেয়া টাকা পরিশোধ না করা থেকে শুরু করে সিনেমা হল নির্মাণের নামে প্লট বাগিয়ে নিয়ে তা পরিবারের কারো নামে শপিং কমপ্লেক্স করে ফেলা পর্যন্ত সব কাজেই তারা সফল হয়েছেন। শিল্পখাত হিসেবে কেবল সিনেমা মাধ্যমটির কোনো প্রবৃদ্ধি ঘটেনি।
তবে এরশাদ পতনের পর নতুন সরকার এসে মুক্তদ্বার অর্থনীতির সুযোগ তৈরি করলে তখন আমাদের এই একচেটিয়া সিনেমার বাণিজ্য করিয়েরা পিছিয়ে পড়তে থাকেন। নব্বই দশকের গোড়ায় সিএনএন ও বিবিসির হাত ধরে ধীরে ধীরে সনি, জি বা স্টার টিভির মতো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দেখার সুযোগ পেয়ে যান এ দেশের দর্শক। যদিও সীমিত আকারে আশির দশক থেকেই ভিডিওর কল্যাণে সে সুযোগ মিলেছিল বাংলাদেশের দর্শকদের, তবে নব্বই দশকের মাঝামাঝি দর্শকদের সিনেমার দর্শনাকাঙ্ক্ষার জগতে বিরাট এক বিপ্লব ঘটে যায়। ফল হিসেবে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা কমতে থাকে ধীরে ধীরে। সিনেমা হলের সংখ্যাও কমতে থাকে, কারণ মুক্ত বাণিজ্যের সুবাতাস এই সেক্টরে বইবার সুযোগ মোটেই ছিল না। একের পর এক ছবি ফ্লপ হতে থাকে, অন্যদিকে সীমিত পরিসরে কেউ কেউ হংকং বা হলিউডি ছবি আমদানি করলেও তা সীমিতই থেকে যায়। ফলে ফ্লপ সিনেমার সংখ্যা বৃদ্ধি এফডিসির বকেয়ার পরিমাণও দ্রুত বাড়াতে থাকে।
এফডিসিকেন্দ্রিক এই সিনেমার বাণিজ্য আরেকবার ধাক্কা খায়, যখন নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রযোজকরা কিছু অতিরিক্ত শিল্পীকে কব্জা করে ছবিতে কাটপিসের কারবার শুরু করেন। এটা অনেকটা কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো ঘটনা ছিল। মধ্যবিত্ত দর্শক, যারা ছিলেন বাংলাদেশের সিনেমার প্রাণ, তারা হল থেকে ছিটকে বেড়িয়ে আসেন।
এরপর আরো প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেছে। এফডিসি কেবল খোলস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন। ফ্লোরগুলো ভাড়া দিয়েই আয়-রোজগারের প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। সিনেমার শুটিং হয় না বললেই চলে। ফলে প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা কমর্চারীর বেতন-ভাতা দিতে এফডিসিকে এখন নিয়মিত সরকারের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এখন বছরে ছবি যা নির্মাণ হয়, তার বেশিরভাগ এই চত্বরের বাইরে। বিশাল কাঠামো আর জায়গা ও সম্পদ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের আর কিছুই নেই। আবার, গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে উঠেছে নানা রকম সমিতি আর তাদের কার্যালয়। শোনা যায়, এমন সমিতির সংখ্যা আনুমানিক ২০টি। অথচ এখন এই চত্বর থেকে বছরে ২০টি ছবিও নির্মাণ হয় না।
কয়েকবছর আগে, এফডিসির এই স্থাপনা ভেঙে তৎকালীন সরকার ৩০০ কোটি টাকার একটা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে, যা এখনো বাস্তবায়নাধীন আছে। ২০২১ সালে এই কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বাড়িয়ে এ বছর নির্ধারণ করা হয়। তারপরও তা শেষ হওয়ার ব্যাপারে সংশয় আছে।
এ দেশে বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণের মূল অংশীদার সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটিকে এ অবস্থায় আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত এক বন্ধু গেল বছর জানিয়েছিলেন, যেহেতু শ্বেতহস্তী হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান এফডিসিকে চালানোর জন্য সরকারকে প্রায়ই টাকা দিতে হয়, তাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের মিটিংয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন— রাষ্ট্রীয় অনুদানে ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, চাই প্রক্রিয়ার সংস্কার
এ অবস্থায় রুগ্ন এই প্রতিষ্ঠানটিকে একবারে বন্ধ না করে, সংস্কার করে ফিল্ম কাউন্সিলে রূপান্তরের লক্ষ্যে কয়েকটি সুপারিশ করা হলো—
এক. মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টাস্কফোর্স গঠন করে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা ও পাওনা নির্ধারণ করে এর অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হয় আত্তীকরণ করে অন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে হবে, অথবা গোল্ডেন হ্যান্ডশএকর মাধ্যমে অবসর প্রদান করতে হবে।
দুই. পরে আইন সংশোধন করে এফডিসিকে ন্যশনাল ফিল্ম কাউন্সিলে রূপান্তর করা এবং এই ফিল্ম কাউন্সিলকে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু করে তোলা যেতে পারে।
তিন. নতুন এই ফিল্ম কাউন্সিল পরিচালনায় বোর্ড তৈরি এবং সেখানে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে যুক্ত করা।
চার. নতুন ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সরকারি আমলাদের পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করা যেতে পারে। খাত সংশ্লিষ্ট এই বিশেষজ্ঞরা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিকল্পনা করবেন এবং আমলাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
পাঁচ. এই ফিল্ম কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান কাজ হবে বাণিজ্যিক ধারার ছবির নির্মাণ, প্রচার, প্রদর্শন ইত্যাদি কাজে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা। এই লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরি করবে কাউন্সিল। পরে এই নীতিমালার লক্ষ্য বাস্তবায়নে খাত সংশ্লিষ্ট নানা অ্যাসোশিয়েশন বা সমিতিসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যেতে পারে।
ছয়. দেশের অভ্যন্তরে সিনেমার প্রসারে সিনেমা হল নির্মাণে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ দেয়া যেতে পারে আগ্রহী হল মালিকদের। নির্মাতা আর প্রযোজকরাও ছবি নির্মাণে কীভাবে ব্যংক ঋণ পেতে পারেন, তাতে সহায়তা করতে পারে ফিল্ম কাউন্সিল।
সাত. প্রতিষ্ঠানের আরেকটি প্রধান কাজ হবে স্বাধীন ধারার ছবির নির্মাণ, প্রচার ও প্রসারে নানা কর্মকাণ্ড গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নতুন ট্যালেন্ট হান্ট বা ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট করা যেতে পারে।
আট. বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রযোজনা, পরিবেশনা বা সম্প্রচার সংক্রান্ত কো-প্রোডাকশন চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষর করার প্রক্রিয়া করতে পারে ফিল্ম কাউন্সিল।
নয়. স্বাধীন ধারার ফিল্মের প্রসারে দেশে ফিল্ম মার্কেট আয়োজন করা যেতে পারে, যাতে দেশের ছবিগুলো আন্তঃদেশীয় প্রযোজক খুঁজে পায়। বিদেশের ফিল্ম মার্কেটেও যেন এই ছবির নির্মাতা-প্রযোজকরা অংশ নিতে পারেন, সে উদ্যোগও গ্রহণ করতে পারে কাউন্সিল।
দশ. চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারে এই ফিল্ম কাউন্সিল।
সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক বা স্বাধীন— দুই ধারার ছবির নির্মাণই দেশে কমে এসেছে। বিশেষ করে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার অবনমন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। একটা দেশে বাণিজ্যিক ছবির প্রসার হলে তা যে এক অর্থে স্বাধীন ধারার নির্মাতাদেরও নানাভাবে সহায়তা করে থাকে, তা বিস্তারিত না বললেও চলে। এক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারতের সিনেমা একটা আদর্শ উদাহরণ। বলিউড বা দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক ধারার ছবির ব্যাপক প্রসারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আজ এর বাইরেও নানা ধরনের ছবি নির্মাণ করছেন দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের স্বাধীন ধারার নির্মাতারা। এমন সম্মিলিত প্রয়াসই কেবল বাংলাদেশের সিনেমাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে পরিণত করতে পারে। এই সকল প্রচেষ্টার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে প্রস্তাবিত ন্যাশনাল ফিল্ম কাউন্সিল। এফডিসির ভঙ্গুর কাঠামোকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে নতুন আইন বা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে এই ফিল্ম কাউন্সিলের কাজ শুরু করা যেতে পারে।