তখনো আমরা বিয়া ফিরিয়েতো বস্তির নাম শুনিনি।
‘পেলুসা’কেও চিনি না। ইভা পেরনের বিপ্লবও দূরের দিগন্ত। আর সিরিলোও অচেনা। হাফ প্যান্ট
পরা সেই বয়সে দিয়েগো ম্যারাডোনাকে প্রথম দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়।
আগেও তাকে দেখেছিলাম টি-শার্টে কিংবা দৈনিক
কাগজের পাতায়। স্থির। নিশ্চল। চুরানব্বইয়ে প্রথম আমার ম্যারাডোনা বল পায়ে দৌঁড়ালেন।
মধ্যরাতে। গ্রিসের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা সেদিন মাঝরাতেই খেলেছিল। ম্যারাডোনা গোলও করেছিলেন।
তারপর ক্যামেরার দিকে ছুটে গিয়ে সে কী হুঙ্কার।
তখন তিনগাঁও মিলে একটা টেলিভিশন থাকত। ভরা বর্ষার সময় বিশ্বকাপ হতো। সাপের ভয়, মারের ভয় সব উপেক্ষা করে মাঝরাতে আমরা ফুটবল অভিসারে বেরোতাম। টেলিভিশন বাড়িতে বিদ্যুত্ না থাকলে কষ্ট বেড়ে হতো দিগুণ। মফস্বল শহরে অন্য কার বাড়িতে টেলিভিশন আছে—খোঁজ লাগাও। রাতের মধ্যে খুঁজে পেতেই হবে যে। ম্যারাডোনাকেও দেখতেই হবে। সেসব দিন এখন আর নেই। বিশ্বকাপ এখন শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেভাবে খুশি দেখতে পারবেন। চাইলে পুরনো ম্যারাডোনাকেও দেখে নিতে পারেন। লিখতে গিয়ে কী ভুলটাই না করে ফেললোম দেখুন তো। চির নতুন ম্যারাডোনাকে পুরনো বলে ফেলেছি। স্মৃতি যতই মলিন হোক, ছিয়াশি মলিন হবে না কোনোদিন। পুরনো হওয়ারও তাই প্রশ্ন নেই।
লেখা শুরু করেছিলাম আমেরিকান বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা
দেখার কৈশর স্মৃতিচারণে। সে স্মৃতি বুকে অমলিন থাক। এবার গল্পে ঢুকে পড়ি। আপনারা কী
ভাবেন জানি না, তবে আমার মনে হয় ম্যারডোনা আসলে একটা স্মৃতির মালা, যা আমরা নিজের মতো
করে যত্নে, ভালোবেসে গলায় পরে বসে আছি। বিশ্বকাপ এলেই সে মালা বুকের কাছে দোলে। টান
পড়ে। ভালো লাগে।
এবার খারাপ লাগছে। তিনি নেই বলে। ছিয়াশি-বিশ্বকাপের
নায়ক চিরতরে হারিয়ে গেছেন ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর। বিয়া ফিরিয়েতো বস্তির ছেলেটা আর কোনোদিন
অভিমান করবে না। নেশা করবে না। ফুটবল পায়ে অমর কাব্যও লিখবে না। কাকা সিরিলো হাজারবার
ডাকলেও সারা দেবে না। বুয়েন আয়ার্সের বিয়া ফিরিয়েতো বস্তির বাতাসে কান পাতলে যে ডাক
হয়তো এখনো শোনা যায়। ঝড়-বৃষ্টির রাতে ছোট্ট খুপরিটা যখন ভেসে যেত, তখন ফুলের মতো তুলতুলে
‘পেলুসা’ কাকার কোলে চড়ে আশ্রয় খুঁজতেন। কৌটা, বাদাম, বস্তা, নেকড়া যা পেতেন তা দিয়ে
বল বানিয়ে সারাদিন খেলতেন। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়তেন নর্দমার পাশে ময়লার স্তূপে হেলান
দিয়ে। প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যেত না। তখনই বিয়া ফিরিয়েতোর অন্ধকার বস্তির পথে শোনা যেত
সিরিলোর গলা, ‘দিয়েগো কোথায় আছিস..মাথাটা তোল।’
ম্যারাডোনার জন্ম হয়েছিল ইভা পেরনের নামাঙ্কিত হাসপাতালে। বস্তির ছোট্ট ঘরে পেরনের ছবিও টাঙানো ছিল। বাবা-মা ছিলেন পেরন ভক্ত। সিনিয়র ম্যারাডোনা ফরাসি শরণার্থী হয়ে আর্জেন্টিনায় এসেছিলেন। স্প্যানিশ শরণার্থী দালমা সালভাদোরাকে বিয়ে করেন। তখন এমন শরণার্থীতে ভরা ছিল দেশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে আর্জেন্টিনাকে বলা হতো অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য। এমন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিত্বের নাম ইভা পেরন। ‘ম্যারাডোনার মতো অতি দারিদ্র্য থেকে উঠে এসছিলেন। তার প্রেমিক ও স্বামী খুয়ান পেরন ছিলেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট। মাত্র তেত্রিশে ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগে, ছয় বছরে ইভা আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ভাবনা। গরিব, শ্রমিক, মহিলাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার সে দেশে তার আগে কেউ হয়নি। গান্ধীবাদ, মার্ক্সবাদের মতো আর্জেন্টিনায়ও একটা মতবাদ রয়েছে-পেরনইজম। লেখক রূপায়ণ ভট্টাচার্যের চমত্কার লেখা থেকেই জানতে পারি ম্যারাডোনার পেরন-প্রীতি।
সমাজ-রাজনীতিতে পেরন যা করেছেন ম্যারাডোনা
তা করেছেন ফুটবলে। গত শতাব্দীর বিশের দশকে আর্জেন্টিনার অভিবাসী মনকে এক সুরে বেঁধেছিল
ফুটবল। এরপর ম্যারাডোনা এসে তা এমনই উচ্চগ্রামে ছড়িয়ে দিলেন যে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো।
কে কোন দেশ থেকে, সমাজের কোন স্তর থেকে, সংস্কৃতির কোন অলিন্দ থেকে এসেছেন-ছিয়াশিতেই
আর্জেন্টিনার মানুষ ভুলে গিয়েছিল তা। তখন থেকেই ওরা দেশের বাইরে গেলেই নাকি বলে, ‘আমার
আর ম্যারাডোনার পাসপোর্টের রঙ একই।’
নিশ্চয়ই ভুল বলে না। ছিয়াশির পর গোটা দুনিয়া
যেখানে ম্যারাডোনাকে আর্জেন্টিনার সমার্থক ভেবে নিয়েছে, সেখানে এমন নাগরিক গর্ব তো
সামান্য ব্যাপার। তবে বিয়া ফিরিয়েতো বস্তি থেকে তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠা কিন্তু সামান্য
নয়। ৬০ বছরের অসামান্য জীবন পরিক্রমার পথে কিনা করেছেন তিনি। ঝাঁকড়া চুলের ‘পেলুসা’
থেকে ফিওরিতো হয়েছেন। মানে ফুলের মতো সুন্দর। লানুসের হতদরিদ্র গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের
কেউ হয়তো ছোট্ট দিয়েগোর ফুলের মতো ড্রিবল দেখেই ফিওরিতো নামে ডেকেছিল। মাত্র ৬০ বছরেই
পৃথিবীর বৃন্ত থেকে সেই ফুলটা ঝরে গেছে। তা বলে আকাশি-নীল ১০ নম্বর জার্সির ইতিহাস
মুছে যায়নি। ছিয়াশিকে মুছে ফেলবে কে?
স্রেফ দুটি পা আর কয়েকটি গোলের অনুপম প্রদর্শনীতে একটা বিশ্বকাপের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তখন অবশ্য জানা ছিল না গোটা শতাব্দী নিজের করতে চান। জানা গেল তখন মেক্সিকো বিশ্বকাপে সাড়ে পাঁচ ফুটের জাদুকর যখন সবুজ ক্যানভাসে মায়া বিস্তার শুরু করলেন। এরপর নেপলস, বার্সেলোনার মতো কত শহর তার দুটি পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে পড়ল। তার পায়ের কাছে হূদয় বন্ধক দিল। আজও তা বাঁধা পড়ে আছে। অনন্তকাল বাঁধাই থাকবে। কেন-সে কারণ খুঁজতে গেলে ধাঁধাঁয় পড়বেন। এল দিয়েগো লিখতে গিয়ে যেমন ধাঁধায় পরেছিলেন ম্যারাডোনার আত্মজীবনীকার মার্সেলা মোরা ই আরাউহো।
ফুটবল অন্তপ্রাণ সাংবাদিক কাশীনাথ ভট্টাচার্যকে
গল্পে গল্পে বলেছিলেন, ‘নৃতত্ত্ববিদ বা সমাজবিজ্ঞানীরা কারণটা বলতে পারবেন, আর্জেন্টিনার
ফুটবল-সংস্কৃতি আমাদের কেন এবং কীভাবে একত্রিত রাখে, দেশের বহুবিধ সমস্যার মধ্যেও।
তাই ফুটবল আর বিশ্বের সেরা ফুটবলারের এই জুটির মধ্যে আর্জেন্টিনার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল
তাদের জাতীয় প্রতীক। দিয়েগো হয়ে উঠেছিলেন আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভের
মতো। ওর কফিন রাখা ছিল ঠিক সেখানে, যেখানে খুয়ান ও ইভা পেরনের (আর্জেন্টিনার সাবেক
রাষ্ট্রপতি ও ফার্স্ট লেডি) শরীর রাখা হয়েছিল কফিনবন্দি। ওরাও বিতর্কিত মানুষ ছিলেন,
কিন্তু ওদের মতোই সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছিল দিয়েগোকেও। কারণ আর্জেন্টিনার মানুষ
জানতেন, দিয়েগোর চেয়ে বেশি আর্জেন্টিনীয় আর কেউ নন। ওর এই ভঙ্গুর মানসিকতা, নানা ব্যাপারে
দুর্বলতা, আবার একই সঙ্গে এত সফল, এত প্রতিভাবান এবং এতটাই দুরন্ত থাকার মধ্যে যে বৈপরীত্য,
এটাও হয়তো আর্জেন্টিনীয় মানসিকতার প্রতিফলন। তাই ওর সঙ্গে আমরা নিজেদের মিলিয়ে নিতে
কখনো দুবার ভাবিনি। ওর এই আবেগপ্রবণ মন, বিতর্ক ডেকে-আনা চরিত্র আর চূড়ান্ত সাফল্য
যেন পেন্ডুলাম হয়ে দুলত সারাক্ষণ। যা-যা করেছেন, সবার থেকে ভালো, সবার থেকে বড় আর যখন
নেমেছেন, অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে, অন্ধকারের পথে, সেখানেও বোধহয় সবচেয়ে খারাপ তখন! আমার
চিরকালই মনে হয়েছে, এই বৈপরীত্যই আসলে ওর বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তার কারণ। মানুষ ওর মধ্যে
খুঁজে পেয়েছে অবিশ্বাস্য মনুষ্যত্ব এবং অতি অবশ্যই এক সুপারম্যানকে।’
এটাই আসল কথা। কিন্তু শেষ কথা নয়। প্রবাহমান একটা নদী, সমুদ্র কিংবা সভ্যতা নিয়ে শেষ কথা বলা যায় না। ম্যারাডোনাকে নিয়েও বলা সম্ভব নয়। কারণ ম্যারাডোনা এক ফুটবল সভ্যতার নাম।
ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বণিক বার্তার বিশেষ ম্যাগাজিন লা’ইব থেকে নেয়া