এল ক্লাসিকো

মাদ্রিদের আকাশে চারবার তারা খসালো বার্সেলোনা

হান্সি ফ্লিক বলেছিলেন, জার্মানিতে কিছু ম্যাচকে ক্লাসিকো বলা হয়, কিন্তু এটা একদমই আলাদা। এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন। সে সঙ্গে, যতটা ভালোভাবে ক্লাসিকো অভিষেক হওয়ার আশা তিনি করতে পারতেন, তেমনভাবেই করলেন। আর থামিয়ে দিলেন মাদ্রিদের ৪২ ম্যাচ অপরাজিত ৪২ থাকার রেকর্ড। ৪৩ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বার্সার রেকর্ড তাই নিজ হাতেই বাঁচালেন জার্মান কোচ।

জীবন হয়তো সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে সীমার প্রান্তে। বার্সেলোনা এমনভাবে এল ক্লাসিকো খেলল যেন, অনেক উঁচুতে ঝুলিয়ে দেয়া কোনো দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে শত্রুর ডেরায় প্রবেশ করে মর্যাদার লড়াইয়ে জিতে ছিনিয়ে আনলো তিন পয়েন্ট ও হোলি গ্রেইল! জার্মান কোচ হান্সি ফ্লিকের ‘হাই ব্যাক লাইনের’ সাহসী পরিকল্পনার নিখুঁত নির্ভুলতায় বাস্তবায়নে সান্তিয়াগো বার্নাবেউতে ধরা পড়লো কিলিয়ান এমবাপ্পে-ভিনিসিয়াস জুনিয়রদের হতাশামাখা মুখ। দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে ইউরোপীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ ধ্রুপদী বিন্দু এল ক্লাসিকোয় লা মাসিয়া থেকে মূল দলে আসা একঝাঁক বার্সা তরুণের সাহসের সামনে এক এক করে চারবার তারা খসলো মাদ্রিদের আকাশ থেকে। আর লা লিগার পয়েন্ট টেবিলে রেয়াল মাদ্রিদের চেয়ে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে গেল বার্সেলোনা।

বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে চার গোল করার তিন দিনের মাথায় হানসি ফ্লিকের দল সান্তিয়াগো বার্নাবেউতে এসে আবারও চার গোল করল। স্বপ্নের মতো করে রাঙালো চলতি মৌসুমে তাদের সবচেয়ে কঠিন সপ্তাহ। পোলিশ গোলমেশিন ৩৬ বছর বয়সী রবার্ট লেভানডোভস্কি দুটি গোল করলেন, তার চেয়ে ১৯ বছরের ছোট লামিন ইয়ামালও ক্ষত সৃষ্টি করলেন রাজকীয় মাদ্রিদের দেয়ালে। সে সঙ্গে, সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় হিসেবে এল ক্লাসিকোয় গোল করার ইতিহাসও গড়লেন। আর শেষ গোলটি করে চিত্রনাট্যের ষোলকলা পূর্ণ করলেন হান্সি ফ্লিকের ভাষায়, এই বার্সার পাল্টে যাওয়ার অপর নাম ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রাফিনিয়া।

বার্সেলোনার জন্য ঝুঁকি বলে ধরা হচ্ছে যে পরিকল্পনাকে, সেটা তাদের অস্বাভাবিক হাই ডিফেন্স লাইন। আর এ ধরনের হাই ডিফেন্স লাইনকে কার্যকর করতে গেলে যে তীব্রতার প্রেসিং করে যেতে হয় সেটাও প্রায় শতভাগই ছিল বার্সায় খেলায়; অনেকটা বায়ার্নের ম্যাচের মতোই। তবে এই ম্যাচে এই পরিকল্পনায় ঝুঁকির কথা বারবার বলার কারণ হলো, রেয়ালের একাদশে থাকা দুটি নাম— এমবাপ্পে ও ভিনিসিয়াস জুনিয়র। হাই ব্যাক লাইনের পরিকল্পনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে দারুণ ক্ষিপ্র গতির এই দুই ফরোয়ার্ডের বিকল্প এখন বিশ্ব ফুটবলে খুব বেশি নেই। সঙ্গে, নাম্বার টেন ভূমিকায় জুড বেলিংহামের উপস্থিতিও ছিল, কিন্তু মাঝমাঠে পেদ্রির মাস্টারক্লাসের সঙ্গে কাসাদোর ওয়ার্করেটে সামনে বেলিংহাম-ভালভার্দে-কামাভিঙ্গারা জার্সির পেছনে নাম ছাড়া অস্তিত্বের জানান দিতে পারেননি।

অবশ্য কোচের এমন পরিকল্পনা নিশ্চয়ই দলটির সমন্বয় ও সাহসকেও প্রকাশ করে। আর সাহসের সঙ্গেই আসে ঝুঁকি, বিশেষ করে এমবাপ্পে এবং ভিনিসিয়াস জুনিয়রের মতো দ্রুত গতির খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে। খেলার শুরুতেই প্রকাশ পেল এই ঝুঁকি যখন এমবাপ্পে মাত্র ৮৫ সেকেন্ডের মাথায় পরিষ্কার জায়গায় চলে গেলেন। ফরাসি এই তারকার অবস্থানটি ছিল একদম নিখুঁত, বাম দিক থেকে এসে শরীর বাঁকিয়ে কাঁধ নামিয়ে কাছের পোস্টের দিকে শট নেন। বল স্পর্শ করে জালের বাইরের অংশ। রিপ্লেতে দেখা যায়, অফসাইডে ছিলেন এমবাপ্পে। বাকিটা ম্যাচের নিরীখে গল্প আর সময়ের খাতিরে ইতিহাস।

এভাবেই প্রতিবার মাদ্রিদ ফাঁকা জায়গায় দৌড়ে যাচ্ছিল এবং প্রতিবার উঠে যাচ্ছিল অফ সাইড ফ্ল্যাগ। ৩০ মিনিটের মধ্যে মাদ্রিদ ছয়বার অফসাইডের ফাঁদে পড়ল এবং ম্যাচ শেষে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১২’তে।

অন্যদিকে, দ্বিতীয়ার্ধে গোল খুঁজে পেল বার্সেলোনা। মাদ্রিদের ডিফেন্স লাইন ভেঙে গেল ফারল্যান্ড মেন্ডির কাছে। আর লেভাও প্রস্তুত ছিলেন। এমবাপ্পের মতো অফসাইড না থেকে সময়মতো দৌড়ে গিয়ে দুর্দান্ত নিচু শটে স্কোরশিটে নাম তুললেন।

দুই মিনিট পর লেভানডোভস্কি আবার গোল করলেন। এবার আলেহান্দ্রো বালদের ক্রসে হেড করে। হ্যাটট্রিকও পেতে পারতেন তিনি। প্রথমবার রাফিনিয়ার পাসে খালি গোলে শট নিয়েও অবিশ্বাস্যভাবে মিস করলেন। পরেরবার লামিন ইয়ামালের পাস থেকে পাওয়া বল উড়িয়ে মারেন বারের ওপর দিয়ে।

এই দুইয়ের মধ্যে একবার এমবাপ্পে মাঝখান দিয়ে ফাঁকা জায়গায় বল পেয়ে যান। এবার তিনি অফসাইড না থাকলেও ইনাকি পেনার বাধা পার হতে পারেননি। ছত্রভঙ্গ মাদ্রিদের বিরুদ্ধে উন্মুক্ত খেলায় সুযোগ এলো বার্সার হাতে। লামিন ইয়ামাল ও রাফিনিয়ার গোলে স্কোরশিটও মর্যাদা রাখলো বার্সার সাহস ও কার্যকারিতার।

২১ বছরের কম বয়সী ৬ খেলোয়াড় নিয়ে একাদশ জানানো বার্সেলোনা সাদা জার্সিধারীদের লাইনের পেছনের জায়গাগুলোতে ছুটে বেড়াল, কার্লো আনচেলত্তির দলকে করে ফেলল খণ্ডবিখণ্ড। প্রথমার্ধে কিছুটা এলোমেলো থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে যেন মাদ্রিদকে পেয়ে বসে বার্সা। ৫৪ ও ৫৬— দুই মিনিটের ঝড়ে আনচেলত্তির কপালে বিরল কুঞ্চন সৃষ্টি করেন বার্সার নাম্বার নাইন লেভানডোভস্কি। এরপর ৭৭ মিনিটে লামিন ইয়ামাল ও ৮৪ মিনিটে রাফিনিয়ার গোল বার্নাবেউর সাদা অংশে নিয়ে এসেছে সমাধির নিস্তব্ধতা। তবে গোলের সহজ অন্তত দুটো সুযোগ লেভানডোভস্কি মিস না করলে স্বরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় লজ্জায়ই ডুবতে হতো ‘গ্যালাকটিকো ৩.০’কে।

হান্সি ফ্লিক বলেছিলেন, জার্মানিতে কিছু ম্যাচকে ক্লাসিকো বলা হয়, কিন্তু এটা একদমই আলাদা। এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন। সে সঙ্গে, যতটা ভালোভাবে ক্লাসিকো অভিষেক হওয়ার আশা তিনি করতে পারতেন, তেমনভাবেই করলেন। আর থামিয়ে দিলেন মাদ্রিদের ৪২ ম্যাচ অপরাজিত ৪২ থাকার রেকর্ড। ৪৩ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বার্সার রেকর্ড তাই নিজ হাতেই বাঁচালেন জার্মান কোচ।

ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতা কিলিয়ান এমবাপ্পের। তার ক্লাসিকো অভিষেক হলো ভুলে যাওয়ার মতো। বড় সুযোগ হাতছাড়া করেছেন, গোলমুখে মেরেছেন এলোমেলো শট। বার্সার হাই ব্যাক লাইনের ফাঁদে পড়েছেন অর্থাৎ, অফসাইড হয়েছেন ৭ বার! আর দারুণ ফর্মে থাকা ভিনিসিয়াস জুনিয়রও একই সপ্তাহেই দেখে ফেললেন জীবনের আশ্চর্য বৈপরীত্য।

আরও