সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাজয়ী বাংলাদেশের মেয়েদের অর্জনের ঢেউ লেগেছে দেশের সর্বত্র। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে এখন আনন্দ। সাফজয়ী দলের তিন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়েরই বাসিন্দা। সাবিনা খাতুন, মাসুরা পারভীন আর আফিদা খন্দকার যেমন সাতক্ষীরার গৌরব; ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামে আলো জ্বালিয়েছেন সানজিদা, দুই শাসসুন্নাহার, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্ডা আর তহুরা খাতুন। ঠিক তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়িও এখন জাতীয় দলের গর্বিত তিন প্রতিনিধির সাফল্যে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। ঋতুপর্ণা টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড় ও রুপনা চাকমা টুর্নামেন্টসেরা গোলকিপার হয়ে আলো কেড়েছেন এবার। এ তিন তারকাকে নিয়ে পাহাড়ের মানুষের গৌরবের যেন শেষ নেই। সবার মুখে মুখে এখন ঋতুপর্ণা, রুপনা, মনিকার নাম।
গত বুধবার কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট ধরে রাখে বাংলাদেশ। নেপালের জালে দুবার বল পাঠাতে পেরেছে বাংলাদেশ, যা করেন মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমা। ৫২তম মিনিটে গোল করে বাংলাদেশকে এগিয়ে দেন মনিকা। এর ৪ মিনিটের মাথায় গোল শোধ করে দেয় নেপাল। শেষ দিকে ঋতুপর্ণার দুর্দান্ত গোলে আবারো লিড নেয় লাল-সবুজরা। সেই গোল আর শোধ করতে পারেনি নেপালিরা। টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন রাঙ্গামাটির কন্যা ঋতুপর্ণা ও টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক রুপনা।
ঋতুপর্ণার গ্রামের বাড়ি রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম মগাছড়ি গ্রামে। রুপনার বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভূঁইয়াদাম গ্রামে। আর মনিকার বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়নের সুমান্ত পাড়ায়।
রুপনার এক প্রতিবেশী বণিক বার্তাকে জানান, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল রুপনার। ফুটবল ছাড়াও খেলতেন ক্রিকেট। এরপর রাঙ্গামাটির ঘাগড়ায় উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ফুটবলকে রপ্ত করেন তিনি। রুপনার গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা একই গ্রামের লোক। রুপনা আমার নাতি লাগে। তার জন্য আমরা গর্বিত, উচ্ছ্বসিত।’ এক নারী বলেন, ‘মোবাইলে আমি তার খেলা দেখছি, চ্যাম্পিয়ন হইছে। আমার খুব আনন্দ লাগছে।’
২০২২ সালের সাফ জয়ের পর সরকার তাকে একটি সেমি পাকা ঘর করে দিয়েছে। গ্রামের পথে মাউরুম ঝিরির ওপর হচ্ছে পাকা সেতুও। কিন্তু এখনো তাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা বেহাল। বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ও রুপনার চাকরি চান তার মা কালাসোনা চাকমা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জিতেছে বলে সবাই খুশি, আমিও খুশি। খেলাধুলা করে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। এখন রুপনার একটা চাকরি দরকার। আমাদের বাড়ি আসার পথে রাস্তাটাও করা দরকার। আমি এ দুইটা জিনিস চাই।’
এদিকে, সাফ চ্যাম্পিয়ন ঋতুপর্ণা, রুপনা ও মনিকাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কাঠমান্ডুতে টানা দ্বিতীয়বারের মতো উইমেন্স সাফ চ্যাম্পিয়ন বিজয়ী পাহাড়ের কন্যাদের এবারো সংবর্ধনা দেয়া হবে। আমরা পরিকল্পনা করছি, এবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান কীভাবে কেমন আয়োজন করা যায়।’
বাংলাদেশ ফুটবল দলের রসদ জোগাচ্ছে পার্বত্য জেলা দুটি ছাড়াও সাতক্ষীরা ও ময়মনসিংহ। টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সাতক্ষীরার তিন নারী ফুটবলার। চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, রক্ষণভাগের মাসুরা পারভীন ও আফিদা খন্দকার প্রান্তির বাড়ি সাতক্ষীরায়। সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পর সাতক্ষীরায় আনন্দ শোভাযাত্রা করেছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছেন খেলোয়াড়দের বাড়িতে। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের। বৃহস্পতিবার বেলা ২টার সময় শহরের তুফান কোম্পানি মোড় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামেও বইছে আনন্দের বন্যা। বৃহস্পতিবার দুপুরে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক চার শিক্ষার্থী এবং বর্তমান দুই শিক্ষার্থী বাংলাদেশ দলে অংশ নিয়েছে। ফলে গ্রামবাসী, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, খেলোয়াড় সবাই মিলেই উদযাপন করেছে এ বিজয়। বিজয়ী দলে কলসিন্দুরের ছয় খেলোয়াড় হলেন শামসুন নাহার সিনিয়র, শামসুন নাহার জুনিয়র, তহুরা, সানজিদা, শিউলী আজিম ও মারিয়া মান্ডা। টুর্নামেন্টে তহুরা পাঁচ গোল করেন। এছাড়া শামসুন নাহার জুনিয়র করেন এক গোল।
এ সময় কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফুটবল কন্যাদের ‘মা’ খ্যাত অধ্যাপক মালা রানী সরকার, ফুটবল কোচ জুয়েল মিয়াসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। কোচ জুয়েল মিয়া বলেন, ‘টানা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এতে দেশবাসীসহ কলসিন্দুরবাসী আনন্দিত। মেয়েদের এমন সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকুক।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি প্রান্ত রনি